মতলব উত্তর

মতলবে কালের বির্বতনে বিলুপ্তির পথে লাঙ্গল-জোঁয়াল-মই-হালের বলদ

“সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা,দেশ মাতারই মুক্তিকামী দেশের সে যে আশা” এমনটাই লিখেছিলেন রাজিয়া খাতুন চৌধুরাণী তার ‘চাষী’কবিতায় কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলায় এ ধরণের কবিতাগুলোর সাথে এর বাস্তবতার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। কৃষিভিক্তিক অঞ্চল এ মতলব। ধান,পাট,মরিচ,গম ভ’ট্টাসহ নানা ফসল উৎপাদন হয়ে মতলবে ।

আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতায় মতলব উত্তর-মতলব দক্ষিণ উপজেলার মানুষ এখন দিন দিন যন্ত্র নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ফলে যান্ত্রিক ত্রুটির সাথে সাথে জীবন যাত্রার ত্রুটিও বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন। কৃষি নির্ভরশীল এখানকার ৯০% মানুষই এক সময় কৃষি নির্ভরশীল ছিল।

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ,আমাদের জীবনে কৃষি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্র্ণ,কেননা কৃষি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানোর প্রায় সকল উপকরণ উৎপাদন ও সরবরাহ করে থাকে। কৃষি কাজ করার জন্য যেসব ধারণা,পদ্ধতি, যন্ত্র বা জিনিসপত্র ব্যবহার করা হয়,সেগুলোই হচ্ছে কৃষি প্রযুক্তি। কতগুলো প্রযুক্তি আছে প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আবার কতগুলো প্রযুক্তি আছে যা দশ বছর আগে ছিল-এখন তার স্থান দখল করে নিচ্ছে নতুন প্রযুক্তিগুলো।

প্রাচীনকালের লাঙ্গল,জোঁয়াল কৃষি যন্ত্র হলেও মতলব উত্তর ও মতলব দক্ষিণ উপজেলায় এর ব্যবহার নেই বললেই চলে। জমি চাষের কাজে এ উপজেলাসহ এর আশপাশের কৃষকেরা এক সময় কাঠের তৈরি লাঙ্গল, জোঁয়াল,মই ও হালের বলদ ব্যবহার করতো।

ফসলি জমিতে চাষাবাদের জন্যে এসব কৃষি উপকরণ হাজার হাজার বছর ধরে ব্যবহার করে এসেছে কৃষকরা। কিন্তু কালের বিবর্তনে মতলবে আজ এসব ঐতিহ্যবাহী জিনিস এর ব্যবহার প্রায় বিলুপ্তির পথে। পরিবেশ বান্ধব লাঙ্গল-জোঁয়ালের স্থান দখল করে নিয়েছে পরিবেশ ও শব্দ দূষণকারী আধুনিক প্রযুক্তির তৈরি যান্ত্রিক পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টর।

লাঙ্গল-জোয়াল ছাড়া চাষাবাদের কথা চিন্তাই করতে পারতো না মতলব উত্তর-,তলব দক্ষিণ উপজেলার কৃষকরা। কিন্তু আধুনিক যুগের সাথে তাল মেলাতে চাষাবাদের জন্য ট্রাক্টর,পাওয়ার টিলারের মতো যান্ত্রিক সব উপকরণ আবিস্কৃত হয়েছে।

কৃষক যেমনি উপকৃত হয়েছে তেমনি ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে। যন্ত্রপাতির ব্যবহারের ফলে পরিবেশ দূষণ,শব্দ দূষণ ও বেকারত্বের হার দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।

কৃষি শ্রমিকের চাহিদা কমিয়ে দিয়েছে যন্ত্রচালিত কৃষি উপকরণগুলো। আর এসব আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে চাষাবাদে আগের তুলনায় সময়, শ্রম এবং অর্থের সাশ্রয় হচ্ছে। ফলে কৃষক আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে চাষাবাদ করে জমিতে ফসল ফলাচ্ছে। এতে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী লাঙ্গল,জোঁয়াল,মই ও হালের বলদ। বর্তমানে মতলব উত্তর উপজেলার প্রায় সব কৃষকই জমি চাষের জন্য পাওয়ার টিলার তৈরি বা ট্রাক্টর ব্যবহার করে থাকে। লাঙ্গল-মই সহ কৃষি সরঞ্জাম তৈরি করা যাদের পেশা তারা এখন বেশির ভাগ সময় বেকার বসে থাকছেন।

এ পেশায় যারা জড়িত তাদের অনেকেই বাপ-দাদার এ আদি পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। আর যারা এখোনো কষ্ট করে এ পেশাকে আকড়ে ধরে রেখেছেন তারাও ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছেন। এভাবে হয়তো একদিন লাঙ্গল তৈরির পেশায় থাকা ব্যক্তিরা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে এ কাজকে পেশা হিসেবে নিতে আর আগ্রহ প্রকাশ করবে না।

নতুন পেশা খুঁজে নেবেন তারা। তখন হাজার বছরের পুরোনো লাঙ্গল-জোঁয়ালের স্থান হবে জাতীয় জাদুঘরে। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তা গল্প হয়ে থাকবে। থাকবে বই পুস্তকে। বাস্তবে চোখে দেখার সুযোগও পাবে না তারা। মানুষের সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে চির বিশ্রামে থাকবে এ লাঙ্গল-জোঁয়াল।

চাঁদপুরের মতলব উত্তর ও মতলব দক্ষিণ ও আশপাশের উপজেলাগুলোতে কম বেশি সব গ্রামেই দেখা যেতো লাঙ্গল,জোঁয়াল ও হালের বলদ কিন্তু এখন আর চোখে পড়ে না।

এ ব্যাপারে মতলব উত্তর উপজেলার ছেংগারচর পৌরসভার ঠাকুরচর গ্রামের কৃষক আ.সাত্তার ঢালী জানান,তার বাপ-দাদাদের স্মৃতি বিজড়িত লাঙ্গল,জোয়াল,মই এখন আর তেমন একটা কাজে আসে না। তিনি আরো বলেন এখন শুধুমাত্র বীজতলা তৈরি করার জন্যে লাঙ্গল- জোঁয়াল ব্যবহার করে থাকি।

আধুনিক সভ্যতা থেকে পরিবেশ বান্ধব লাঙ্গল-জোঁয়ালের জায়গা দখল করে নিয়েছে যান্ত্রিক পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টরসহ বেশ কিছু মেশিন। উপজেলার আদুরভিটি গ্রামের কৃষক মজনু মিয়া লস্কর বলেন, ‘আগে লাঙ্গল, জোয়াল, মই ও হালের বলদ দিয়ে জমি চাষাবাদ করে কৃষকেরা যে আনন্দ পেত এখন আর তা নেই। তবে বাপ-দাদার ঔ পুরোনো স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রাখার জন্যে এখনো বাড়িতে লাঙ্গল, জোয়াল, মই ও হালের বলদ রাখা হয়েছে এবং মাঝে মধ্যে ব্যবহার করি।

কৃষি কাজের সাথে জড়িত অনেকে বলেন উৎপাদিত কৃষি পণ্যের উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় কৃষকরা অনেকটা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে কৃষি কাজের প্রতি। জমিতে ভালো মানের বীজ কিংবা সার কীটনাশকের ব্যবহার কম হওয়াতে ফসলের উৎপাদনও কম হচ্ছে। জাতীয় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এখন প্রয়োজন দ্রুত কৃষিখাতে নজর দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া। অন্যথায় খুব শীঘ্রই মুখ থুবড়ে পড়বে চাঁদপুরের মতলব উত্তর-দক্ষিণ উপজেলার কৃষি শিল্প।

খান মোহাম্মদ কামাল, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯

Share