বিয়ের পরই ছেলেদের মন ‘পাল্টে’ যাওয়ার অভিযোগ বেশিরভাগ মা-বাবার। এজন্য দায়ী করা হয় ছেলের বউকে। দেখা গেছে, স্বার্থের টানাপড়েনে নাড়িছেঁড়া সন্তান অসহায় মা-বাবাকে বের করে দিচ্ছে বাড়ি থেকে, রাখছে গরু -ছাগলের সঙ্গে গোয়ালঘরে। আর চাকরি বা অন্য কোনো কারণে ছেলে দূরে থাকে এমন মা-বাবাদের দুর্দশার যেন অন্ত নেই।
শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করা তো দূরের কথা- ঠিকমতো খাবার না দেয়ার অভিযোগও রয়েছে অনেক স্ত্রীর বিরুদ্ধে। শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা না করার এ মনোভাব পাল্টাতে হবে ‘স্বামী দূরে থাকা স্ত্রীদের ’। ‘পিতা-মাতার ভরণপোষণ’ বিধিমালার খসড়ায় স্পষ্ট করে মা-বাবার উপযুক্ত পরিচর্যা নিশ্চিত করতে স্ত্রী ও তাদের সন্তানদের ওপর দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে এখন খাতা পত্রে বা আইন করে ।
২০১৩ সালে পাস হওয়া পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইনের আওতায় বিধিমালার খসড়া তৈরি করা হয়েছে। খসড়া বিধিমালার ১৮ ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতা-মাতার যথোপযুক্ত পরিচর্যা নিশ্চিত করতে হবে। সন্তান নিজে উপস্থিত থাকতে না পারলে তার স্ত্রী, সন্তান বা পরিবারের অন্য সদস্যদের দিয়ে মা-বাবার উপযুক্ত পরিচর্যা নিশ্চিত করতে হবে।
পরিচর্যা বলতে কোনো ধরনের সেবা দিতে হবে, তা-ও সুনির্দিষ্ট করা আছে। পরিচর্যা বলতে যতœ সহকারে শারীরিক পরিচ্ছন্নতা, শৌচকার্য, সময়মতো ওষুধ-পথ্য ও খাবার খাওয়ানো, প্রয়োজনমতো বা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে সকাল-বিকেল হাঁটানো বা ব্যায়াম করানোকে বোঝাবে।
খসড়া বিধিমালা চূড়ান্ত করতে ১০ এপ্রিল সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জুয়েনা আজিজের সভাপতিত্বে আন্ত : মন্ত্রণালয় সভা হয়েছে। জুয়েনা আজিজ বলেন, ‘ খসড়া চূড়ান্ত করে বিধিমালা জারি করা হবে। এ বিষয়ে কাজ চলছে।’
চূড়ান্ত হওয়া খসড়া বিধিমালায় বলা হয়েছে, কোনো মা-বাবার একমাত্র ছেলে সস্ত্রীক চাকরি নিয়ে দূরে বা প্রবাসে থাকলে ‘উপযুক্ত প্রতিনিধির’ মাধ্যমে তাদের সেবা নিশ্চিত করতে হবে। উপযুক্ত প্রতিনিধি বলতে সন্তানের কোনো নিকটাত্মীয় চাচা, চাচি, ফুপা, ফুপু, মামা, মামি, খালা, খালু, ভাই, ভাবি, ভগ্নি, ভগ্নিপতি, শ্যালক, শ্যালিকা বা এ ধরনের রক্ত সম্পর্কীয় কেউ, বিশ্বস্ত কর্মী বা প্রতিবেশিকে বোঝানো হয়েছে।
পিতা-মাতার ভরণপোষণের ন্যূনতম মানদ- নির্ধারণ করে খসড়া বিধিমালার ১১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘ভরণপোষণের ন্যূনতম মানদন্ডের ভিত্তি হবে সন্তানের সামর্থ্য ও পিতা-মাতার যৌক্তিক প্রয়োজন সমন্বয়ের মাধ্যমে তাহাদের জন্য পর্যাপ্ত জীবনমান।’
এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রত্যেক সন্তান মা-বাবাকে সঙ্গে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। একাধিক সন্তান থাকলে মা-বাবা কোন সন্তানের সঙ্গে বসবাস করবেন, তা তাদের ইচ্ছানুযায়ী হবে। সন্তান বা তার স্ত্রী-সন্তান মা-বাবার সেবা ঠিকমতো করছে কি না তা যাচাই করতে সারা দেশের ওয়ার্ড পর্যায়ে সহায়ক কমিটি থাকবে।
এ ছাড়া ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা, জেলা, সিটি করপোরেশন ও জাতীয় পর্যায়েও কমিটি থাকবে। কোনো মা-বাবার একজন মাত্র সন্তান থাকলে এবং কোনো উপযুক্ত কারণে একত্রে বসবাস না করলে ওই মা-বাবার ভরণপোষণের জন্য কী পরিমাণ অর্থ সন্তানকে দিতে হবে তা নির্ধারণ করে দেবে সহায়ক কমিটি।
নির্ধারিত অর্থ সন্তান মা-বাবার জন্য ব্যয় করবে বা সরাসরি অথবা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে তাদের ব্যাংক হিসাবে পাঠাবে। একাধিক সন্তান থাকলে এবং সন্তানরা একত্রে বাস না করলে মা-বাবার দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ নির্ধারণ করে প্রত্যেক সন্তান সম্মিলিতভাবে নির্ধারিত অর্থ মা-বাবাকে দেবে।
তবে মা-বাবা যে সন্তানের সঙ্গে থাকবে, সে সন্তানের আয় বিভাজন করে নগদ টাকা দিতে হবে না। মা-বাবার জন্যে সন্তানরা শুধু টাকা দিলেই হবে না । বছরে কমপক্ষে দু’বার সাক্ষাৎ করতে হবে।
অনেক সন্তান বা তার স্ত্রী মা-বাবার আচার-আচরণের সমালোচনা করেন। সন্তান মা-বাবার কথা শুনবে, নাকি স্ত্রীর কথা শুনবে তা নিয়ে বিরোধ হয় বউ-শাশুড়ির মধ্যে। এ বিরোধ দূর করতে মা-বাবার আচরণবিধি নির্ধারণ করা হয়েছে খসড়া বিধিমালায়।
বলা হয়েছে, মা-বাবা তাদের প্রয়োজন বা অনুভূতির কথা সন্তানদের একত্রে বা আলাদাভাবে জানাবেন। যেকোনো সংকটের কথা সন্তানদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। আলোচনা করে সংকটের সুরাহা না হলে পরিবারের অন্য সদস্য বা স্থানীয় ভরণপোষণ সহায়ক কমিটির সহায়তা নেবেন। মা-বাবা পরিবারের সবার প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করবেন এবং শিশুসহ সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করবেন।
মা-বাবার কোনো প্রয়োজন সন্তান তাৎক্ষণিকভাবে মেটাতে না পারলে বা দেরি হলে যথাসম্ভব ধৈর্য ধারণ করবেন। শারীরিক সামর্থ্য অনুযায়ী নিজেদের সেবাযতœ নিজেরাই নেওয়ার চেষ্টা করবেন। তাদের নিজস্ব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ সুরক্ষার চেষ্টা করবেন।
মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের আচরণ কেমন হবে তা উল্লেখ করে খসড়া বিধিমালার ১৩ ধারায় বলা হয়েছে, মা-বাবার সঙ্গে সর্বাবস্থায় মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করতে হবে, যতœসহকারে তাদের দেখভাল করতে হবে। তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। মা-বাবার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যগত বিষয়ে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনীয় সেবা শুশ্রুষা, পথ্য ও অন্যান্য উপকরণ যথাসম্ভব দ্রুত সরবরাহ করতে হবে।
কোনো প্রকার ছলচাতুরীর মাধ্যমে মা-বাবার সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার করবে না। মা-বাবার সম্পদে অন্য উত্তরাধিকারীদের অংশ আত্মসাতের চেষ্টা করবে না। মা-বাবার নিজস্ব কোনো সম্পদ না থাকলেও তাদের কোনোরূপ দোষারোপ করা যাবে না। পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে পিতা-মাতার অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।
মা-বাবার জন্য খাদ্য প্রসঙ্গে খসড়া বিধিমালার ১৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘পিতা-মাতার জন্য দৈনিক ন্যূনতম তিনবার বা পিতা-মাতার প্রয়োজন অনুসারে খাদ্য সরবরাহ করিবে : তবে শর্ত থাকে যে, পিতা-মাতার বয়স, অসুস্থতা বা প্রতিবন্ধিতা বিবেচনায় আনিয়া, প্রয়োজনে চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদের পরামর্শ অনুসারে নির্ধারিত পুষ্টিমান নিশ্চিত করিতে হবে। বিশেষ অনুষ্ঠান বা উৎসবে পিতা-মাতার জন্য চিকিৎসকের বিধি-নিষেধ অনুসরণপূর্বক উন্নতমানের খাবার সরবরাহ করিতে হবে।’
ঋতু বিবেচনায় নিয়ে মা-বাবার পছন্দ ও শারীরিক সক্ষমতা বিবেচনায় তাদের জন্য আরামদায়ক পোশাক নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করে এতে বলা হয়েছে, বছরে যেকোনো একটি উৎসবে অতিরিক্ত এক সেট নতুন পোশাক সরবরাহ করতে হবে। সন্তানের আর্থিক সঙ্গতি অনুসারে তাদের পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কক্ষে রাখতে হবে। কক্ষটি সমতল জায়গা হতে হবে। তাদের জন্য বিছানাপত্র ও প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র রাখতে হবে। তাদের শৌচকাজ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নির্বিঘেœ করার জন্য প্রবীণবান্ধব ব্যবস্থা থাকতে হবে।
কোনো সন্তান বা তার স্ত্রী মা-বাবার উপযুক্ত ভরণপোষণ ও সেবা নিশ্চিত না করলে সে বিষয়ে সহায়ক কমিটির কাছে অভিযোগ করতে পারবেন মা-বাবা। অভিযোগ পাওয়ার পর কমিটি সরেজমিনে গিয়ে মা-বাবা ও সন্তানদের সঙ্গে আলোচনা করবে। আলোচনার ভিত্তিতে তা সুরাহা না হলে কমিটি মা-বাবাকে অভিযোগ দাখিল করতে বলবে। ওই অভিযোগ আমলে নিয়ে ৩০ দিনের মধ্যে আদালত তা নিষ্পত্তি করবে। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ৩০ দিনের মধ্যে জেলা ও দায়রা জজ বা মহানগর দায়রা জজ আদালতে আপিল করতে পারবে।
‘পিতা-মাতার মৃত্যুতে করণীয়’ শিরোনামে খসড়া বিধিমালার ২১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘পিতা-মাতা মৃত্যুবরণ করিলে প্রত্যেক সন্তানকে সশরীরে উপস্থিত থেকে তাহাদের দাফন-কাফন বা সৎকারসহ পিতা-মাতার দায়দেনা পরিশোধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করিতে হবে।
তবে শর্ত থাকে যে, কোনো সন্তান প্রবাসজীবন বা অন্যকোনো কারণে পিতা-মাতার মৃত্যুর অব্যবহিত পরে সংবাদ পাইয়া উপস্থিত থাকিতে না পারিলে তাকে উপযুক্ত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে দাফন-কাফন বা সৎকারের ব্যয়ভার বহনসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করিতে হবে।’
পিতা-মাতার ভরণপোষণে সবাইকে উৎসাহিত করতে উপজেলা, জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ অবদানের জন্য একটি নীতিমালার ভিত্তিতে বার্ষিক সম্মাননা দেয়ার কথাও বলা হয়েছে খসড়া বিধিমালায়।
টাইমস নিউজ ডেস্ক
৩০ এপ্রিল ২০১৯