চাঁদপুর

চাঁদপুরের কৃতি সন্তান অতিরিক্ত আইজিপি রৌশন আরার বর্ণাঢ্য জীবনের গল্প

চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার কৃতি সন্তান, দেশের প্রথম সাবেক নারী পুলিশ সুপার ও বাংলাদেশ পুলিশ ষ্টাফ কলেজের রেক্টর বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি রৌশন আরা বেগম, পিপিএম গত সোমবার (৫ মে) স্থানীয় সময় সন্ধা সাড়ে ৬টায় কঙ্গো মিশন পরিদর্শনকালে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন (ইন্না…….রাজিউন)।

রৌশনআরা চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলার রায়শ্রী উত্তর ইউনিয়নের চন্ডিপুর গ্রামের শেখ বাড়ির কৃতি সন্তান। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ সেলিম পাটওয়ারী (লিটন) চাঁদপুর টাইমসকে নিশ্চিত করে জানান, তাঁর পিতা মাতা বা পরিবারের কেউ গ্রামের বাড়িতে থাকেন না ঢাকায় থাকেন। তবে তাঁর আত্মীয়-স্বজন অনেকেই গ্রামের বাড়িতে বসবাস করেন।

তিনি মরহুম ইসমাইল হোসেন ও আমেনা বেগম দম্পতির ঘর আলোকিত করে ১৯৬২ সালের পহেলা জানুয়ারী জন্মগ্রহণ করেন। তিন ভাই ও দুই বোনের সংসারে ভাই একেএম মোশারফ হোসেন আইটি বিশেষজ্ঞ হিসেবে সৌদি আরব ও কানাডাতে শিক্ষকতা করেছেন।

বোন হোসনে আরা রেখা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা। ভাই শেখ মো. মোয়াজ্জেম হোসেন, চীফ মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। আরেক ভাই মো. মোজাফফর হোসেন, তিনি সিনিয়র অফিসার, প্লানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট, ডেফোডিল ইউনিভার্সিটি, ঢাকায় কর্মরত ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত, স্বামী মো. শফিকুল আলম চৌধুরী একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। কন্যা আর মুনাহা চৌধুরী ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক্স প্রকৌশল এ স্নাতক শিক্ষার্থী। রৌশন আরা বেগমের শ্বশুর মরহুম নুরুল্লা চৌধুরী মহাখালী কলেরা হাসপাতালের প্রাক্তন চিফ মাইক্রো বায়োলজিস্ট ছিলেন ও শাশুড়ি মরহুমা বাজেগা বেগম গৃহিণী ছিলেন।

শিক্ষাজীবনে তিনি রাজধানী ঢাকার মগবাজারস্থ সাবেক টিএন্ডটি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ভিকারুননিসা নুন স্কুল এন্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে বিএসএস (অনার্স), এমএসএস ডিগ্রি কৃতিত্বের সাথে অর্জন করেন।

পেশাগত জীবনে রৌশন আরা বেগম বি.সি.এস ৭ম ব্যাচে ১৯৮৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ক্যাডারে যোগদান করেন। বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমী, সারদা, রাজশাহী হতে মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষে তিনি ঢাকায় শিক্ষানবিস সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এরপর রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমি, নারায়ণগঞ্জ জেলা ও সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসেবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)তে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৪ সালে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে কক্সবাজার জেলায় দায়িত্ব পালন করেন ও একই পদে টাঙ্গাইল, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন।

তিনি বাংলাদেশ পুলিশের প্রথম নারী পুলিশ সুপার হিসেবে ১৯৯৮ সালের ৩ ডিসেম্বর পদোন্নতি পেয়ে মুন্সিগঞ্জে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। এরপর এনবিআর, ঢাকায় উপ-পরিচালক, রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার, স্পেশাল ব্রাঞ্চ(এসবি) ঢাকায় বিশেষ পুলিশ সুপার, কেএমপি, খুলনার অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ও ভারপ্রাপ্ত কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ২০০৭ সালের ১২ ডিসেম্বর থেকে ২০০৮ সালের ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

পরে ঢাকায় ডিটিএস, সিআইডি’র কমান্ড্যান্ট (এডিশনাল ডিআইজি), স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন এন্ড ইন্টেলিজেন্স, সিআইডি ঢাকায় ডিআইজি (চলতি দায়িত্বে) ও ২০১৩-২০১৪ সালে ডিআইজি হিসেবে ফরেনসিক, সিআইডি ঢাকায় কর্মরত ছিলেন। তিনি ২০১৮ সালের ০৬ নভেম্বর অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে পদোন্নতি পান। বর্তমানে তিনি রেক্টর (অতিরিক্ত আইজিপি) হিসেবে পুলিশ স্টাফ কলেজে কর্মরত ছিলেন।

স্বনামধন্য এই পুলিশ কর্মকর্তা দেশের বাইরে যুক্তরাজ্যের পুলিশ স্টাফ কলেজ ব্রামশিল থেকে স্ট্রাটেজিকপ্লানিং কোর্স এবং লীডারশিপ কোর্স ফর ফিমেললিডার’স ইন ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি কোর্সে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব উইমেন পুলিশ (ওঅডচং) (রিজিওন-১৬) সেকেন্ড এর ৫০তম বার্ষিক ট্রেনিং কনফারেন্স, নিউফাউন্ডল্যান্ড, কানাডা, ৫১তম বার্ষিক ট্রেনিং কনফারেন্স, ডারবান, সাউথ আফ্রিকা এবং (ওঅডচং) (রিজিওন-১৬) সেকেন্ড রিজিওনাল কনফারেন্স, আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাতে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ২০১৫ সালে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ বাংলাদেশ থেকে ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স (এনডিসি) সম্পন্ন করেন।

২০১৩ সালে ওঅডচঙং কর্তৃক ইন্টারন্যাশনাল স্কলারশিপ এওয়ার্ডে ভূষিত হন। উল্লেখ্য যে তিনি জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশন (কসোভো) ২০০২ সালের ১৬ জুলাই থেকে ২০০৩ সালের ১৫ জুলাই পর্যন্ত ক্রাইম এনালাইসিস অফিসার ও ২০০৮ সালের ৩০ এপ্রিল জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন (সুদান) ইউএন পুলিশের চিফ অফ স্টাফ হিসেবে ২০০৯ সালের ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন।

বাংলাদেশে পুলিশ বাহিনীতে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দুবার আইজিপি ব্যাচপ্রাপ্ত হন এবং বাংলাদেশ সরকারের ২য় সর্বোচ্চ পুলিশ পদক ‘পিপিএম’- লাভ করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি মুন্সিগঞ্জের পুলিশ সুপার থাকাকালীন ‘অনন্যা শীর্ষ দশ-১৯৯৮’ পুরস্কার ও ২০১২ সালে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব উইমেন পুলিশের স্কলারশিপ অ্যাওয়ার্ড -২০১২ লাভ করেন। বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্কের সভাপতি হিসেবে তিনি ২০১১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্কের বাংলাদেশ পুলিশের ফোকালপয়েন্ট এবং নেটওয়ার্কের কার্যকরী কমিটির যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

গত ৩ মে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন কার্যক্রম পরিদর্শন এবং মেডেল প্যারেডে অংশ নিতে কঙ্গো যান তিনি। সেখানে সরকারী দায়িত্ব পালনকালে ৫ মে স্থানীয় সময় সন্ধা সাড়ে ৬ টায় কঙ্গোর রাজধানী কিনশাসায় তাঁকে বহনকারী গাড়িটিকে একটি লরি ধাক্কা দিলে জনাব রৌশন আরা বেগম ঘটনাস্থলে নিহত হন।

মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৭ বছর। গাড়ির অপর আরোহী ব্যানএফপিইড-১ এর কমান্ডার (পুলিশ সুপার) ফারজানা ইসলাম গুরুতর আহত অবস্থায় আইসিইউতে চিকিৎসাধীন এবং গাড়ির চালক আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আছেন। অতিরিক্ত আইজিপি জনাব রৌশন আরা বেগম, পিপিএম, এনডিসি এর মর্মান্তিক মৃত্যুতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও আইজিপি পৃথক শোক বার্তা প্রদান করেছেন।

এছাড়াও চাঁদপুরের আরেক কৃতি সন্তান ও বাংলাদেশ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটওয়ারী, বিপিএম (বার) সড়ক দৃর্ঘটনায় নিহত অতিরিক্ত আইজিপি রৌশন আরা বেগমের মর্মান্তিক মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবাবরের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।

বার্তা কক্ষ
৮ মে ২০১৯

Share