মধ্যবাজারে দাঁড়িয়ে গাড়ির জন্য হাত ইশারা করছি। একটা গাড়িও খালি নেই। আমার মত অনেকেই দাঁড়িয়ে… অবসরে মোবাইল টানছে, কেউ হেড ফোন দিয়ে মৃদু মৃদু কথা বলছে।
কান না দিলে শুনার ঝোঁ নেই।
কলেজ, স্কুল মাদরাসা ছুটি হয়েছে। ছেলে মেয়েরা লাফিয়ে লাফিয়ে গাড়িতে উঠছে।
সবার পেটেই মনে হয় ক্ষুধার জ্বালা, না হলে এত হুড়াহুড়ি করবে কেন?
আর খিদে না লেগে তো উপায় নেই সকাল ৬ টায় বের হয়। প্রাইভেট… ইংরেজি, পিজিক্স কেমেস্ট্রি,গণিত, হিসাব বিজ্ঞান বা ইংরেজি, পড়তে হবে না পড়লে ভালোর দৌড়ে টিকবে কী করে, তাঁকে টিকতেই হবে।
কেউ কেউ বলে সেদিন নাই পড়া… পড়া… শুধু পড়া। না হলে বড় হবে কি করে?
এভাবেই কেউ মুড়ি জল বা হালকা কিছু খেয়ে কেউ পেটসই রেখেই বেরিয়ে পড়ে।
ভাবতেই হঠাৎ একটি সম্মানসূচক সম্মোধন শুনা গেলো আদব, অচেনা হলেও সালাম তো নিতেই হয়।
ছেলের নাম সুব্রত,উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী, ছেলেটাকে চিনি আমার স্ত্রীর স্টুডেন্ট হিশেবে।
খুব ভদ্র ও বিনয়ী ছেলে।দেখা হলেই দুর থেকে সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করে স্যার! ম্যাম কেমন আছে।
হাঁ ভালো, আচ্ছা বলো তোমার পড়াশুনো কেমন চলছে, এইতো স্যার জবুথবু।
এবার তো উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিলাম,তাই আচ্ছা তো! পরীক্ষা কেমন হলো এটি বলতেই সে কেমন কেঁপে… আমি আঁটকে গেলাম তাঁর মতিগতি বেশ চমকে দিলো, সিএনজি চলে এলো আমাকে উঠতে হবে, তাই পা বাড়ালাম সে আদব বলে চলে গেলো, আমি তাঁকিয়ে রইলাম সে এখনো মাথা তোলেনি।
তাঁর কথা আমার বাসা পর্যন্ত গড়ালো, তাঁর ম্যামের নাম সেতু, তার কথা শুনে কিছুক্ষণ থেমে কেঁপে উঠলো, ও তো খুব বিনয়ী ছেলে… এদিকে সেতু চটপট করছে আরে কী তুমি ওমন করছো কেন? না চুলায় ভাত পুড়ছে… ছেলেটা এখনো কিছু খায় নি।
তুমি কখন যাবে ছেলেটাকে গোসল করিয়ে দাও, সে টিভি হেডলাইনের দিকে তাক করে আরে… আরে… আমার তো দেরি হয়ে যাচ্ছে।
চট করে রান্না ঘরে চলে গেলো।
আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না।
সেতু আবার এসে বলল তুমি না সুব্রতর কথা বলছিলো। তো এখন সময় নেই, আরে সে তো অনেক কথা। পরে বলা যাবে।
কী কথা সময় লাগবে… এখন না।
আমার মনের মধ্যে উসখুস করতে লাগলো সে আবার এসে দেখে আমি মুখ ঘোমরা করে দক্ষিণ দিকে চোখ তাক করে আছি। আমার বাসার দক্ষিণে একটা নদী আছে নদীর নাম ডাকাতিয়া। মরা ডাকাতিয়া। বর্ষা মৌসুমে এ নদীতে বরিশাল অঞ্চলের কিছু লোকের আগমন ঘটে। কোষা নৌকা নিয়ে রাতভর মাছ ধরে। বর্ষা ঋতুর সাথেই তাদের চুক্তি এবং জীবনের ব্যয়ভার, জল পুুড়িয়ে যায় নদী কানা হয়ে যায় তাদের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে উঠে।
যে নদীর পারে আমার শৈশব কেটেছে,আমার বাবা আমাকে মারতে মারতে এ নদীরবুক থেকে উঠাতেন আমি হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি এসে স্কুলের ব্যাগ নিয়ে ছুটে যেতান, এ নদী আমার শৈশব শিক্ষক। তার কাছে শিখেছি প্রকৃতির নানান কথা সে কথা এখনো আমাকে জাগিয়ে তোলে।
কিন্তু যেদিন বাবা থাকতো না সেদিন এ নদী হতো ঘর ও নদীর গতি হতো, এখানে শুধু আমি একা আসতাম না; আসতো পলাতক কিশোরেরা।
যাঁদের বিদ্যেটা নদীর লম্পেঝম্পে,মাছের কানায়, কলা গাছের বৈঠায়, কছুরির যানবাহনে, ফুটবলের ছুড়া ছুড়িতে, কখনো নদী কখনো নদী পারে হৈ চৈ, মাঝেমধ্যে ঠোঁকরা-ঠুকরি সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে কাঁদার পিরামিড হয়ে বাড়ি ফেরা। একদিন দাদু দেখে ঐ হারামি আয় …ঠাকুর আছে বাড়িতে…
এ বলে সাবান এনে পীঠ ঢলে গোসল করাতো আর মিহি মিহি বকাঝকা করতেন।
দাদু: আর বকো না কালকে ঠিক স্কুলে যাবো। ঠিক যাবে তো…
গেলে কিন্তু আমার কাছে একটা জিনিস আছে… আর কাকেও দেব না হুম…
স্কুল খেলা, বকাঝকা,এভাবেই শৈশব কাল কেটেছে। মিথ্যে নয় স্কুলে না গেলেও আরেকটি স্কুলে ছুটে যেতাম এই কথার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দাদুর ভয়ে ধাানের গোলা হতো আশ্রয়ঘর।
২. আমার বন্ধু সবাই খুব ভালো কিছু করে । বেড়ে ওঠা কেউ ডাক্তার ,কেউ প্রকৌশলী , কেউ ব্যাংকার, কেউ রাজনীতিবিদ, আর আমি মাস্টার মশাই। ভাবছি নদী ধেয়ে চলছে ,সে নিয়ে যায় সেকালে।
বেশ ভালোই হলো নদীর পারে আমার বসবাস এ নদীই তো সে শৈশব আজ নদী গতিশীল পাঠ। পেছন থেকে …
ঐ যে মাস্টার মশাই! কী সময় কী থাকছে; না যাচ্ছে। আলতো থাপ্পড়…
আরে আজকে তো রেজাল্ট দিবে।
মনেই তো নেই, ক্লাস সে আড়াইটায় স্যারের কাছে বলে ছুটি নিয়ে নেই, ভালো লাগছে না।
কী তুিম চুপ কেন? কিছু বলছো না যে…
ওহ শিট্ ভুলেই গেলাম।
সুব্রত … ও তুমি তো তাঁর কথাই জানতে চেয়েছিলে।
ছেলেটা বিনয়ী পড়াশুনোয় মোটামুটি।
তবে একেবারেই ফেলনা নয়!
তাঁর মা হেলথ ইন্সপ্রেক্টর, বাবা বিজনেসম্যান, তাদের বড় ছেলে মোহন্ত স্কলারশীপ পেয়ে আমেরিকায় প্রকৌশলীতে পড়ছে তাঁদের ইচ্ছা সুব্রতও আরো ভালো কিছু করবে। সারাদিন পড়া… পড়া…
ছেলেটা খেলাধূলা ছেড়েছে তাঁর বন্ধুদের কাছে শুনেছি
সে ভালো ক্রিকেট খেলতে পারে, কিন্তু পড়াশুনোর চাপে চাপে প্র্যাকটিস করা ছেড়েছে। তাঁর ইচ্ছে পড়াশুনোর ফাঁকে ফাঁকে খেলাধূলা করে ভালো ক্রিকেটার হবে, কিন্তু আসলে কি হবে তাইতো ঠিক হলো না।
সেতুর কলেজ থেকে কল এলো তাঁকে যেতেই হবে।
সে তো হন্তদন্ত হয়ে উঠে পড়লো, রেডি হতে সময় নিলো কলেজে চলে গেলো, বেলা গড়াচ্ছে ছেলে/মেয়েদের মাঝে টান টান উত্তেজনা, পেইজবুকে দোয়া চেয়ে সব কাঁপিয়ে তুলছে মনে হচ্ছে প্রার্থনাগৃহ যেন পেইজবুকে।
বেলা গড়াচ্ছে, কল আসছে স্যার স্যার একটু দোয়া করবেন। বললাম টেনশন করো না একটা কিছুতো হবে হাত উঁচিয়ে বসে আছি। ভরসা রাখো, তিনি যা করবেন মঙ্গলের জন্য করবেন।
এদিকে কলিকদের মাঝে নানা কথা উঠছে।
কেউ বলছেন ৭০,৭৫, ৮০%… আর নেট ঘেটে যাচ্ছেন ডিমতালে।
বলতে বলতে হঠাৎ একটা শব্দ গড়িয়ে এলো।
পাইছি! কী সবার…
চোখেমুখে অন্ধকার।
বলেন না কী… দাঁড়ান বলছি সাধারণ বোর্ডে ৬৬% মাদরাসা ৭৬% কারিগরি ৭৮%
যা হোক পেইজবুক খুলে দেখি বাজারের চেয়েও এখানে মিষ্টি বেশি।
কী ব্যাপার! মিষ্টির বাজার কী তাহলে এখানে… বাহ
লাইক কমেন্ট পড়ছে মরতে মরতে বেঁচে গেলাম আবার কেউ লিখছে আমি আমার জানু অ+ পেয়েছি।
নেতানেত্রী সূধীমহল বসে নেই অভিনন্দন লিখে পাবলিকি পোস্ট করছেন। আবার কেউ কেউ অকৃতকার্যদের পাশেও শান্তনাসূচক বাণী লিখে চলছেন। হঠাৎ মনে পড়লো সুব্রতর কথা। ছেলেটি কী মা বাবার আশার ফসল গোলায় তুলতে পেরেছে।
তাঁকে তো অনেক কিছু করতে হবে। সে কী করেছে।
তাকে দামী কলেজে ভর্তি করা হয়েছিলো একটি চমক দিবে বলে কিন্তু সে চমক কি দিতে পেরেছে।
সবার আইডিতে মিষ্টি উঠানামা করছে কিন্তু হঠাৎ তার একটা শেষ ছবি নজরে এলো, ছবিটি চশমা পরিহিত, বেশ! সাজানো গোছানো কিন্তু মাথা নিচু কেন? সে কী কিছু ভাবছে, হয়তো বলছে আমি মাথা উঁচু করবো কী করে। আমার কাছে যা চাওয়া হচ্ছে তা কি দিতে পারবো, হয়তো না। নিচুই থাকি আমি মাটি দেখি, এই মাটিই আমার মমতাময়ী। তাঁর আঁচলে আমি, পৃথিবীর মায়ার চেয়েও সে আমার আপন সে আমাকে কখনো মারবে না, পড়া না পারলে বা রেজাল্ট খারাপ করলেও কিচ্ছু বলবে না কিন্তু যাদের কষ্টের টাকায় বড় হয়েছি তাঁদের কষ্ট লাগে বলেই তারা তো কিছু বলবেই। কষ্ট না লাগবেই বা কেন কে না চায় তার ছেলে মেয়ে ভালো ফলাফল করুক জীবনে অনেক বড় হউক তাতে বাবা মায়ের তেমন কিছু হয় না শুধু চোখে মুখে একটু শান্তির ছায়া নেমে আসে।
আমার হাতটা তখন মোবাইলে বাটনকে গিলে খাচ্ছে। এই মুহুত্বেই কি একটা দৃশ্য দেখেই হাতটা আবার কেঁপে উঠলো… একটা শব্দ
বন্ধু এ তুই কী করলি জীবনের চেয়ে কী রেজাল্ট বড়। তার নিচে ট্রেনে কাটা একটা লাশ!
হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে গেলো। চিৎকার দিয়ে উঠলাম… এ কী… এ কী… এটা কী করে সম্ভব।
একের পর পোস্ট, বন্ধু, অনুজ, আত্মজ,ছেলে এ তুমি কী করলে… হতবাক হয়ে গেলাম।
আমি ঠিক থাকতে পারলাম না। একটা পোস্ট দিয়ে লিখলাম
জীবনের চেয়ে কি ফলাফল বড়, তোমার সম্ভাবনার ছিলো তুমি পরেও তো ভালো কিছু করতে পারতে। সুব্রত তুমি এটা করতে পারো না। পোষ্টের পরেই হাজারো লাইক কমেন্ট পড়তে শুরু করলো। নানাজনের নানান প্রশ্ন, এবার সাংবাদিকদের প্রশ্ন, খুঁতানো প্রশ্ন, কিছুটা অসস্থিবোধ করলাম কিন্তু উত্তরটাতো দেওয়া জরুরী না হলে জনমনে প্রশ্ন থেকে যাবে। প্রশ্ন করবেই না কেন এটাতো তাদের পেশাগত আচরণ। সত্যকে সামনে নিয়ে আসতে হলে এটা না করে উপায় নেই।
যতটুকু জানি ততটুকুই বললাম তবুও প্রশ্ন রয়ে গেলো। মেসেঞ্জার কট কট করে উঠলো দেখি পরিচিত সংবাদ কর্মী। বাড়ির ঠিকানা দিলাম তারপর কি হলো আর জানা গেলো না। তারপর আবার প্রশ্ন ভাই ছেলেটার বাড়ি কোথায় ? কিভাবে এমন হলো ? থমকে গেলাম! রেহাই নেই, সে চলে গেলো, শিরোনাম হলো কাগজে কাগজে। বাবা মা হয়তো এখনো স্বাভাবিক হতে পারছেন না স্বপ্নও পিছু ছাড়ছে না।
শেষ… শেষ… দুটো ছবি ফেইজবুকে ভাসতে শুরু করলো আচমকা গরমের পরে জল গড়াতে লাগলো। সে জলে বন্ধুরা সাতার কাঁটছে আর কি যেন বক বক করে বলেই চলছে…।
লিখেছেন : শাহমুব জুয়েল
২০ জুন ২০১৯