চাঁদপুর

চাঁদপুরে ১০ বার নদী ভাঙনের শিকার হওয়া স্কুলকে ভাসমান করার দাবি

‘নদীর একুল ভাঙ্গে ও কুল গড়ে- এই তো নদীর খেলা, সকাল বেলা ধনী রে তুই ফকির সন্ধ্যা বেলা’। এই তো সেদিনও খেলার মাঠ, ফুলেল বাগান, মুক্তমঞ্চ, শহীদ মিনারসহ নানান অনুসঙ্গে শোভিত ছিলো চাঁদপুর সদর উপজেলা নদী বেষ্টিত রাজরাজেশ্বর ওমর আলী উচ্চ বিদ্যালয়।

যার কয়েক কিলোমিটার দূরে ছিলো পদ্মা-মেঘনার নদীর অবস্থান। অথচ চলতি মাসের মাত্র দুই দিনের ভাঙনে স্কুলটি এখন নদীগর্ভে বিলিন। বিদ্যালয়ের িিশক্ষক- শক্ষার্থী রাক্ষুসী পদ্মার মুখ থেকে যতোটা আসবাবপত্র রক্ষা করতে পেরেছে, তাই দিয়ে আবার অন্যত্র গড়ে তুলেছে বিদ্যালয়ের স্থাপনা। এভাবেই গত ১০ বার পদ্মা-মেঘনার ভাঙনের অত্র ইউনিয়নের একমাত্র উচ্চ বিদ্যালয়টি শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

বর্তমানে পাশবর্তি গ্রাম লগ্নির চরে ১৪৬ শতাংশ জমি ক্রয়করে সেখানে কোনোরকম স্থাপনা গড়ে খুবই মানবেতরভাবে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করানো হচ্ছে। আর কয়দিন পরেই জেএসসি ও বার্ষরিক সমাপনি পরীক্ষায় তাই নানা প্রতিকুলতার মধ্যেও শিক্ষা কার্যক্রম যাতে ব্যঘাত না ঘটে, তার জন্যে পরিশ্রম করে যাচ্ছে শিক্ষকরা। ছাত্র-ছাত্রীরাও উপয়ন্তর না পেয়ে বহু দূর-দূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে এসে ক্লাস করছে।

বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানায়, এই ইউনিয়নে ৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে একটিমাত্র উচ্চ বিদ্যালয়। বারবার নদী ভাঙনে আমাদের পড়ালেখার সমস্যা হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের প্রয়োজনীয় কোনো ভবন নেই, বেঞ্চ-টেবিল, বিদ্যুৎ এমনকি টয়লেটও নেই। আমরা রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ক্লাস করছি। তাই মাননিয় শিক্ষামন্ত্রীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ আমাদের এই স্কুলটি যাতে জাতিয়করণ করা হয়।

বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মামুন হোসেন জানান, এই বিদ্যালয়টি ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত এমপিওভুক্ত। তাই শিক্ষকসহ নানান সংঙ্কট রয়েছে। সরকারের কাছে আমাদের আকুল আবেদন এই স্কুলটি যাতে এমপিওভুক্ত করা হয়। এত করে এই ইউনিয়নের মানুষ অত্যান্ত উপকৃত হবে। পাশাপাশি সরকার যদি আমাদের একটি ভাসমান স্কুল করে দেয় তবে প্রতিবছর আমাদের আর ভাঙনের শিকার হতে হবে না।

স্থানীয় ইউপি সদস্য পারভেজ গাজী রণি বলেন, ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৯বার ভাঙনের শিকার হয়েছে স্কুলটি। প্রতিবারই সরকারিভাবে নতুন ভবন করে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে আমাদের শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি মহোদয়ের একান্ত প্রচেষ্টায় এখানে একটি বিদ্যালয়ভবন কাম সাইক্লোন সেন্টার নির্মান করা হচ্ছে। যার ৬০ ভাগ কাজ ইতমধ্যে শেষ হয়ে গেছে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সফিউল্লাহ সরকার জানান, এই ইউনিয়নের ৮টি প্রাইমারী স্কুলের মধ্যে একটিমাত্র উচ্চবিদ্যালয় এটি। ফলে ৮টি প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা পাশ করে এখানে ভর্তি হয়।

এ পর্যন্ত বিদ্যালয়টি ১০ বার ভাঙনের শিকার হয়েছে। প্রতিবারই নিজেদের টাকায় জমি কিনে সরকারি সহযোগিতায় আমরা নতুন ভবন করেছি। এতে একদিকে যেমন সরকারি টাকা ব্যায় হচ্ছে অন্যদিকে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতাদেরও কাটা খরচ হচ্ছে। বর্তমানে লগ্নীর চরে যে জমি কেনা হয়েছে সেখানে প্রায় ১০ লাখ টাকা ব্যায় করে মাটি ভরাটসহ অন্যান্য কাজ করেছি।

সরাকার এবং স্থানীয় চেয়ারমানের কাছ থেকে আমরা যে সহযোগিতা পেয়েছি তারপরেও আমরা অনেক টাকা ঋণ আছি। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় নিয়মিত খোঁজ খবর নিচ্ছেন। কিন্তু বর্তমানে যেখানে সাইক্লোন সেন্টার কাম বিদ্যালয় ভবন করা হচ্ছে তার কাছেও নদী চলে আসছে। তাই সরকারের কাছে আমাদের আবারও আকুল আবেদন যাতে করে আমাদের একটি ভাসমান স্কুল করে দেয়া হয়।

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো. মুনির ফারুক বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমনকি বাংলাদেশেও ভাসমান অনেক স্কুল রয়েছে। আর নদী সিকিস্তি চরাঞ্চলের মানুষের জন্য এটি এখন যুগোপযুগি। আমাদের এই বিদ্যালয়টি ১০বার নদী ভাঙ্গনের শিক্ষার হয়েছে। এতে শুধুমাত্র আমরা বা শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হয়েছে তা নয়, সরকারের অনেক টাকা ক্ষতি হয়েছে। আমি আশা করবো সকল দিক বিবেচনা করে কতৃপক্ষ বিষয়টি বিবেচনায় আনবেন।

প্রসঙ্গত, নদীমাতৃক বাংলাদেশের চর এলাকা রাজরাজেশ্বর ইউনিয়ন। বর্তমানে সেখানে প্রায় ২৫ হাজার মানুষের বসবাস। এসব মানুষগুলো ঝড়, বন্যা, প্রাকৃতিক দূর্যোগ সহ নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিকে বুকে ধরেই বেঁচে থাকেন। আধুনিক সুযোগসুবিধা বঞ্চিত আর অবহেলিত এই ইউনিয়নের একমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নাম ওমর আলী উচ্চ বিদ্যালয়।

প্রসঙ্গত, ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষালয়টি ১০বার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে। আর প্রতিবারই বিদ্যালয় ভবন সম্প্রসারণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা করে। এরপরেও নানা সিমাবদ্ধতাকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে স্ব-গৌরবে ইউনিয়নবাসীর মাঝে মানসম্মত শিক্ষার আলো বিলিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতিক সময়ে আবারো এই প্রতিষ্ঠানটি ভাঙনের শিকরা হয়েছে। মাধ্যমিক এই স্কুলটি সম্প্রসারণের জন্য এবার সরকারের ত্রান ও দূর্যোগ মন্ত্রনালয় থেকে ফ্লাট সেন্টার,

শ্রেণিকক্ষ নির্মানে ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে এর নির্মাণ কাজ প্রায় ৬০ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু গত এক মাসের ভাঙনে নদী এই নির্মানাধিন ভবনের কাছেও চলে এসছে।

তাই বিদ্যালয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী অভিভাবকসহ এলাকার সর্বস্তরের মানুষের দাবি বার বার ভবন নির্মাণ করে তা নদীতে বিলিন হয়ে যাওয়ার চেয়ে এবার যেনো একটি ভাসমান ভবন করে দেয়া হয়। এতে করে কয়েক বছর পর পর সরকার এবং স্কুল পরিচালনা কমিটির কোটি কোটি টাকা ব্যয় থেকে রক্ষা পাবে।

প্রতিবেদক : আশিক বিন রহিম, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

Share