চলতি মৌসুমে কক্সবাজার জেলায় রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদিত হয়েছে। পরিমাণে তা ১৮ লাখ ২০০ মেট্রিক টন, যা গত ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থার (বিসিক) সূত্রে জানা গেছে, তীব্র দাবদাহের কারণেই লবণ উৎপাদন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। পুরো মৌসুমে দুই দফায় ঝড়বৃষ্টিতে মাত্র ১২ দিন লবণ উৎপাদন ব্যাহত হয়েছিল। কক্সবাজারে এবার প্রায় ৬০ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হয়েছে।
এদিকে মাঠের প্রান্তিক চাষিরা বাম্পার উৎপাদনে খুশি হলেও দাম নিয়ে এখন হতাশ হয়ে পড়েছেন তাঁরা। কারণ, প্রতি মণ দাম লবণের এরই মধ্যে ২৫০ টাকা থেকে কমে ১৮০ টাকায় নেমে এসেছে।
চলতি মৌসুমের লবণ চাষ এখন শেষ দিকে রয়েছে। কক্সবাজার জেলা সদরসহ মহেশখালী, কুতুবদিয়া, টেকনাফ, পেকুয়া, চকরিয়া উপজেলায় এখন প্রতিদিন গড়ে উৎপাদিত হচ্ছে ৩০ হাজার মেট্রিক টন, যা অন্য সময় হতো ২০ হাজার টন।
বিসিক কক্সবাজার লবণশিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) দিলদার আহমদ চৌধুরী সম্প্রতি জানান, চাষিরা গত বছরের ১ ডিসেম্বর থেকে ১৫ মে পর্যন্ত সময়েই লবণ উৎপাদনে রেকর্ড করেছেন। সপ্তাহখানেকের মধ্যে আরও এক লাখ টন উৎপাদন হবে। তিনি বলেন, কক্সবাজারে বাণিজ্যিকভাবে লবণ উৎপাদন শুরু হয় ১৯৬০ সালে। সেই থেকে গত ৫৮ বছরে ১৮ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদনের রেকর্ড নেই। কেবল ২০১৩ মৌসুমে লবণ উৎপাদন হয়েছিল ১৭ লাখ ৫২ হাজার মেট্রিক টন।
বিসিকের তথ্যমতে, চলতি বছরে দেশে লবণের মোট চাহিদা ১৬ লাখ ৬১ হাজার মেট্রিক টন। লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল প্রায় ১৮ লাখ মেট্রিক টন। এবার পলিথিন প্রযুক্তিতে লবণ চাষ বেড়েছে। ইতিমধ্যে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছেন লবণচাষিরা।
সরেজমিনে সম্প্রতি মহেশখালী উপজেলার উত্তর নলবিলা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মাঠজুড়ে সাদা লবণের স্তূপ আর স্তূপ। ব্যবসায়ীরা ডিঙিনৌকায় ভরে মাঠের লবণ বদরখালী খালের ঘাটে নিয়ে যাচ্ছেন। সেখান থেকে বড় কার্গো ট্রলার বোঝাই করে সেই লবণ নেওয়া হচ্ছে চট্টগ্রামের পটিয়া, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে।
নলবিলা গ্রামে গিয়ে কথা হয় লবণচাষি ফরিদুল আলমের সঙ্গে। তিনি এবার পাঁচ একর জমিতে লবণ চাষের তথ্য জানিয়ে বলেন, আগের চেয়ে উৎপাদন দেড় গুণ বেশি হয়েছে। কিন্তু লবণের ন্যায্যমূল্য নিয়ে তিনি হতাশ বলে জানান। কারণ, প্রতি মণ লবণ উৎপাদনে যেখানে খরচ হয়েছে ২০০ টাকা, সেখানে তা বিক্রি করতে হচ্ছে ১৮০ টাকায়।
কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুল ইউনিয়নেও লবণ উৎপাদনের ধুম চলছে। চাষিরা প্রচণ্ড গরম উপেক্ষা করে মাঠে কাজ করছেন। তীব্র সূর্যতাপে মাঠে বিছানো কালো পলিথিনের ওপর রাখা সমুদ্রের লোনাপানি জমাট বেঁধে সাদা লবণে পরিণত হচ্ছে। তারপর চাষিরা সেই লবণ কুড়িয়ে স্তূপ করে রাখছেন। কেউ কেউ সেই লবণ পাশের গুদামে সংরক্ষণ করছেন। পাশের চৌফলদণ্ডি, ভারুয়াখালী ইউনিয়নেও দেখা গেছে একই অবস্থা।
এদিকে খুরুশকুলের মামুনপাড়ার চাষি নাজমুল হক বলেন, ‘এ রকম টানা এক মাসের তীব্র দাবদাহ আগে দেখিনি। প্রখর গরমে জনজীবন বিপর্যস্ত হলেও লবণচাষিরা মহা খুশি। কারণ, লবণ উৎপাদিত হলে চাষিদের ভাগ্য খুলবে, সংসারের উন্নতি ঘটবে বলে আশা করি।’
পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউপি চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ ওয়াসিম জানান, তাঁর ইউনিয়নে অন্তত পাঁচ হাজার একর জমিতে লবণের বাম্পার উৎপাদন হয়েছে। তীব্র দাবদাহে বেশি লবণ উৎপাদিত হওয়ায় দাম কিন্তু কমে যাচ্ছে। কয়েক দিন আগে প্রতি মণ লবণ ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এখন মণপ্রতি ৭০ টাকা কমে ১৮০ টাকায় নেমে এসেছে। তিনি বলেন, প্রতি একর জমিতে দৈনিক ১২ মণ লবণ উৎপাদিত হচ্ছে, যার বাজারমূল্য ২ হাজার ২০০ টাকা।
লবণচাষি সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি আনোয়ার পাশা চৌধুরী বলেন, এবার লবণের বাম্পার উৎপাদন হলেও বিদেশ থেকে লবণ আমদানি বন্ধ হচ্ছে না। চলতি মৌসুমেও লবণ আমদানির চক্রান্ত চলছে। এতে উদ্বিগ্ন চাষিরা। চাষিরা চান না বিদেশ থেকে লবণ এনে দেশের লবণশিল্পকে ধ্বংস করা হোক। লবণ আমদানি হলে লবণ উৎপাদন ও বিপণনে জড়িত কক্সবাজারের পাঁচ লাখ মানুষ পথে বসবে।
বিসিক সূত্র জানায়, মাঠে লবণ উৎপাদনের চিত্র দেখতে শিল্পসচিব আবদুল হালিম গত ২৭ এপ্রিল সরেজমিন কক্সবাজারের চৌফলদণ্ডি এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন বিসিক চেয়ারম্যান মোস্তাক হাসান।
তখন অবশ্য বিসিকের চেয়ারম্যান চাষিদের বলেন, দেশে লবণের বার্ষিক চাহিদা ১৬ লাখ মেট্রিক টন। ইতিমধ্যে চাহিদার অতিরিক্ত লবণ উৎপাদিত হয়েছে। ফলে আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরে লবণ আমদানির প্রয়োজন পড়বে না।
এদিকে দেশে রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদন হলেও চাঁদপুরের লবণ মিলগুলোর অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে হলেও প্রতিযোগতামূলকভাবেই ৩৬টি মিল গড়ে উঠেছিল। এখন চলছে মাত্র ২টি। সর্বশেষ চলতি বছরের জানুয়ারিতে মালিকের মৃত্যুজনিত কারণে ১টি লবণ মিল বন্ধ হয়।
চাঁদপুর পুরাণ বাজারের ভেতর ডাকাতিয়ার তীরঘেঁষে এক সময় ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল এ মিলগুলো। নদীপথে যাতায়াত সুবিধার কারণে ব্যবসাও ছিল রমরমা।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের দেয়া তথ্য মতে, বর্তমানে চাঁদপুরে মাত্র ২টি মিল চলছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বিশেষ করে আর্থিক কারণে আরো ১টি মিল বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে মেসার্স বিসমিল্লাহ ও জনতা সল্ট বর্তমানে চলমান রয়েছে। উন্নত প্রযুক্তির অভাবে উৎপাদিত লবণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কাটতি নেই। এদিকে আয়োডিনের মূল্য অনেক বেশি বলে জানা যায় ।
উৎপাদন খরচের সাথে বিক্রি মূল্যে টিকতে পারছেনা ব্যবসায়ীগণ। উৎপাদিত লবণ বাজারজাত করতে খরচ বেশি হয়।দেশের অন্যান্য জেলার মিল মালিকদের বিনিয়োগ চাঁদপুরের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে তাদের চাঁদপুরের লবণ কেনাবেচা, খরিদদার কমে গেছে। আবার অন্য জেলায় উৎপাদিত লবণ চাঁদপুরের বাজারগুলোতে সায়লাব। যার ফলে মার্কেটিং এর ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে।
চাঁদপুরে বর্তমানে দু’টো মিলে দু’রকম লবণ উৎপাদন হচ্ছে। একটি হলো শিল্প লবণ ও ভোজ্য লবণ। প্রতি মাসে মিল দু’টোর উৎপাদন ভোজ্য ২৩০ থেকে ২৫০ মে.টন এবং শিল্প লবণ ৭০০ থেকে ৯ ০০ মে.টন।
চাঁদপুর জেলাবাসীর প্রতি মাসে গড়ে ২৫ মে.টন লবণ প্রয়োজন। এক সময় প্রতি কেজি লবণ আয়োডাইজড করতে খরচ হতো ১০ পয়সা আর বর্তমানে ২২ থেকে ২৫ পয়সা। এক কেজি আয়োডিনের বাজার মূল্য ১৫,০০০ টাকা। যা দিয়ে ১৪-১৫ মে.টন লবণে আয়োডিন মেশানো যায়। চাঁদপুরে লবণ ব্যবসায়ীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় কক্সবাজার থেকে নৌ-পথে এককভাবে কাঁচা লবণ আনতে খরচ অনেক বেশি হয়ে পড়ে।
তবে চাঁদপুরের লবণের রং অনেকটা ঘোলাটে হওয়ায় মোল্লা বা এসিআই লবণের মত চাহিদা সৃষ্টি করতে পারছে না। ফলে ফলে দিন দিন ব্যবসায় মন্দাভাব তৈরি হচ্ছে ।
চাঁদপুর টাইমস রিপোর্ট
২১ মে ২০১৯