চাপা পড়ে গেছে খালেদার কারামুক্তি, এবারও ‘হ্যান্ডল’ করতে পারেনি বিএনপি!
আলোচনা ও গুঞ্জনের মধ্যদিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারামুক্তির ইস্যুটি চাপা পড়ে গেছে। ফলে বিএনপির ভেতরে ও বাইরে প্রশ্ন উঠেছে, এবারও কী খালেদার মুক্তির বিষয়টি সঠিকভাবে হ্যান্ডল করতে বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে? নাকি তারা সরকারের ফাঁদে পা দিয়েছে।
কারণ কারামুক্তির আলোচনার মধ্যেই বিএনপির সংসদে যোগদানের ইস্যুটি গত এপ্রিলে সামনে এসেছে। ওই সময় সরকারি দল এবং বিএনপি নেতাদের বক্তব্যের সূত্র ধরে জনমনে এমন ধারণা জন্মে যে, সংসদে যোগদানের সঙ্গে খালেদা জিয়ার কারামুক্তির যোগসূত্র রয়েছে। অথচ গত ২৯ এপ্রিল বিএনপি সংসদে যোগদান করলেও খালেদা জিয়ার কারামুক্তি এখনো ঘটেনি। বিষয়টি নিয়ে এখন তেমন আলোচনাও নেই।
এর কারণ জানতে চাইলে শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ প্রতিনিধিকে বলেন, ‘বিএনপির পক্ষে সরকারের সঙ্গে ‘ডিল’টি হয়তো ঠিকমতো করা হয়নি। আলোচনা বা সমঝোতা যেটিই হোক, সুনির্দিষ্টভাবে করা উচিত ছিল।’ গত মঙ্গলবার প্রতিনিধিকে তিনি বলেন, ‘হয়তো সেখানে কিছু ফাঁকফোকড় ছিল বলেই এখনো ফলাফল পাওয়া যায়নি। তবু দেখা যাক, এখনো সময় আছে। চেষ্টাও আছে।’
গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, ‘বিএনপি এবারেও বিষয়টি হ্যান্ডল করতে পারেনি বলেই খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যুটি চাপা পড়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি খায়-দায় ভালোই আছে। মনে হয় তারা দরকষাকষি করতে এবারেও ব্যর্থ হয়েছে।’
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনের আগে নভেম্বরে অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর মধ্যস্থতায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত আলোচনার পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে সংলাপ শুরুর সমঝোতা হয়েছিল বলে দাবি করে আসছে বিএনপি। কিন্তু সরকারি দলের দাবি, বিএনপি মিথ্যা কথা বলছে। এ ধরনের কোনো সমঝোতা হয়নি।
অনেকের মতে, সমঝোতার ওই বিষয়টি বিএনপি তখন ‘পাবলিক করলে’ বা জনসমক্ষে নিয়ে এলে রাজনৈতিকভাবে দলটি কিছুটা লাভবান হতে পারত। কিন্তু গোপন রাখতে গিয়ে সরকারের সঙ্গে কৌশলে হেরেছে। অথচ এখন বলতেও পারছে না। কারণ ওই সমঝোতার প্রমাণ তাদের হাতে নেই।
নির্বাচন নিয়ে গত বছর নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কয়েক দফা সংলাপে অংশ নিয়েও বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট রাজনৈতিকভাবে কোনো সুবিধা আদায় করতে পারেনি। খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ তাদের উত্থাপিত একটি দাবিও সরকার মেনে না নেওয়া সত্ত্বেও ওই জোট নির্বাচনে অংশ নেয়। অনেকেই এ ঘটনাকেও বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্টের কৌশলগত দুর্বলতা হিসেবে দেখছে। তারা মনে করছে, রাজনৈতিক কৌশল বের করে অন্তত খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা উচিত ছিল বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের।
খালেদা জিয়ার কারামুক্তির বিষয়ে এবারেও বিএনপির প্রভাবশালী দুজন নেতা ও সরকারের এক উপদেষ্টার মধ্যে গোপন আলোচনা হয়েছিল বলে জানা যায়। তবে ওই আলোচনার বিষয়বস্তু আজ পর্যন্ত খোলাসা না হলেও সরকারি দলের নেতাদের বক্তব্যে ‘প্যারোল’ এবং বিএনপি নেতাদের কথায় ‘জামিনে মুক্তি’র দাবির বিষয়টি দৃশ্যমান হয়। পাশাপাশি ‘গোপন সমঝোতা আলোচনার’ মধ্যে ছিল কি না তা জানা না গেলেও ওই একই সময় বিএনপির নির্বাচিত এমপিদের সংসদে যোগদানের বিষয়টিও সামনে চলে আসে।
তবে এ ক্ষেত্রে বিএনপির দরকষাকষির সুযোগ কমে যায়, যখন বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের এমপিরা দলীয় সিদ্ধান্ত ছাড়া নিজেরাই সংসদে যোগদানের জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই সুলতান মোহাম্মদ মনসুর এবং মো. জাহিদুর রহমানের সংসদে যোগ দেওয়ার ঘটনায় উল্টো বিএনপিই সংসদে যোগদানের জন্য চাপের মুখে পড়ে যায়। যদিও বিএনপি নেতাদের ধারণা, তাঁদের যোগদানের নেপথ্যে সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দু-একটি সংস্থার ভূমিকা রয়েছে। ফলে ওই ইস্যুতে সরকারকে বিএনপি চাপে ফেলতে পারেনি। বরং বিএনপি না চাইলেও এমপিরা সংসদে যেতেন—এমন একটি ধারণা বিএনপির পাশাপাশি জনমনেও স্পষ্ট হয়।
এ ছাড়া সরকারের সঙ্গে সমঝোতার বিষয়ে ভূমিকা পালকারী বিএনপি নেতারাও বিষয়টি কিভাবে হ্যান্ডল করেছেন তা নিয়েও নানা আলোচনা রয়েছে। কারণ, খালেদা জিয়া জামিনে, নাকি প্যারোলেও তাঁর আপত্তি নেই সে বিষয়টি সরকারের সঙ্গে আলোচনার আগেই ঠিক করা উচিত ছিল বলে অনেকে মনে করে। বিশেষ করে খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি চান এ কথা বিএনপির ভেতরে ও বাইরে কেউ বিশ্বাস করে না। আবার বিএনপি নেতারা প্যারোলের কথা তাঁদের বক্তব্যে প্রকাশ্যে আনেওনি। অথচ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তথ্যমন্ত্রীসহ একাধিক নেতা বলেছেন, প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে তাঁদের আপত্তি নেই। সব শেষ গত ১৯ এপ্রিল তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, কাউকে তো জোর করে প্যারোল দেওয়া যায় না। এতে বোঝা যায়, সরকার ও বিএনপির চাওয়ার মধ্যে বেশ ফারাক ছিল।
অন্যদিকে, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লন্ডন সফরকালে স্থানীয় বিএনপির বিক্ষোভ প্রদর্শনসহ নানাভাবে তাঁর সফরসঙ্গীদের বিরক্ত করার ঘটনা নিয়েও বিএনপির মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। অনেকেই মনে করছে, লন্ডনে স্থানীয় বিএনপির ওই তৎপরতার কারণে খালেদা জিয়ার মুক্তি আটকে গেছে। কারণ ওই ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছেন। লন্ডনে শেখ হাসিনা বলেছেন, তারেক রহমান বেশি বাড়াবাড়ি করলে তার মা জীবনেও জেল থেকে বের হবেন না। শেখ হাসিনা লন্ডন থেকে ফেরেন গত ১১ মে শনিবার। আর খালেদা জিয়ার মামলার জন্য কেরানীগঞ্জে আদালত স্থানান্তর করার প্রজ্ঞাপন জারি হয় ১৩ মে মঙ্গলবার। ফলে বিএনপির অনেকে মনে করে, ওই ঘটনার যোগসূত্র থাকতে পারে।
অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার মনে করেন, ‘লন্ডনে বিএনপি নেতাকর্মীরা যা করেছে সেটিতে কোনো ক্ষতি হয়নি।’ তাঁর মতে, ‘লন্ডনে খালেদা জিয়া গেলেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা একই কাজ করে। ফলে ওই ঘটনাকে রাজনৈতিকভাবে নেওয়াটা ঠিক হবে না।’
এক প্রশ্নের জবাবে সংসদের সাবেক এই স্পিকার প্রতিনিধিকে বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তির উদ্যোগ এগোয়ওনি, পিছিয়েও যায়নি। একই জায়গায় থেমে আছে। কারণ, তিনি প্যারোলে মুক্তি নেবেন না। তবে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের সংলাপের সময়েই নিষ্পত্তি হওয়া উচিত ছিল।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গত মঙ্গলবার প্রতিনিধিকে বলেন, ‘চেয়ারপারসনের মুক্তির বিষয়ে সরকারের সঙ্গে যাঁদের আলোচনা হয় তাঁরা জানেন। আমি জানি না। তবে বর্তমান সরকারকে যদি বাকিতে বিশ্বাস করা হয় তাহলে যা হওয়ার তাই হয়েছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যেখানে এমপিরা নিজেরাই সংসদে যাওয়ার জন্য পাগল, সেখানে তাঁদের যোগদানের বিনিময়ে সরকার কিছু দেবে কেন?’
নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ১২:৫০ পি.এম, ২৩ মে ২০১৯
ইব্রাহীম জুয়েল