অ্যাড. এ.কে.এম. সলিমূল্যা সেলিম
আজকের প্রসঙ্গ মরহুম অ্যাড. শেখ মতিউর রহমান। তার আগে পরিচয় সূত্র উল্লেখ করা দরকার। আমি নবম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে জড়িত হই এবং ১৯৭৭ইং সনে চাঁদপুর জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনে জেলার ২নং যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হই।
একদিকে মহান স্বাধীনতার ঘোষক জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আহরোন করার পর বাংলাদেশের দ্রুত উন্নয়নের লক্ষ্যে নানামুখী কর্মসূচী ঘোষণা করলে তৎকালীণ ন্যাপ কমিউনিষ্ট পার্টি ও ছাত্র-যুব ইউনিয়ন জিয়াউর রহমানের কর্মসূচীকে দেশ প্রেমিক আখ্যা দিয়ে তা বাস্তবায়নের জন্য নানাহ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
অপরদিকে বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের পুরুধা সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতন্ত্রের পথ থেকে সরে যাওয়ার কারণে পুরো সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে সমাজতন্ত্রের ধস নেমে আসে। ইতিমধ্যে দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘোষণা করা হলে জিয়াউর রহমান দেশের প্রগতিশীল নেতাদের নিয়ে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের ব্যানারে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আওয়ামীলীগ, ন্যাপ ও কমিউনিষ্ট পার্টি সমন্বয়ে ত্রি-দলীয় ঐক্যজোট গঠন করে মুক্তিযুদ্ধে সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম.এ.জি ওসমানিকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী ঘোষণা করেন।
ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি জিয়াউর রহমানের দেশ প্রেমিক কর্মসূচী পরিহার করে ত্রি-দলীয় জোটে যোগ দিলেও আমি মহান স্বাধীনতার ঘোষক মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার, জেড ফোর্সের প্রধান বীরউত্তম জিয়াউর রহমানের উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতার রাজনীতির প্রতি অনুগত থেকে যাই।
অতঃপর রাজনীতির কঠিন চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ও রাষ্ট্রের একযুগ সন্ধিক্ষনে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলসহ কিছু অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করলে আমি তৎকালিন চাঁদপুর সাংগঠনিক জেলা ছাত্র দলের আহবায়ক হিসাবে নির্বাচিত হই।
এরইমধ্যে মরহুম অ্যাড. শেখ মতিউর রহমান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এর লোভনীয় চাকুরী ছেড়ে দিয়ে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রীয় হতে শুরু করলে আমার সাথে শেখ মতিউর রহমানের শুধু রাজনৈতিক সম্পর্কই গড়ে উঠেনি আমি সুদীর্ঘ প্রায় ৩৭ বছর তাহার সাথে ও পাশে থেকে তাহাকে দেখা ও বুঝার সুযোগ পাই।
অ্যাড. শেখ মতিউর রহমান ১৯৩৫ খ্রীষ্টাব্দে ১১ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুর শহর তলীর মৈশাদী তরপুরচন্ডি অবিভক্ত ইউনিয়ন পরিষদের দীর্ঘকালিন চেয়ারম্যান (তৎকালীণ প্রেসিডেন্ট) এবং চাঁদপুর গণি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের আদর্শবান শিক্ষক মরহুম শেখ ছিদ্দিকুর রহমান ও উম্মেহানীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।
শেখ মতিউর রহমানের স্ত্রী আনোয়ারা আলম ডঃ কুদরত-ই-খুদার নাতনী এবং ঢাকা মনিপুরী স্কুল এন্ড কলেজের একজন সহকারী শিক্ষিকা হিসাবে চাকুরী শেষে বর্তমানে অবসর কালীণ সময় কাটাচ্ছেন।
অ্যাড. শেখ মতিউর রহমান ১৯৫০ইং সনে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মেট্রিকুলেশন (বর্তমানে এস.এস.সি) পাশ করেন। ১৯৬২ইং সনে একই বোর্ডের অধিনে এইচ.এস.সি পাশ করেন ১৯৬৪ইং সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চাঁদপুর কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৭৩ইং সনে এলএলবি ডিগ্রী অর্জন করে গত ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের এন্ডরোলমেন্ট নিয়ে ওই বছরে ৫ ফেব্রুয়ারিতে চাঁদপুর জেলা আইনজীবী সমিতির মাধ্যমে চাঁদপুর নিয়মিত আইন পেশায় নিয়োজিত হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত চাঁদপুর আইনজীবী সমিতির সদস্য ছিলেন।
শেখ মতিউর রহমান চাঁদপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) ছিলেন। শেখ মতিউর রহমানের এক পুত্র এক কন্যা। কন্যা নাকিমা নাজনীন বর্তমানে কানাডার অটোয়াতে স্বামীসহ এবং পুত্র আশিকুর রহমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্ত্রীসহ বসবাস করেন।
শেখ মতিউর রহমান কলেজে ভর্তি হয়েই বিভিন্ন স্থানীয় সমস্যা নিয়ে এবং গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কায়েমের পক্ষে সাহসী ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন। ১৯৬২ইং সনে চাঁদপুর কলেজ ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্ট ফ্রন্ট গঠন করেন।
১৯৬৩ইং সনে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন চাঁদপুর মহকুমা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। তারপূর্বে ১৯৫৪ইং সনে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময় পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী দেশাত্ববোধক গণসংগীত (মুসলীমলীগের পোলায় বিলাত যায়, বাঙ্গালীর পোলায় মৈশ খেদায় ………..) পরিবেশন করে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন।
এছাড়াও ১৯৫২ইং সনে মহান ভাষা আন্দোলনে সক্রীয়ভাবে অংশগ্রহণ করায় তিনি একজন ভাষা সৈনিক ছিলেন।
১৯৬২ইং সনে হামিদুর রহমানের শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে চাঁদপুর ছাত্র সমাজকে নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৬৩ইং নভেম্বর মাসে তৎকালীণ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর মোনায়েম খান চাঁদপুর আসলে শেখ মতিউর রহমানের নেতৃত্বে মোনায়েম খানকে কালো পতাকা প্রদর্শনের দায়ে পুলিশ গুলি চালিয়ে তিন জন ছাত্র হত্যা করেন এবং মতি ভাইসহ ২১ জনের নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করেন।
অতঃপর ১৯৬৪ সালে মতিভাই পলাতক জীবনে নবকুমার স্কুলসহ অনেক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন। এক পর্যায়ে মামলা প্রত্যাহার হইলে তিনি পাকিস্তান এয়ার লাইন্সে চাকুরী জীবন শুরু করেন।
চাঁদপুরের সর্বমহলে প্রিয় মতি ভাই হিসাবে সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন। ১৯৭৯ইং সন দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, বাবুরহাট স্কুল মাঠে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী জিয়াউর রহমানের ধানের শীষের পক্ষে এক নির্বাচনী সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমি নিজে সভা সঞ্চালক। কতিপয় সিনিয়র নেতা আমাকে অনুরোধ করলেন বক্তা হিসাবে একজনের নাম ঘোষণা করার জন্য। সেই নামটি অ্যাড. এ্যাডঃ শেখ মতিউর রহমান।
নামটি ঘোষণা করলাম মতিভাই বক্তব্য শুরু করলেন মাঠ উপচেপড়া মানুষ মতি ভাইয়ের বক্তব্য শুরুতেই মানুষ পিনপতন নীরব হয়ে শুনলেন অনলবর্ষী বক্তব্য। প্রথম বক্তব্যেই মতি ভাই উপস্থিত হাজারো মানুষকে বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শুধু হাসালেন আবার কাঁদালেন।
আমরাসহ হাজারো মানুষ প্রিয় নেতার বক্তব্য শুনে মুগ্ধ হলাম। এক পর্যায়ে মতি ভাই আমাদের অনুরোধে বাংলাদেশ বিমানের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে চাঁদপুর বিএনপি’কে সুসংগঠিত করার প্রয়াস নিলেন। আমরা একঝাঁক নবীন এবং প্রবীণ সকলেই হয়ে উঠলাম মতি ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী।
১৯৭৯ইং সনে চাঁদপুর জেলা বি.এন.পির প্রথম সম্মেলনে সর্বসম্মতভাবে এ্যাডঃ শেখ মতিউর রহমানকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল চাঁদপুর জেলা শাখার সাধার সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত করা হয়।
এ্যাডঃ শেখ মতিউর রহমান শুধু সুবক্তাই ছিলেন না তিনি ছিলেন অসাধারণ এক সংগঠক। তাহার সাংগঠনিক কৌশলে এবং অক্লান্ত পরিশ্রমে চাঁদপুর জেলায় বিএনপি এক কঠিন ভিতের উপর দাঁড়ায় যাহার সুফল আমরা আজও অন্তর থেকে উপলব্ধি করছি। প্রিয় মতি ভাই ১৯৮৫ইং সনে সর্ব সম্মত ভাবে চাঁদপুর জেলা বিএনপির সভাপতি নির্বাচিত হন। আমাদের প্রিয় মতি ভাই মৃত্যু পর্যন্ত চাঁদপুর জেলা বিএনপির নেতৃত্ব দিয়ে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন।
মতি ভাই বিএনপিকে বার বার রাষ্ট্র ক্ষমতায় দেখেছেন এবং তিনি ছিলেন চাঁদপুরের ক্ষমতার শীর্ষ ব্যক্তিত্ব। তিনি ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও কোন লোভ লালসা তাহাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি ক্ষমতা বা রাজনীতিকে নিজের হীন স্বার্থে ব্যবহার করেননি। রাজনীতিকে সর্বোত্তম সমাজসেবা হিসাবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি উচ্চাবিলাসী ছিলেন না চিরকাল সাধারন জীবনযাপনে অভ্যস্থ ছিলেন। তিনি তীক্ষè ধী সম্পন্ন ও বাক পটু ছিলেন।
নিজেকে বড় করে প্রকাশ করার প্রবণতা তাহার মধ্যে কখনোই দেখিনি। তিনি ক্ষমতা নয় জনতার কাতারকেই অধিক শ্রেয় মনে করতেন। তিনি নেতা হিসাবে ছিলেন নীতির পূজারী। তাহার এম.পি. মন্ত্রী হওয়ায় মত যোগ্যতার কোন অভাব ছিল না তবুও তাহাকে কখনোই এ সবের প্রতি লোভাকৃষ্ট হতে দেখিনি।
তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন স্বোচ্ছার, আপোষহীন এক সুমহান ব্যক্তিত্ব। তিনি চাঁদপুর থাকতেন জিয়া হোস্টেলের সামনে পৈত্রিক একটি টিনের ঘরে, ঢাকা থাকতেন শ্বশুরের দেয়া একটি ফ্ল্যাটে। তাহার জীবনে কোন বাড়ি/ জায়গা কিছুই রেখে না গেলেও উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে রেখে গেছেন পুত্র ও কন্যাকে।
মতিভাই যে মঞ্চে উঠেছেন সেই মঞ্চে যেই ছিলেন না কেন মতি ভাই হয়ে যেতেন প্রধান আকর্ষণ কারণ মতিভাই তাহার বাঙ্গিমতায় যেমনি জ্বালাতেন তেমনি হাসাতেন আবার কাদাতেও পারতেন। তিনি আমাদের মাঝে নিজেও জ্বলবেন বহ্নি শিখার মত চিরকাল। এই জন্য অনেকে মতিভাইয়ের বক্তব্য শুনার জন্য দূরদূরান্ত থেকে ছুটি আসতেন। আড্ডাতে বসলেও মতিভাই রসিকতাপূর্ণ কথা বলে সকলের মন কাড়তে সক্ষম হতেন। চাঁদপুর জেলা বিএনপিকে সুসংগঠিত করতে তাহার অবদান অপরিসীম। মতিভাই নাই কিন্তু তাহার কৃর্তি আমাদের মাঝে ভাস্কর।
শেখ মতিউর রহমান যাদেরকে রাজনীতির হাতে খড়ি দিয়েছেন তারাই আজ চাঁদপুর জেলা বিএনপির কর্ণধার ও সফল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
তিনি ২০১৫ইং সনের ২৮শে আগস্ট আমাদেরকে শোক সাগরে ভাসিয়ে চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছেন। আমরা মতিভাইয়ের জন্য দোয়া করছি। পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রিয় মতিভাকে জান্নাতবাসী করুন।
লেখক- অ্যাড. এ.কে.এম সলিমূল্যা সেলিম,
১নং যুগ্ম আহ্বায়ক,
চাঁদপুর জেলা বিএনপি।
২৮ আগস্ট ২০১৯