Home / শীর্ষ সংবাদ / মা’ ইলিশ রক্ষা অভিযান শেষ হতেই জাটকা ধরায় নিষেধাজ্ঞা শুরু
jatka
ফাইল ছবি : প্রতীকী হিসেবে ব্যবহৃত হলো

মা’ ইলিশ রক্ষা অভিযান শেষ হতেই জাটকা ধরায় নিষেধাজ্ঞা শুরু

অভয়াশ্রমে ডিমওয়ালা মা ইলিশ রক্ষা অভিযান শেষ হতেই ৩ দিনের মাথায় জাটকা ধরায় ৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ১ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার থেকে আগামী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা থাকবে বলে জানিয়েছে মৎস্য বিভাগ।

অভয়াশ্রমের মতো কড়াকড়ি না থাকলেও জাটকা ধরার নিষেধাজ্ঞা অমান্যে রয়েছে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান। সাধারণ:ইলিশের ছোট সাইজ তথা ২৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত দৈর্ঘের সকল ছোট ইলিশ জাটকা হিসেবে চিহ্নিত।

ইলিশের প্রজনন মৌসুমে গত ৭ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন মা ইলিশ ধরা বন্ধ ছিল। এখন জাটকা রক্ষা করার সময়। তাই প্রজনন মৌসুম শেষ হওয়ার তিন দিনের মাথায় দেশের সব নদ-নদীতে জাটকা ধরায় আট মাসের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এ ৮ মাস জাটকা ধরা, বিক্রয়, মজুদ ও পরিবহন সম্পূর্ণরুপে বন্ধ থাকবে। তবে বড় আকারের ইলিশ ধরতে কোনো বাধা নেই।

জেলেদের দাবি, নদীতে ছোট ফাঁসের জাল ফেললে ছোট-বড় প্রায় সব সাইজের ইলিশ ধরা পড়ে। জালে মাছ বাধার পর আর ফেলে দেয়া হয় না। এ অবস্থায় কারেন্ট জালের পাশাপাশি ছোট ফাঁসের জাল উৎপাদন বন্ধের দাবি উঠেছে। একই সঙ্গে জেলেরা জাটকা ধরা বন্ধ থাকাকালীন সময়ে প্রয়োজনীয় সাহায্যের দাবিও জানিয়েছেন।

মৎস্য বিভাগ জানায়, সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে কারাদ- ও অর্থদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। এই সময়ে জাটকা ধরা বন্ধ রাখতে সাগর থেকে ইলিশ আহরণকারী জেলেদেরকে খাদ্য সহায়তা দেবে সরকার। জাটকা ধরা বন্ধ করা গেলে আগামী মৌসুমে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে বলে মৎস্য বিভাগ আশা করছে।

চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আসাদুল বাকি চাঁদপুর টাইমসকে জানান, মা ইলিশ ডিম ছাড়ার পর তা পর্যায়ক্রমে রেনু, জাটকা এবং পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ ইলিশে পরিণত হয়। ডিম থেকে রেণু তৈরি হওয়ার পর পরিপূর্ণ ইলিশে পরিণত হতে প্রায় এক বছর সময় লাগে। তাই ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ৮ মাস দেশের সব নদ-নদীতে জাটকা ধরা বন্ধ থাকবে।’

মা ইলিশের মতো জাটকা রক্ষায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চলবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি চাঁদপুর টাইমসকে জানান, ‘মা ইলিশ রক্ষায় আমরা নদীতে ২৪ ঘণ্টাই পাহারায় থাকি। জাটকা রক্ষায় তা হবে না। তবে আমরা পর্যবেক্ষণে থাকবো যাতে জেলেরা ইলিশ কিংবা অন্য মাছ ধরার ফাঁকে জাটকা না ধরতে পারে। এক্ষেত্রে কারেন্ট জালের প্রতি বেশি নজরদারি থাকবে।

কারেন্ট জাল প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘সারাবছরই কারেন্ট জাল নিষিদ্ধ থাকছে, জাটকা সাধারণত অন্য মাছের সাথে কারেন্ট জালে জাটকা ইলিশ আটকে যায়। কারণ এ জালটির সুতা পানির বর্ণের সাথে মিল থাকায় ছোট মাছগুলো তা দেখতে পায় না। এ বিষয়ে আমাদের কঠোর অবস্থান থাকবে।’

ছোট ফাঁসের জাল দিয়ে জাটকা ধরার অভিযোগ রয়েছে, তাই শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জাটকা রক্ষা কতোটুকো সম্ভব? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি চাঁদপুর টাইমসকে জানান, ‘ছোট ফাঁসের যেসব জাল দিয়ে জেলেরা মাছ ধরে , এগুলো পানিতে মাছেরা দেখতে পায়, তাই গণহারে জাটকা এ জালের মাধ্যমে ধরা কম পড়ে। তারপরেও অনেক মাছের সাথে কিছু জাটকা ধরা পড়লেও সেগুলো নিয়ে জেলেদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে গেলে তারা ক্ষতির সম্মুখিন হবে।’

নদীতে সব ধরনের মাছের প্রজনন রক্ষায় কারেন্ট জাল উৎপাদন বিপণন বন্ধের দাবিও জানান এ কর্মকর্তা।

এদিকে মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে চার লাখ ৯৬ হাজার মেট্রিক টন এবং ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে পাঁচ লাখ ৯ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদন হয়েছে। আর চলতি বছর ইলিশের উৎপাদন আরও বেশি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। গবেষণায় আরো একটি ইলিশের আবাসস্থল সরকার ঘোষণা করেছে। এ নিয়ে ইলিশের অভয়াশ্রমের সংখ্যা দাঁড়ালো ৬টিতে। ফলে দেশের ইলিশ অভয়াশ্রমের ব্যাপ্তি বা দৈর্ঘ্যও বৃদ্ধি পেয়ে এখন ৪ শ’১০ কি.মি।

এসব বিষয়ে চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক ড. আনিসুর রহমান চাঁদপুর টাইমসকে জানান, ইলিশ প্রায় সারা বছরজুড়ে ডিম ছাড়ে। বড় পূর্ণিমার এই সময় (৭ থেকে ২৮ অক্টোবর) পর্যন্ত ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম ধরা হয়। এই সময়ে ঝাঁকেঝাঁকে মা ইলিশ উপকূলের কাছাকাছি এসে অভয়াশ্রমগুলোতে ডিম ছাড়ে। একটি ইলিশ সর্বোচ্চ ২১ লাখ পর্যন্ত ডিম ছাড়ে। গড় হিসেবে একটি মা ইলিশ ১০ থেকে ১২ লাখ ডিম ছাড়ে বলে তাদের গবেষণায় উঠে এসেছে। ওই ডিম থেকে প্রথমে রেণু এবং পরবর্তী সময়ে জাটকায় (ছোট ইলিশ) পরিণত হয়। ইলিশ যে হারে ডিম ছাড়ে তার মধ্যে থেকে শতকরা পাঁচ ভাগ রেণু (বাচ্চা) বেঁচে থাকে। বাকি ডিম নানাভাবে নষ্ট হয়ে যায়।

ইলিশ গবেষক ড. আনিসুর আরও জানান, ২২ দিন ইলিশ যে হারে ডিম ছেড়েছে তা যথেষ্ট। এখন জাটকা রক্ষা করতে হবে। মার্চ থেকে এপ্রিল এই দুই মাসে সব চেয়ে বেশি জাটকা ধরা পড়ে। সে ক্ষেত্রে সবাইকে সচেতন হতে হবে। গত বছর গড়ে শতকরা ৪৬ ভাগ ইলিশ ডিম ছেড়েছে। এই প্রজনন মৌসুমেও প্রায় একই সংখ্যায় ইলিশ ডিম ছেড়েছে বলে তিনি মনে করেন।

ড. আনিসুর রহমানের তথ্যমতে, প্রাকৃতিক উৎস থেকে মা ইলিশ সংগ্রহ করে প্রজনন করা যা কি না তা নিয়ে গবেষণা চলছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণের জন্য ইলিশ খাঁচায় রেখে ট্রায়াল চলছে। পুকুরে ইলিশ চাষের প্রয়োজন নেই মনে করেন ওই ইলিশ গবেষক। ইলিশ নিরাপদে ডিম ছাড়তে পারলে এবং পরবর্তী সময়ে ওই জাটকা রক্ষা করা গেলে দেশ ইলিশে সয়লাব হবে বলে তিনি মনে করেন।

এদিকে প্রজনন মৌসুম শেষ হওয়ার পর চাঁদপুর মাছঘাটে ইলিশের সরবরাহ দেখা গেছে। নৌকা ও ট্রলারে করে প্রচুর ইলিশ এসে এ ঘাটে বিক্রির উদ্দেশ্যে জড়ো করা হচ্ছে। ছোট-বড় বিভিন্ন সাইজের ইলিশের দেখা গেছে। ক্রেতাদেরও উপচে পড়া ভিড়। ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রামের ওজনের প্রতিকেজি ইলিশ ৩৫০ টাকা এবং ৫০০ থেকে ৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতিকেজি ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জেলে জানান, কিছু জেলে আছে যারা ছোট ফাঁসের জাল নিয়ে সাগরে যায়। ওই জালে ছোটবড় সব সাইজের মাছ ধরা পড়ে। ছোটফাঁসের জাল যাতে কেউ নিতে না পারে এজন্য আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নজরদারি বাড়াতে হবে। জাটকা ধরা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হলে যে সব মিল-কারখানায় ছোট ফাঁসের জাল উৎপাদন হয় তা বন্ধ করতে হবে। সরকার যদি ছোট ফাঁসের জাল উৎপাদন বন্ধ করতে পারে তা হলে জেলেরা ছোট ফাঁসের জাল না পেলে জাটকা ধরতে পারবে না। আর জাটকা ধরা বন্ধ করা গেলে ইলিশ মৌসুমে জেলেদের জালে প্রচুর পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়বে।

প্রতিবেদক- দেলোয়ার হোসাইন
৩১ অক্টোবর, ২০১৮

Leave a Reply