বাংলাদেশে নদীর প্রকৃত সংখ্যা কত, তা কেউ জানে না। নদীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, দপ্তর এমনকি নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট—কারও কাছেই এ পরিসংখ্যান নেই। ২০১৩ সালে গঠন করা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কাছেও নেই। বিভিন্ন সূত্রে নদীর যে সংখ্যা জানা যায়, সেই সংখ্যায় বিস্ময়কর রকমের পার্থক্য। ২৩০ থেকে ২ হাজার পর্যন্ত সংখ্যা পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০০৫ সালে বাংলাদেশের নদ-নদী শীর্ষক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিল। সেখানে দেখানো হয়েছিল নদ-নদীর সংখ্যা ৩১০টি। অনেক দিন দেশে সেটারই প্রচলন ছিল।
এরপর ২০১১ সালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড আরও খানিকটা অনুসন্ধান করে গ্রন্থটি ছয় খণ্ডে প্রকাশ করেছে। সেখানে নদ-নদীর সংখ্যা বলা হয়েছে ৪০৫টি। অনেকেই এই সংখ্যাকে নদীর সংখ্যা হিসেবে গণনা করছেন। কোনো কোনো সূত্রমতে, নদীর সংখ্যা ২৩০টি।
শিশু একাডেমি প্রকাশিত শিশু বিশ্বকোষে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা বলা হয়েছে ৭০০-এর অধিক। অশোক বিশ্বাস নদীকোষ শীর্ষক গ্রন্থেও সাত শতাধিক নদীর সংখ্যা উল্লেখ করেছেন। মোকারম হোসেন বাংলাদেশের নদী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন—বাংলাদেশে নদ-নদীর সংখ্যা হাজারটি। মাহবুব সিদ্দিকী আমাদের নদ-নদী গ্রন্থে লিখেছেন—নদ-নদীর সংখ্যা সহস্রাধিক।
সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় লিখেছেন—‘তেরশত নদী শুধায় আমাকে কোথা থেকে তুমি এলে?’ নদী বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম ইনামুল হক বাংলাদেশের নদনদী শীর্ষক গ্রন্থে সহস্রাধিক নদীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন।
মুঠোফোনে তিনি জানান, ‘বাংলাদেশে নদ-নদীর সংখ্যা দুই হাজারের নিচে নয়।’ বাংলাদেশের আন্তসীমান্তীয় নদীরও প্রকৃত পরিসংখ্যান নেই। আন্তসীমান্তীয় স্বীকৃত নদী ৫৭টি হলেও বাস্তবে এই সংখ্যা শতাধিক।
বাংলাদেশের নদ-নদীর পরিসংখ্যান করার জন্য সরকারের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানই আছে। তবে জেলা এবং উপজেলা প্রশাসনের জন্য এ কাজ সবচেয়ে সহজ। প্রশ্ন হচ্ছে এই ছোট্ট একটি দেশে নদ-নদীর সংখ্যা জানতে আরও কত যুগ অপেক্ষা করতে হবে? আমরা সুন্দরবনে বাঘেরও পরিসংখ্যান জানার চেষ্টা করেছি। কিন্তু নদীর পরিসংখ্যান জানার চেষ্টা করিনি।
উন্নত সভ্যতা যখন মহাকাশে নক্ষত্রের হিসাব করতে ব্যস্ত, তখনো আমরা জানি না আমাদের দেশে নদীর সংখ্যা কত। আমাদের এই ব্যর্থতার নেপথ্যে নদীর প্রতি আমাদের উদাসীনতার চিত্রটি ফুটে ওঠে। জাতিগতভাবে আমরা প্রায় সবাই নদীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হই। অথচ নদীর দখল-দূষণে কোনো প্রতিবাদ করি না। এভাবে প্রতিবছর জীবিত নদীর তালিকা ছোট হচ্ছে। দীর্ঘ হচ্ছে বিলুপ্তপ্রায় নদীর তালিকা।
নদী কখনো মরে যায় না। নদী তার খাত পরিবর্তন করে মাত্র। কিন্তু আমরা নদীর পানির উত্সমুখ বন্ধ করে, ভরাট করে, দখল করে নদীকে মেরে ফেলছি। আমাদের কাছে নদীর প্রকৃত সংখ্যা এবং সেই নদীর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-গভীরতা-পানির প্রবাহের গতি সবকিছুরই পরিসংখ্যান থাকলে একটি নদীকে কেউ সহজে মেরে ফেলতে পারত না। নদীর যেকোনো পরিবর্তন সূচিত হলে তখন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেত।
আমাদের দেশে এমন অনেক নদী আছে, যেগুলোকে সরকারি নদীর তালিকায় আনা হয়নি। জমির পুরোনো দলিলে নদীর উল্লেখ আছে, এ রকম শত শত নদী চোখের সামনে দখল হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন নামের সরকারি প্রতিষ্ঠান এ রকম নদীগুলোকে খাল আখ্যা দিয়ে নদীর প্রকৃত প্রস্থ কমিয়ে খনন করছে।
সরকারের তালিকাভুক্ত নদী হলে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন এ কাজ করতে পারত না। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডও নদীর কম সর্বনাশ করেনি। ফসল রক্ষা বাঁধের নামে অনেক শাখানদীর উত্সমুখ বন্ধ করে দিয়েছে।
নদীর প্রকৃত সংখ্যা এবং অবস্থান চিহ্নিত করার কাজ এখনো শুরু হয়নি। সরকারিভাবে এই কাজ করতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। মাঠপর্যায়ে যাঁরা নদীর কাজ করেন, তাঁদের অনেকের কাছে ছোট ছোট নদীর তথ্যও আছে। জেলা-উপজেলা প্রশাসনের কাছেও এই তালিকা পাওয়া সহজ। অনেক নদীকে জলমহাল হিসেবে ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসনের কাছে নদী, জলাশয় ও বিল লিজ দেওয়ার যে তালিকা আছে, সেটি গ্রহণ করে সরেজমিন এবং পুরোনো দলিল খুঁজলেও অনেক নদীর খবর পাওয়া যাবে।
একটি বিষয় আমাদের মনে রাখা জরুরি—অনেক মাঝারি এবং বড় নদীর প্রাণ হচ্ছে আমাদের ছোট ছোট নদী। এই ছোট ছোট নদী উপনদী হিসেবে যুক্ত হয়ে মূল নদীপ্রবাহ বৃদ্ধি করে। আমরা যদি নদী শুধু খনন করি আর নদীর পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করতে ব্যর্থ হই, তাহলে নদী রক্ষা করা কঠিন হবে। সে জন্য আমাদের ছোট নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড যে তালিকা করেছে, সেখানে উত্তর-পূর্বাঞ্চল অংশে দেখানো হয়েছে নদ-নদীর সংখ্যা ৮২টি। কিন্তু আমি সরেজমিন অনুসন্ধান করে এই এলাকার বিভিন্ন স্থান ঘুরে পেয়েছি দুই শতাধিক নদী। স্থানীয় জনগণই এসব নদীর খবরদাতা। এখনো যেসব বৃদ্ধ ব্যক্তি আছেন, তাঁদের ভাষ্যেই উঠে আসে সেসব নদী অতীতে কেমন প্রমত্তা ছিল।
আমরা সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি, আমাদের ছোট এই দেশের প্রকৃত নদীর সংখ্যা চিহ্নিত করা হোক। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীর প্রতি চরম অবহেলা-উপেক্ষা বন্ধ করা জরুরি। বেসরকারিভাবেও দেশে নদী নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে, কিন্তু কেউ নদীর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে কাজ করেনি। আমাদের নতুন প্রজন্মও জানে না দেশে নদীর সংখ্যা কত।
আমাদের যদি বদ্ধমূল ধারণা হয় আমাদের নদীর সংখ্যা ৪০৫টি, তাহলে পরবর্তী সময়ে এই প্রজন্ম বেড়ে ওঠার পর অন্য নদীগুলোকে নদী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চাইবে না। উদাহরণ হিসেবে কুড়িগ্রামের কথা বলা যায়। কুড়িগ্রামের সাধারণ মানুষ জানে সেখানে নদী আছে ১৬টি।
আমিও একসময় তাই জানতাম। কিন্তু কুড়িগ্রামের আনাচকানাচে ঘুরেফিরে আবিষ্কার করেছি সেখানে নদী আছে অর্ধশতাধিক। এখন শুধু সাধারণের মধ্যে নয়, শিক্ষিতজনেরাও প্রশ্ন তুলেছেন নদী ১৬টির বেশি কীভাবে হয়।
নদীর প্রকৃত সংখ্যা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সরকারের অনেক বড় দায়িত্ব। আমরা সরকারের কাছে বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনাসমেত নদীর সংখ্যা জানতে চাই। আজ ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবসে সরকার অন্তত এই প্রচেষ্টা গ্রহণ করুক।
তুহিন ওয়াদুদ: রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপলের পরিচালক