সাংবাদিকতার ২২ বছর
(পূর্ব প্রকাশের পর)
দীর্ঘ সময়ের সাংবাদিকতায় অসংখ্য সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে আমার। আবার অনেক ঘটনা প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি নানা কারণে। এসব সংবাদ ও ঘটনা সংগ্রহের পেছনে ছিল আরো অনেক ঘটনা, স্মৃতি। যার সব প্রকাশ করার সুযোগ এই লেখায় নেই। উল্লেখযোগ্য কিছু খবরের পেছনের কথা স্মৃতিচারণ করছি।
২০০৩ সালের শেষ দিকের কথা। সারাদেশে তখন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগাম হাওয়া বইছে। কবে নাগাদ নির্বাচন হবে- এ নিয়ে জনমনে আগ্রহের শেষ নেই। কিন্তু নির্দিষ্ট দিন-তারিখ নিয়ে কমিশন কোনো তথ্য জানায়নি তখন পর্যন্ত। বিএনপি তখন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে, দাবি আদায় না হলে নির্বাচন বর্জনের হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে তারা। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন আদৌ হবে কিনা এবং হলে কবে নাগাদ হবে- এই প্রশ্ন সারাদেশের মানুষের মুখে মুখে।
রাজনীতির সেই গুমোট সময়ে ২২ নভেম্বর পারিবারিক কর্মসূচিতে চাঁদপুর এলেন নির্বাচন কমিশনার শাহ নেওয়াজ। ওইদিন সকালে চাঁদপুর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মরহুম লুৎফুর রহমান পাটওয়ারীর কুলখানি অনুষ্ঠানে যোগ দেন কমিশনার শাহ নেওয়াজ। সম্পর্কে তারা ছিলেন মামা-ভাগ্নে। মিলাদ ও গণভোজে অংশ নিয়ে লুৎফুর রহমান পাটওয়ারী বাড়ির সামনে
আত্মীয়স্বজনদের সাথে কথা বলছিলেন শাহ নেওয়াজ। এসময় তার সাথে আমার দেখা। তার সাথে আমার সখ্য অনেক দিনের। সালাম ও কুশল বিনিময়ের পর বললাম- ‘মামা ঢাকার সাংবাদিকদের তো কতো তথ্য দেন, অনেককেই তো বিখ্যাত করলেন। আমাদের কিছু তথ্য দিবেন না?’ নিছক রসিকতার ছলে সম্পর্কের আবদারে কথাটি বললাম। তিনিও তাৎক্ষণিক জবাব দিলেন- ‘আচ্ছা মামা, বিকেলে জায়গা মতো চলে আইসেন। একটা তথ্য দিবো।’ তখনও বুঝিনি সারাদেশের মানুষের অতি আগ্রহের মহাগুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
বিকেল ৩টার দিকে শহরের মিশন রোডে জেলা আওয়ামী লীগ নেতা আলহাজ ওচমান গনি পাটওয়ারীর ব্যক্তিগত অফিসে হাজির আমরা কয়েকজন সাংবাদিক। আমাদের আগেই সেখানে এসেছিলেন নির্বাচন কমিশনার শাহ নেওয়াজ। আমরা ৭-৮জন সাংবাদিক সেখানে উপস্থিত। সবাই টেলিভিশন সাংবাদিক। কমিশনার শাহ নেওয়াজ বললেন, ‘কি জানতে চান বলেন।’ আমরা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন করলাম।
এর মধ্যে নির্বাচনের দিনক্ষণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জবাব দিলেন, ‘২৫ নভেম্বরের মধ্যে তফসিল ঘোষণা করা হবে। ২০১৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন।’ আমরা বললাম- ‘নির্বাচনের তারিখ বলুন’। তিনি বললেন, ‘ঘোষণার আগে সুনির্দিষ্টভাবে বলা ঠিক হবে না। কারণ, কোনো কারণে পরিবর্তন হতেও তো পারে।’ আমরা তবুও জানতে চাইলাম, ‘জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের কোন তারিখে নির্বাচন হবে।’ আমাদের অবিরাম আবদারে কিছুটা কৌশল করে তিনি বললেন, ‘….৫, ৬, ৭ জানুয়ারি হতে পারে।’
এই তথ্য তখন সারাদেশের মানুষের জানা ছিল না। আমাদের আর ঠেকায় কে! সেখানে বসেই বাংলাভিশনের বার্তা বিভাগে ফোন করে বললাম, ‘একটা ব্রেকিং নিউজ আছে, লিখেন। ২৫ নভেম্বরের মধ্যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন : চাঁদপুরে সাংবাদিকদের জানালেন নির্বাচন কমিশনার শাহ নেওয়াজ।’
আমার সহকর্মীরাও নিজ নিজ টেলিভিশন ও পত্রিকা অফিসে ফোন করে জানালেন এই অতিগুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি। যেই কথা সেই কাজ, সত্যি সত্যি বাংলাভিশনসহ অন্যান্য টেলিভিশিন মিডিয়া ব্রেকিং নিউজ হিসেবে প্রচার করতে শুরু করলো এই তথ্যটি। এবার আমাদের সাথে না থাকা সহকর্মীদেরও তথ্যটি জানালাম এবং ফুটেজ নেওয়ার জন্য মিশন রোডে আসতে বললাম। মুহূর্তেই গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়লো সেই খবর। টেলিভিশন মিডিয়ার কল্যাণে ছড়িয়ে পড়লে সারা বিশ্বে। আমাদের আর বুঝার বাকী রইলো না তিনি আমাদের কি তথ্য জানাতে এখানে আসতে বলেছিলেন। পরদিন স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে অতিগুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হলো সেই সংবাদ।
নিউজ পাঠিয়ে সেখানে বসা অবস্থাতেই নির্বাচন কমিশনার শাহ নেওয়াজের কাছে ঢাকার সাংবাদিকদের অবিরাম ফোন আসতে শুরু করলো। তারা সবাই মূলত নির্বাচন কমিশনে বিট করা সাংবাদিক। প্রথমে তারা জানতে চাইলেন তথ্যটি সঠিক কিনা। তথ্য সঠিক জানার পর তাদের অনুযোগ ছিল কেন তাদের না জানিয়ে চাঁদপুরের সাংবাদিকদের এমন একটি ব্রেকিং নিউজ জানানো হলো।
শুনেছি পরবর্তীতে ঢাকা যেয়ে ঢাকার সাংবাদিক ও নির্বাচন কমিশনেও এ জন্য প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন তিনি। এর জবাব দিয়েছিলেন তিনি বুদ্ধিমত্তা দিয়ে। বলেছিলেন, ‘আমি তো শুধু ঢাকার নির্বাচন কমিশনার নই। সারাদেশের নির্বাচন কমিশনার। সুতরাং প্রকাশযোগ্য যে কোনো তথ্য দেশের যে কোনো জায়গায় তো প্রকাশ করতেই পারি।’ অনেক পরে তার কাছ থেকেই এই তথ্যটি জেনেছিলাম।
আমার পুরো সাংবাদিকতার জীবনে এটি একটি শ্রেষ্ঠতম ঘটনা। চাঁদপুর বসে সারাদেশের জন্য এমন ব্রেকিং নিউজ তৈরী/প্রচারের সুযোগ খুব কম’ই আসে। কোনো কোনো সাংবাদিকের ক্ষেত্রে সারা জীবনেও আসে না। যদিও এমন তথ্য উদ্ধারে সত্যিকারার্থে কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছিল না আমার/আমাদের। পুরোটাই ছিল সুসম্পর্ক আর সময় মতো সময় উপযোগী কৌতুহলের ফসল।
এবার অন্য একটি ঘটনায় আসি। প্রায় এক যুগ আগের কথা। আমার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী আল-ইমরান শোভন তখন প্রথম আলোর কন্ট্রিবিউটর হিসেবে হাইমচর উপজেলায় কাজ করেন। প্রথম আলো থেকে তাকে এসাইনমেন্ট দেয়া হলো ঈদুল আযহা উপলক্ষে একটি বিশেষ নিউজ করার জন্য। যা ইতোপূর্বে কেউ কখনো করেনি। শোভন বিষয়টি নিয়ে আমার সাথে আলাপ করলেন এবং আইডিয়া চাইলেন।
আমি সময় নিলাম এবং অনেক চিন্তা-ভাবনা করে তাকে বললাম চাঁদপুর প্রবাহের হাইমচর প্রতিনিধি খোরশেদ আলমের মাধ্যমে খোঁজ নিতে যে, হাইমচরের এমন কোনো চর আছে কিনা যেখানে এখনো কোনো পশু কোরবানী দেওয়া হয়নি। সাবজেক্টটি শোভনও পছন্দ করলেন। শোভন আর খোরশেদ ব্যাপক অনুসন্ধান করে এমন একটি চরের সন্ধান পেলেন। নাম মাঝেরচর। এবার তারা দু’জন সরাসরি সেই চরে গেলেন এবং বিষয়টি নিশ্চিতও হলেন।
এলাকার জনগণ, জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সাথে তারা কথা বলে একটি রিপোর্ট করলেন। রিপোর্টটি প্রথমে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাতায় প্রকাশিত হলো গুরুত্ব দিয়ে। এরপর দৈনিক চাঁদপুর প্রবাহ ও দৈনিক ইনকিলাবেও নিউজটি কিছুটা সংশোধন আকারে প্রকাশিত হলো।
ওই নিউজের ফলশ্রুতিতে সেবছর হাইমচর উপজেলা প্রশাসন ও ঢাকার একটি এনজিও সেখানে প্রথমবারের মতো গরু কোরবানীর ব্যবস্থা করলেন। চরের গরীব অসহায় মানুষ ঈদের দিনে তৃপ্তি নিয়ে গরুর গোশত খেতে পারলেন। এখানে আমার ভূমিকা অতি সামান্য হলেও আমার আইডিয়া আর শোভন ও খোরশেদের সংবাদে অসহায় মানুষগুলোর ঈদের দিনে গরুর গোশতের ব্যবস্থা হওয়ায় বেশ আত্মতৃপ্তি পেয়েছিলাম।
২০০৪ সালের একটি ঘটনাও আমার স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে আছে। সারাদেশে তখন ভয়াবহ বন্যা চলছিল। আমাদের পাশের গ্রাম আমানউল্যাপুরে এক বৃদ্ধ মারা গেছেন। পানিতে তাদের কবরস্থান ডুবে আছে, উঠানেও বন্যার পানি থৈ থৈ করছে। মৃতদেহের খাটিয়া ভেলায় ভাসিয়ে রাখা হয়েছে। এলাকার মানুষের কাছ থেকে খবর পেয়ে বিষয়টি চাঁদপুর প্রবাহের তৎকালীন সম্পাদক মাকসুদ ভাইকে জানালাম। তিনি আমাকে ও আলোকচিত্র সাংবাদিক চৌধুরী ইয়াছিন ইকরামকে ঘটনাস্থলে পাঠালেন। তৎকালীন গণপরিবহন বেবিট্যাক্সিতে করে আমরা যেয়ে নামলাম মতলব রোডের দিঘিরপাড় এলাকায়।
এবার ঘটনাস্থল হাজি বাড়িতে যাওয়ার জন্য কাঁচা রাস্তায় পা রাখলাম। পুরো রাস্তা পানিতে ডুবে আছে। কোনো নৌযান না পেয়ে পানি ডিঙ্গিয়ে হাটতে লাগলাম। রাস্তার কোথাও হাঁটুপানি আবার কোথাও কোমড়পানি। মাঝবরাবর যেয়ে হঠাৎ আমি আর ইয়াছিন রাস্তার এক গর্তে পড়ে গেলাম। মাথা বাদে সারা শরীর ও শার্ট-পেন্ট ভিজে গেল। ইয়াছিনের ইয়াসিকা ব্র্যান্ডের ক্যামেরাটি আগে থেকে পলিথিনে পেঁচিয়ে রাখায় সেটি পানি থেকে রক্ষা পায়।
মাত্র ১০ মিনিট হাটার রাস্তা পেরুতে আমাদের প্রায় এক ঘন্টা লেগেছিল। গিয়ে দেখি এক অবর্ণনীয়-অকল্পনীয় করুণ দৃশ্য। মৃত ব্যক্তির ঘরে গাদাগাদি করে অবস্থান করছে বিপুল সংখ্যক আত্মীয়স্বজন। এদের অধিকাংশই মহিলা। পানিতে নিমজ্জিত উঠানেও প্রচুর মানুষ দাঁড়িয়ে আছে অসহায়ভাবে। কলাগাছের তৈরী একটি ভেলার উপর ভাসিয়ে রাখা হয়েছে খাটিয়া। তার ওপর মৃতদেহ।
খোঁজ নিয়ে দেখি বাড়ির পাশের রাস্তার কিছুটা উচু অংশে মাটি ফেলা হচ্ছে। বিভিন্ন বাড়ির রান্নাঘর ও উচু ভিটা কেটে আনা হচ্ছে মাটি। সেখানে তৈরী করা হচ্ছে কবর। চৌধুরী ইয়াছিন ইকরাম বন্যার পানিতে লাশের খাটিয়া ভেসে থাকার দৃশ্য তুলতে তুলতে ক্যামেরার ফিল্ম শেষ করে ফেলেছেন প্রায়।
তখন অবশ্য গুনে গুনে ম্যানুয়েলি ফিল্মের আনুমানিক হিসাব রাখা হতো। দৃশ্যের গুরুত্ব অনুভব করে আমি নিজেও কয়েক দফা ইয়াছিনের কাছ থেকে ক্যামেরা হাতে নিয়ে কয়েকবার ক্লিক করলাম। ফিরে এলাম অফিসে। আমার লেখা নিউজটি পরদিন চাঁদপুর প্রবাহে লিড হলো ‘মৃত্যুশোককেও ম্লান করে দিল…’ শিরোনামে। কিন্তু আমাদের হতাশ করলো ইয়াছিনের ক্যামেরা। অফিসে এসে ডার্করুমে ক্যামেরা খুলে দেখা গেল একটিও ছবি ফিল্মে জমা হয়নি। কারণ, ফিল্মটি ক্যামেরার সাথে ঠিকভাবে আটকানো ছিল না। ফলে একটি ছবিও পেলাম না।
ইয়াছিন ইকরামও সম্ভবত তার জীবনের শ্রেষ্ঠ ছবিটি পত্রিকায় প্রকাশ থেকে বঞ্চিত হলেন। ছবিনির্ভর ওই নিউজটির আবেদন অনেকটাই ম্লান হয়ে গেল দুর্লভ ছবির অনুপস্থিতিতে। যদিও ছবিবিহীন সেই নিউজটি পরের বছর চাঁদপুর প্রবাহ আয়োজিত স্থানীয় সাংবাদিকদের সংবাদ প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ মনোনীত হয়েছিল, আমি পেয়েছিলাম পুরস্কার।
চাঁদপুর প্রবাহ সেই প্রতিযোগিতা আয়োজন করলেও এর বিচারক ছিলেন চাঁদপুরের সিনিয়র সাংবাদিক ও সহযোগী দৈনিকের সম্পাদকগণ। (চলবে)