চাঁদপুর

একাত্তরে চাঁদপুরের নৌ-কমান্ডো হামলায় বিধ্বস্ত এমভি ইকরাম এখন যাদুঘরে

মহান মুক্তিযুদ্ধে অপারেশন জ্যাকপটে ডাকাতিয়া নদী মোহনায় লিম্পেট মাইন হামলায় বিধ্বস্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমরাস্ত্র বোঝাই এম ভি ইকরাম জাহাজ সংরক্ষণ করা হয়েছে। ২০০৭ সালে চাঁদপুর থেকে উদ্ধার হওয়া এ জাহাজটির ধ্বংসাবশেষ ১১ বছর পর চট্রগ্রামের মেরিন যাদুঘরে রাখা হয়েছে।

জাহাজটির উদ্ধারের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায় ১৯৮০ সালে চাঁদপুরের এক ব্যবসায়ী সর্বপ্রথম জাহাজটি বালি খুঁড়ে উদ্ধারের চেষ্টা শুরু করলে সাড়া পড়ে যায় চাঁদপুরে। উৎসুক মানুষের আলোচনায় ফিরে আসে একাত্তরের ভূলে যাওয়া ইতিহাস। প্রায় ২ বছরের সে উদ্ধার প্রচেষ্টা পুরোপুরি ব্যর্থ হলে জাহাজটি উদ্ধার অসম্ভব বলে ধরে নেন চাঁদপুরবাসী। এভাবে সুদীর্ঘ ২৭ বছর এম ভি ইকরাম উদ্ধারের চেষ্টা চলে- কখনো জোরেশোরে আবার কখনো বা ধীর গতিতে। ওইসময় জাহাজটি আর উঠে আসেনি বালি-মাটির গভীর তলা থেকে।

এম ভি ইকরাম উদ্ধারকারীদের সূত্র জানায়, ২০০৭ সালে এর সর্বশেষ মালিকপক্ষ উদ্ধার কাজে হাত দিলে ৩৭ বছর বালি-মাটিতে ঢেকে থাকা এম ভি ইকরাম প্রথমবারের মতো স্বচ্ছ পানির দেখা পায়। পরে ক্রেন দিয়ে টেনে তোলা হয় পানির সমান্তরালে এবং শক্তিশালী পাম্প দিয়ে জাহাজের ভেতরকার পানি-বালি অপসারণ করা হয়।

একপর্যায়ে নজরে আসে জাহাজের তলদেশ। মাইন বিষ্ফোরণে ৩টি বড় আকারের ছিদ্র হয়েছিল জাহাজের তলায়। সেখানে লোহার প্লেট ওয়েল্ডিং করে বসিয়ে পানি ওঠা বন্ধ করা হয়। পরে ট্রলারে বেঁধে ভাসমান এম ভি ইকরাম টেনে নেওয়া হয় চাঁদপুর লন্ডন ঘাটে। এ ঘটনা ২০০৮ সালের অক্টোবর মাসের।

মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় নৌ-কমান্ডো হামলার নিদর্শন এম ভি ইকরাম চাঁদপুরে সংরক্ষণের দাবীতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা এবং বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন মিছিল-মিটিং, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচী আরম্ভ করলে নিরাপত্তার স্বার্থে ২০০৮ সালের ১৪ অক্টোবর জাহাজটি টাগবোটে বেঁধে নারায়ণগঞ্জের সোনাকান্দায় সরিয়ে আনা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ এ স্মারকটি সংরক্ষণে সরকারী সিদ্ধান্তের পর বিআইডব্লিউটিএ ২০০৮ সালের ১৫ অক্টোবর জাহাজটির মালিকপক্ষকে ‘যেখানে যে অবস্থায় আছে-সে অবস্থায়’ সংরক্ষণের নির্দেশ জারি করে। পরে সংরক্ষণের কাজ স্থানান্তরিত হয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু ২০১৭ সালের প্রথমার্ধ পর্যন্ত এ ব্যাপারে আর কোন বাস্তব কোন অগ্রগতি হয়নি।

২০১৭ সালের ২ জুলাই নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান জাহাজটি স্থায়ী সংরক্ষণে ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগী হন। এক বছরের প্রানান্তকর চেষ্টায় অবশেষে এম ভি ইকরাম চট্টগ্রাম মেরিন যাদুঘরে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের কাজ এখন প্রায় চুড়ান্ত পর্যায়ে অগ্রসর হয়েছে বলে জানা গেছে।

একাত্তরে মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডোদের সমন্বিত আক্রমন পরিকল্পনার সাঙ্কেতিক নাম ছিল অপারেশন জ্যাকপট, যা সংঘটিত হয়েছিল আজ থেকে সাতচল্লিশ বছর আগে ১৫ আগস্ট গভীর রাতে। তবে মূল পরিকল্পনায় আক্রমনের নির্দ্ধারিত সময় ছিল ১৪ আগস্ট মধ্যরাতের পর, কারণ ১৪ আগস্ট ছিল পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস।

কিন্তু নিরাপত্তাজনিত বাধার মুখে কমান্ডোদল সময়মু টার্গেট এলাকায় পৌছাতে ব্যর্থ হলে আক্রমন পরিকল্পনা পূর্ব-নির্দ্ধারিত ভাবেই পরিবর্তন হয় এবং একদিন পর পরিচালিত হয় কমান্ডো অপারেশনটি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ভেঙ্গে অকুতোভয় নৌ-কমান্ডোরা এক রাতে চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, মংলা এবং নারায়ণগঞ্জ নৌবন্দরে অত্যন্ত সফলতার সাথে পাকিস্তানীদের দখলে থাকা প্রায় ১ লাখ টনের অধিক জাহাজ এবং নৌ-স্থাপনা ধংস করে।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে বলে পাকিস্তান সরকার যে দাবী করে আসছিল অপারেশন জ্যাকপটের সাফলতা প্রথমবারের মু তা নস্যাৎ করে দেয়।

এম ভি ইকরাম অপারেশনে অংশগ্রহণকারী চাঁদপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা, নৌ-কমান্ডো মোঃ শাহজাহান কবির, বীরপ্রতীক জানান, নৌ-কমান্ডো হামলায় বিধ্বস্ত ও নিমজ্জিত এম ভি ইকরাম জাহাজকে কেন্দ্র করে ডাকাতিয়া নদী চ্যানেলে ধীরে ধীরে বিশাল এক বালুচরের গোড়াপত্তন ঘটে।

এক পর্যায়ে ‘কাইশা বনে’ আচ্ছাদিত হলে চরটি মেইনল্যান্ডের কৃষকদের পশুচারণ ভূমিতে পরিণত হয়। এভাবে বালুচরের গভীরে লুকিয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী স্মারক এম ভি ইকরামের কথা কালক্রমে হারিয়ে যায় বিস্মৃতির অতলে।

তৎকালিন সময়ের পত্রিকার কাটিং

অপারেশন জ্যাকপটে চাঁদপুরের অংশে সাবমেরিনার বদিউল আলমের নেতৃত্বে অভিযানে অংশ নেন চাঁদপুর সদরের একই উপজেলার সফরমালীর উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন শহীদ ইব্রাহীম বিএবিটির দু’কৃতি সন্তান নৌ কমান্ডো শাহজাহান কবির বীরপ্রতীক ও নৌ কমান্ডো শামসুল কবির দুদু। শাহতলীর বীরপ্রতীক মমিন উল্যাহ পাটওয়ারী, পশ্চিম কল্যাণদীর নৌ কমান্ডো জহিরুল ইসলাম (বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা), দাসাদী গ্রামের কৃতি সন্তান নৌ কমান্ডো আবুল হোসেন (বর্তমানে বিদ্যুৎ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) ও একইগ্রামের মরহুম সালাউদ্দিন বীরউত্তমসহ (সাবেক বিডিয়ারের মহাপরিচালক)সহ অন্যান্য জেলার অন্তত ২০ জনের একটি চৌকস দল অংশ নেয়।

অংশগ্রহণকারী সদস্যদের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন অভিযানে অংশগ্রহণকারী নৌ কমান্ডো শামসুল কবির দুলু।

 

এদিকে জাহাজটির বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে সাক্ষাতকারে নৌ-পরিবহন শাজাহান খান জানিয়েছেন, ‘সৌভাগ্যবশত মুক্তিযুদ্ধের ৩৭ বছর পর নিমজ্জিত এমভি ইকরাম জাহাজটি উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত জাহাজটি নৌ-কমান্ডো অপারেশনের খুঁজে পাওয়া একমাত্র নিদর্শন। বিষয়টি নিয়ে অন্য এক মন্ত্রণালয় বিগত প্রায় ৯ বছর কাজ করলেও তা কঙ্খিত পরিণতি লাভ করেনি। এক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের অতি মূল্যবান এই স্মারকটির বিষয় তার নজরে আসে এবং ঐতিহাসিক নিদর্শনটি স্থায়ীভাবে সংরক্ষণে তিনি উদ্যোগী হন।

মি. শাহজাহান বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবান যুদ্ধস্মারকটি চট্টগ্রাম মেরিন যাদুঘরে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের কাজ এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
প্রসঙ্গত, পাকিস্তান সরকার অবরুদ্ধ বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে বলে বহির্বিশ্বে যে প্রচারণা চালায় নৌ-কমান্ডোদের অপারেশন জ্যাকপটের মাধ্যমে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়।

বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের নৌ-অভিযানের খবর ফলাও করে প্রচারিত হয়। এরপর থেকে কোনো বিদেশি জাহাজ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসতে রাজি হয়নি। অপারেশন জ্যাকপটের কারণে মুক্তিযুদ্ধ বহির্বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।

প্রতিবেদক- দেলোয়ার হোসাইন
৬ ডিসেম্বর, ২০১৮

Share