ইলিশ আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর মধ্যে একটি। আমাদের দেশের ইলিশের সুনাম পৃথিবীর সর্বত্র। বাঙালীর সাংস্কৃতিক,ঐতিহ্য ও গৌরবের সাথে মিশে আছে ইলিশের স্বাদ। নদ-নদীর দেশগুলোর মধ্যে পৃথিবীর অন্যতম দেশ বাংলাদেশ।
জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য মতে, বিশ্বে মিঠা পানির উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ৪র্থ। দেশে যে পরিমাণ ইলিশ উৎপাদন হচ্ছে তার বর্তমান মূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। দেশের এ নদ-নদীতে ইলিশ উৎপাদন দিন দিন বাড়ছেই। এদেশে বহু প্রকারের মাছ রয়েছে। এর মধ্যে ইলিশের অবস্থান সর্বশীর্ষে।
মৎস্য বিভাগের এক তথ্যে জানা গেছে , ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন ছিল ২ .৯৪ মে.টন। আর ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ মে.টন। এখন নদী উপকূলীয় ইলিশ জোন ৩৭ টি এবং ১২৫ টি উপজেলায় এর ব্যপ্তি। গড়ে ৫শ টাকা করে কেজি ধরলে এর মূল্য দাঁড়ায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। ইলিশের গুরুত্বের প্রতি দৃষ্টি রাখলে বুঝা যায়- ইলিশ আমাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি,দারিদ্রদূরীকরণ ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।
আমরা ইলিশের অর্থনৈতিক মূল্যের কথা যদি ভাবি তাহলে বলতে হয়-বিদেশ থেকে আনা ডিজেল, পেট্্েরাল ও অকটেনের মূল্যের সাথে তুলনা করি তাহলে দাঁড়ায়-এক লিটার ডিজেলের মূল্য ৬৮ টাকা, এক লিটার পেট্রোলের মূল্য ৯৬ টাকা এবং এক লিটার অকটেনের মূল্য ৯৮ টাকা।আর আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ইলিশের ঔ পরিমাণ এক কেজির মূল্য ৮ শ থেকে ১ হাজার বা এক হাজার দু’শ টাকা।
দেশের মাছের উৎপাদনের ১২ % হলো ইলিশ এবং জেডিপিতে এর অবদান ১%। তাই ইলিশের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের চেয়ে কম নয়। ইলিশ যে এ দেশের এক মূল্যবান সম্পদ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না ।
চাঁদপুরের মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, প্রায় ৭৫% ইলিশ বাংলাদেশে, ১৫ % ভারতে, ৫% মায়ানমারে এবং বাকি ৫ % টাইগ্রিসসহ পৃথিবীর অন্যান্য নদীতে পাওয়া যায়।এর মধ্যে বাংলাদেশের ইলিশের স্বাদই আলাদা, অভিন্ন ও সর্বত্র চাহিদা রয়েছে।
আমাদের দেশের সব নদ-নদীতে ইলিশের প্রাচুর্য না থাকলেও মেঘনা ও পদ্মা নদীর উপকূলীয় এলাকায় এর বিচরণ ক্ষেত্র রয়েছেঅবাধ । ডিম পাড়ার সময় হলেই প্রাকৃতিক নিয়মে তারা মিঠা পানির মেঘনায় প্রবেশ করে। এদিকে গবেষণায় আরো একটি ইলিশের আবাসস্থল সরকার ঘোষণা করেছে। এ নিয়ে ইলিশের অভয়াশ্রমের সংখ্যা দাঁড়ালো ৬ টিতে। ফলে দেশের ইলিশ অভয়াশ্রমের ব্যাপ্তি বা দৈর্ঘ্যও বৃদ্ধি পেয়ে এখন ৪ শ’ ১০ কি.মি।
এনহ্যান্স কোস্টাল ফিরারিজ ইন বাংলাদেশ প্রকল্পের ইলিশ মাছ ব্যবস্থাপনা কর্ম পরিকল্পনার এক গাইড লাইন রিপোর্ট সংস্করণ মতে,দেশের অন্য ৫ টি ইলিশের অভয়াশ্রমসমূহের মধ্যে রয়েছে- চাঁদপুর জেলার ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুর জেলার চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত মেঘনা নদীর ১শ’ কি.মি,
চর ইলিশা থেকে ভোলা জেলার চর পিয়াল পর্যন্ত মেঘনা নদীর শাহবাজপুর চ্যানেলের ৯০ কি.মি। ভোলা জেলার ভেদুরিয়া থেকে পটুয়াখালী জেলার চর রোস্তম পর্যন্ত তেঁতুলিয়া নদীর ১ শ’ ক.মি।
পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার আন্ধারমানিক নদীর ৪০ কি.মি। শরীয়তপুর জেলার নুরিয়া থেকে ভেদরগঞ্জ পর্যন্ত নিম্ম পদ্মার ২০ কি.মি. এলাকা ইলিশের অভয়াশ্রম হিসেবে পূবেই ঘোষিত। এ ছাড়াও অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট বরিশাল জেলার হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার লতা,নয়াভাঙ্গানী ও ধর্মগঞ্জ নদীর মিলনস্থলে নতুনভাবে আরো ৬০ কি.মি.এলাকাকে ইলিশের ৬ষ্ঠ অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
চাঁদপুর নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের ইলিশ গবেষক ড.আনিছুর রহমান চাঁদপুর টাইমসকে বিষয়টি জানান।
সরকার প্রতিবছর জাতীয় মাছ ইলিশ রক্ষায় মেঘনা ও পদ্মা নদীর উপকূলীয় এলাকার বিচরণ কেন্দ্রগুলিতে অভয়াশ্রম ঘোষণা ও মা মাছসহ জাটকা রক্ষা করতে ২ মাস নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। অথচ এক শ্রেণির অপয়া জেলে সরকারি নির্দেশ অমান্য করে মার্চ-এপ্রিলে অবাধে জাটকা নিধন সও বর্তমান অক্টোবর মাসের এ সময় তারা আইন শৃংখলা বাহিনীর চোখকে নানাভাবে ফাঁকি দিয়ে মা ইলিশ ধরে যাচ্ছে। সংসার চালানোর অজুহাতে তারা এ কাজটি করছে। পদ্মা, মেঘনা, কীর্তনখোলা, পায়রা, তেতুঁলিয়া ও আন্দারমানিক প্রভৃতি নদীগুলো ইলিশের জোন হিসেবে খ্যাত।
মৎস্য বিভাগের দেয়া এক তথ্যে জানা গেছে , নদী উপকূলীয় এলাকাসহ মাত্র ২% লোক জাটকা ও মা ইলিশ ধরা, বেচা, কেনা ও বিভিন্ন স্থানে চালান, বরফ ব্যবসা, পরিবহনের কাজে জড়িত। মাত্র এ দু’ভাগ লোক দেশের ৯৮ % মানুষের জাতীয় সম্পদ ইলিশ ধ্বংসের কাজে নিয়োজিত রয়েছে , যা কারো কাম্য নয়। অথচ ওইসব জেলেদের ২ মাস সংসার চালাতে আর্থিক সহায়তা ও বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সত্ত্বেও নির্বোধ জেলেরা তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন বড় হয়ে মাছে পরিণত হওয়ার সময়ই জাটকা অবাধে ধরে ফেলছে।
২০০৪-২০০৫ অর্থবছরে থেকে ২০০৬-২০০৮ পর্যন্ত ১০ কেজি করে আর বর্তমানে ৪০ কেজি করে চাল দেয়া হচ্ছে। তখন দেশে ২ লাখ ৪৫ হাজার জেরে ছিল । বর্তমানে ২ লাখ ৪৮ হাজার ৬ শ জন জেলে রয়েছে। চাঁদপুরে রয়েছে ৫৩ হাজার জেল্।
ফলে চাঁদপুরে মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষার কৌশল পরিবর্তনে চাঁদপুরের হাইমচরে ও চাঁদপুর মোলহেডে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন প্রয়োজন। পরীক্ষামূলকভাবে এটি এখন করা যেতে পারে । তাহলে তারা নদীতে মাছ ধরা সাহসই পাবে না।
কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে ২০০১- ২০০২ অর্থবছর থেকেই জাতীয়ভাবে ইলিশ সম্পদ রক্ষায় জাটকা নিধন প্রতিরোধ কর্মসূচি পালন করতে হচ্ছে। এবছর ১০ মার্চ থেকে ১৬ মার্চ ২০১৯ পর্যন্ত মৎস্য সপ্তাহ পালিত হচ্ছ্।ে
সরকার প্রকৃত জেলেদের সুযোগ সুবিধা দেয়ার জন্যেই তাদের সঠিক তালিকা তৈরিসহ ছবিযুক্ত পরিচয়পত্রও দিয়েছেন। মৎস্য বিভাগ ইউপির জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় ওইসব জেলেদের তালিকা তৈরি,কার্ডের মাধ্যমে চাল বিতরণ, প্রশিক্ষণ, বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে থাকেন।
তাই তারাই জানেন জাটকা নিধনে রাতে বা দিনে, সকালে বা সন্ধ্যায় সরকারি ছুটির দিনে কিংবা টাস্কফোর্স অভিযানে অংশগ্রহণ করে ফিরে আসার পর পর তারা আবার মা ইলিশ ও জাটকা নিধন মিশনে নেমে পড়ে। এতে জাতীয় সম্পদ ইলিশকে আশানুরূপভাবে রক্ষা করা যাচেছ না। তাই ইলিশ রক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার কৌশল পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি বলে মনে করছি। দেশের গৌরবময় সেনাবাহিনী দেশের সম্পদ রক্ষায় কাজ করবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
প্রথমত : নদী উপকূলীয় ইউপির সকল জনপ্রতিনিধি ও গ্রাম পুলিশ বাহিনীদেরকে জাতীয় মাছ ইলিশ রক্ষায় ২ মাস মেয়াদী শক্তিশালী কমিটি গঠন করা যেতে পারে । দ্বিতীয়ত : জেলার ৩ টি উপজেলার বিশেষ বিশেষ স্থান সমূহে ওই ২ মাসের জন্যে সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা যেতে পারে । তৃতীয়ত : নৌ-পুলিশ জাটকা নিধনকারীদের আইনের আওয়তায় নেয়ার কাজে নিয়োজিত থাকবে যা কোস্টগার্ড সেনাবাহিনীর সাথে নদীতে টহল দিবে।
যে সব স্থানসমূহে সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা যেতে পারে সেগুলো হলো : মতলব উত্তরের মহনপুরে যা এখলাছপুর ও কানুদিকে নিয়ন্ত্রণ করবে।
চাঁদপুর সদরের মোলহেড যা কানুদি মিয়ার বাজার ,ডাসাদী, রাজরাজেস্বর,চাঁদপুরের মেঘনা-ডাকাতিয়া,হরিণা ফেরিঘাট, ইব্রাহিমপুরের রব মুন্সীর বাজার বা বাংলাবাজারকে নিয়ন্ত্রণ করবে । হাইমচর উপজেলার পুরানো কলেজে যা চরগাজীপুর,হাইমচর ইউনিয়নের মধ্যচর এলাকায়, চরভৈরবী বাজার,কাটাখাল,বর্তমান হাইমচর বাজার এবং কালিখোলা লঞ্চঘাটকে নিযত্রণ করবে। ইত্যাদি।
এর ফলে জাল-নৌকা নিয়ে তথাকথিত জাটকা নিধনকারীরা তখন নদীতে নামার দু:সাহস পাবে না। চোরাই পথে নিষিদ্ধ ঘোষিত কারেন্ট জাল ক্রয়ও করবে না।এ পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হলে সরকারের কয়েক শ’কোটি টাকা সাশ্রয় ও জাটকা রক্ষা কর্মসূচি আরো সফল হবে ।
মৎস্য বিভাগ এ নিয়ে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের অযথা সময় নষ্ট ও দাপ্তরিক কাজের ব্যঘাত কম হবে। তাই মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষার কৌশল গতানুগতিক পদ্ধতির পরিবর্তন করে এর নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন প্রয়োজন এখন সময়ের দাবি।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আসাদুল বাকী চাঁদপুর টাইমস জানান,‘ বুধবার ২৭ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০ টায় জেলা টাস্কফোর্সের গুরুত্বপূর্ণ সভা হবে। ঔ সভায় এ বছরের জাটকা সংরক্ষণের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কেননা ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত জাটকা সংরক্ষণের জন্যে দু’মাস ব্যাপি অভিযানও থাকবে।
তিনি আরো জানান , ১০ মার্চ থেকে ১৬ মার্চ সারা দেশে মৎস্য সপ্তাহ ২০১৯ এর কর্মসূচি থাকবে।
প্রতিবেদক : আবদুল গনি ,
২৬ ফেব্রুয়ারি , ২০১৯ মঙ্গলবার