চাঁদপুরে কৃষক প্রিয় একটি ফসরের নাম মিষ্টি আলু। কৃষিবিদদের মতে,প্রচুর গুণাগুণ সমৃদ্ধ মিষ্টি আলুকে আমাদের দেশে‘গরীবের খাদ্য’বলা হয়। মিষ্টি আলু ভাতের বিকল্প ও সুস্বাদু। মিষ্টি আলু রাঙ্গা আলু নামেও পরিচিত।বেগুনী,লাল,হালকা হলুদ অথবা সাদা রঙের হয় মিষ্টি আলু। মিষ্টি আলুর বৈজ্ঞানিক নাম ‘ওঢ়ড়সড়বধ ইধঃধঃধং’।
চলতি বছর চাঁদপুরে মিষ্টি আলুর চাষাবাদ ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। জেলার সকল উপজেলায় ৩৮০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৭ হাজার ৯১ মে.টন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামার বাড়ি চাঁদপুরের ২০১৮-২০১৯ রবি মৌসুমের আওতায় চাষাবাদ ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার বার্ষিক রির্পোট মতে এ তথ্য জানা গেছে।
চাঁদপুর দেশের অন্যতম নদীবিধৌত কৃষি প্রধান অঞ্চল। মেঘনা,পদ্মা, মেঘনা ধনাগোদা ও ডাকাতিয়া নদী এ জেলা ওপর দিয়ে বয়ে যাওযায় কৃষি উৎপাদনে নদী অববাহিকায় ব্যাপক ফসল উৎপাদন হয়ে থাকে। এর বাজার মূল্যও তুলনামূলকভাবে খারাপ নয়। বর্তমানে প্রতি কেজি আলুর খুরচা মূল্য ২০ টাকা। এ বছর চাঁদপুরে ৭ হাজার ৯১ মে.টন মিষ্টি আলুর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৩ শ’৮০ হেক্টর জমিতে। চাঁদপুরের কৃষকগণ সাধারণত:মিষ্টি আলু চাষ করে থাকে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামার বাড়ি চাঁদপুরের সূত্র মতে, চাঁদপুর সদরে ১৩০ হেক্টরে উৎপাদন ২ হাজার ৪শ’২৬ মে.টন,মতলব উত্তরে৮০হেক্টরে উৎপাদন ১ হাজার ৪শ’৯৩ মে.টন,
মতলব দক্ষিণে ৩০ হেক্টরে উৎপাদন ৫শ’৬০মে.টন,হাজীগঞ্জে ২০হেক্টরে উৎপাদন ৩শ’৭৩ মে.টন,শাহরাস্তিতে ৩০ হেক্টরে উৎপাদন ৫শ’৬০ মে.টন,ফরিদগঞ্জে ২৫ হেক্টরে উৎপাদন ৪শ৬৬ মে.টন এবং হাইমচরে ৬৫হেক্টরে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ১শ’১৩ মে.টন।
মিষ্টি আলু কম খরচে ও সহজেই চাষাবাদ করা সম্ভব। অল্প সময়ে ফসল ঘরে তোলা সম্ভব। চর এলাকায় এর ব্যাপক চাষাবাদ হয়ে থাকে। বেলে মাটি,আদ্র ও নদীতীরবর্তী এলাকায় মিষ্টি আলু চাষাবাদ উপযোগী। সার ও পানি সেচ ব্যতীত এর চাষাবাদ সম্ভব। তাই চাঁদপুরের চরাঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া মিষ্টি আলু চাষের উপযোগী বলে কৃষিবিদরা জানান।
চিকিৎসকদের মতে, মিষ্টি আলুতে ভিটামিন ও খনিজ উপাদান থাকে। দ্রুত শক্তি প্রদান করতে পারে মিষ্টি আলু। গোল আলুর মত মিষ্টি আলুতেও প্রদাহরোধী উপাদান থাকে। বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন সি এবং ম্যাগনেসিয়ামের উপস্থিতির কারণেই সম্ভবত মিষ্টি আলুর প্রদাহরোধী ভূমিকা দেখা যায়। অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক উভয় ধরণের প্রদাহ কমাতেই অত্যন্ত কার্যকরী মিষ্টি আলু। এতে ভিটামিন এ ও খনিজ রয়েছে। যা ভাতে নেই। প্রেটিন,কার্বোহাইড্রেট,ক্যালসিয়াম, লৌহ, ভিটামিন বি মানুষের দেহে প্রয়োজন। মিষ্টি আলু খেলে এর চাহিদা পুরণ হবে।
মিষ্টি আলু খেলে ফুসফুস,শ্বাসনালী এবং নাকের জমাটবদ্ধতা নিরাময়ে সাহায্য করে।ফলে অ্যাজমার উপশম হয়। আয়রন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান ব্রংকাইটিস নিরাময়ে সাহায্য করে। মিষ্টি আলু শরীরকে উষ্ণ হতে সাহায্য করে। সম্ভবত এর মিষ্টত্ব এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান শরীরের তাপমাত্রার ওপর প্রভাব ফেলে। বিটা ক্যারোটিন,জিংক,ম্যাগনেসিয়াম এবং ভিটামিন বি-কমপেক্স এর উপস্থিতির কারণে মিষ্টি আলু আরথ্রাইটিস মোকাবেলায় কার্যকরি ভূমিকা রাখে। মিষ্টি আলু সিদ্ধ করা পানি অস্থিসন্ধিতে বাহ্যিকভাবে ব্যবহার করলে আরথ্রাইটিসের ব্যথা কমে।
সাধারণ আলুর চেয়ে মিষ্টি আলুতে ফাইবারের পরিমাণ বেশি থাকে এবং স্বাদেও ভালো। এতে ম্যাগনেসিয়াম নামক খনিজ উপাদানটিও থাকে বলে মিষ্টি আলু হজম সহায়ক একটি খাবার। বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সার নিরাময়ে বিটা ক্যারোটিন এবং ভিটামিন সি অত্যন্ত কার্যকরি যা মিষ্টি আলুতে থাকে।পাকস্থলী ও অন্ত্রে শীতলীকারক প্রভাব ফেলতে পারে মিষ্টি আলু। ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স, পটাসিয়াম এবং ক্যালসিয়াম পাকস্থলীর আলসার নিরাময়ে সাহায্য করে। মিষ্টি আলুর আঁশ কোষ্ঠকাঠিন্য এবং এসিড তৈরি হওয়ার সমস্যা প্রতিরোধে সাহায্য করে।
মিষ্টি আলু ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ও উপকারী,যা সাধারণ বিশ্বাসের বিপরীত একটি বিষয়! আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, মিষ্টি আলু ইনসুলিনের নি:সরণ ঠিকমত হতে সাহায্য করার মাধ্যমে রক্তের চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে কার্যকরি ভূমিকা রাখে। এর অর্থ এ নয় যে, ডায়াবেটিকে আক্রান্তরা ইচ্ছেমত খেতে পারেন মিষ্টি আলু। ভাত অথবা অন্য শর্করা জাতীয় খাবারের পরিবর্তে মিষ্টি আলু খেতে পারেন। মিষ্টি আলুর আঁশ শরীরে পানি ধরে রাখতে সাহায্য করে। এটি শরীরের পানির ভারসাম্য রক্ষা করে,হাইড্রেটেড রাখে এবং কোষের দক্ষতা বৃদ্ধি করে।
মিষ্টি আলুতে জটিল স্টার্চ,ভিটামিন,খনিজ এবং কিছু আমিষ ও থাকে। মিষ্টি আলু খুব সহজেই হজম হয়ে যায় এবং প্রচুর শক্তি প্রদান করতে পারে। যারা ওজন বৃদ্ধি করতে চান তারা নিশ্চিন্তে মিষ্টি আলু খেতে পারেন। কারণ এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
প্রসঙ্গত, মিষ্টি আলু একটি পুষ্টিকর ও সুস্বাদু খাদ্য। ভাতের বিকল্প বা পরিপূরক খাদ্য হিসেবে মিষ্টি আলু আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবহার হয়ে আসছে।এটি একটি শ্বেতসার প্রধান খাদ্য। মিষ্টি আলু অন্যান্য সবজির সাথে তরকারি হিসেবেও খাওয়া যায়।এটি পুড়িয়ে বা সিদ্ধ করে ভাতের পরিপূরক বা সকালের অন্যান্য নাস্তার বিকল্প হিসেবে খাওয়া যায়।
সকালে মক্তবগামী শিশুদের সকাল বেলার প্রিয় একটি খাবার এ আলু। আমাদের দেশে যাদের রয়স এখন ষাটর্ধ্বো তাদের ছোট বয়সের স্মৃতিতে গাঁথা হয়তোবা আছে মিষ্টি আলু খাওয়ার। যার ফলেই আমাদের দেশের প্রধান খাদ্য চাল ও গমের বিকল্প হিসেবে মিষ্টি আলু খাওয়া যায়।এর মধ্যে পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ সিদ্ধ চালের প্রায় কাছাকাছি।
মিষ্টি আলুতে ভিটামিন সি রয়েছে যা চাল কিংবা গমে নেই। মিষ্টি আলু এতসব গুণাগুণের অধিকারী হয়েও আমাদের দেশে মিষ্টি আলুকে‘গরীবের খাদ্য’বলা হয়। অথচ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় খাদ্য হিসেবে বিবেচিত। চীন,পাপুয়া গিনি ও ফিলিপাইনের অনেক জায়গায় এটি মানুষের প্রধান বা অন্যতম খাদ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মত উন্নত দেশে মিষ্টি আলু খাদ্য হিসেবে বহুল পরিচিত।
চাঁদপুরে চাষিদের ঋণ সহায়তা দিলে চরাঞ্চলগুলোতে মিষ্টি আলুর চাষ সম্ভব। সাধারণ মানুষের ভেতর এর চাহিদা রয়েছে। মতলবের চরইলিয়ট, চর কাসিম, ষষ্ট খন্ড বোরোচর, বোরোচর, চাঁদপুর সদরের রাজরাজেস্বর, জাহাজমারা,লগ্মীমারা, বাঁশগাড়ি,চিড়ারচর,ফতেজংগপুর, হাইমচরের ঈশানবালা, চরগাজীপুর, মনিপুর, মধ্যচর,মাঝিরবাজার, সাহেববাজার ও বাবুরচর ইত্যাদি এলাকা গুলোতে এর চাষ করা ব্যাপক করা সম্ভব ।
এ দিকে চাঁদপুরে আবহাওয়ার অনুকূল পরিবেশ,পরিবহনে সুবিধা, কৃষি বিভাগের উৎপাদনের প্রযুক্তি প্রদান, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নত, কৃষিউপকরণ পেতে সহজলভ্যতা,কৃষিবিদদের পরামর্শ, ব্যাংক থেকে কৃষিঋণ প্রদান ইত্যাদি কারণে চাঁদপুরের চাষীরা ব্যাপক হারে কৃষিপণ্য উৎপাদন ও চাষাবাদ করতে পারে। বিশেষ করে চাঁদপুরের মতলবে ও হাইমচরের চাষীরা চরাঞ্চলে মিষ্টি আলুর উৎপাদন করে থাকে ।
আমাদের অধিকাংশ এলাকার মাটি ও আবহাওয়া মিষ্টি আলু উৎপাদনের উপযোগী। কাজেই খাদ্য ঘাটতি পূরণে, সুস্থ ও সবল স্বাস্থ্যগঠনে প্রতিদিন ভাতের চেয়ে বেশি মিষ্টি আলু খাওয়া উচিৎ।
প্রতিবেদক : আবদুল গনি
১৪ মে ২০১৯