মায়ের বিয়ে হয়েছে ২০০০ সালের ১৫ জুলাই। অথচ মেয়ের জন্মতারিখ একই বছর ৮ ফেব্রুয়ারি দেখিয়ে সদ্য স্কুলপাস করা এক কিশোরীকে ফুসলিয়ে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অথচ মেয়েটির প্রকৃত জন্ম তারিখ আরো তিন বছর পর, একই তারিখে, ২০০৩ সালে।
রোববার রাঙামাটি শহরে একটি রেস্টুরেন্টে এক সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগী কিশোরীর মা ও বাবা অভিযোগ করেছেন তাঁদের মেয়ে আজরা আতিকা আনানকে গত ৮ সেপ্টেম্বর অপহরণ করা হয়।
লিখিত বক্তব্যে ওই কিশোরীর মা ঊর্মিলা আলম বলেন, ‘আমাদের জ্যেষ্ঠ কন্যা আজরা আতিকা আনান (বয়স ১৬)-এর ২০১৯ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আমরা তাকে ঢাকায় লালমাটিয়া মহিলা কলেজে ভর্তি করাই। এক মাস পরই গত কোরবানি ঈদের ছুটিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রাঙামাটি আসে সে।
চিকিৎসা শেষে সুস্থ হওয়ার পর তাকে রাঙামাটিতেই প্রাইভেট পড়ার জন্য শিক্ষকের কাছে পাঠাই। শহরের হ্যাপির মোড় এলাকায় তাকে সাগর স্যারের প্রাইভেটে ভর্তি করানো হয়। গত ৮ সেপ্টেম্বর প্রথমদিনের মতো প্রাইভেটে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হয় আনান। কিন্তু বেলা ২টার দিকে প্রাইভেটে গিয়ে সন্ধ্যায়ও ফিরে না আসায় আমরা উৎকণ্ঠায় তাঁকে খোঁজাখুঁজি শুরু করি।
পরে জানতে পারি হ্যাপির মোড় এলাকা থেকে একটি সাদা প্রাইভেটকারে কাঁঠালতলী এলাকার বখাটে নিয়াদ খান ও তাঁর বন্ধু আরমানসহ কয়েকজন সহযোগীসহ আমার মেয়েকে তুলে নিয়ে গেছে। একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে বিষয়টি জানতে পেরে বখাটে নিয়াদ খানের পরিবারের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করি। তারা বিষয়টি স্বীকার করে একদিনের মধ্যে মেয়েকে আমাদের হাতে তুলে দেওয়ার আশ্বাস দেয়।
এজন্য ওইদিন থানায় কোনো অভিযোগ করিনি আমরা। কিন্তু তাঁরা তাঁদের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ব্যর্থ হলে ১০ সেপ্টেম্বর আমরা কোতোয়ালি থানায় একটি অভিযোগ জমা দেই। সেই বরাবর অপহরণকারী নিয়াদ খানের বাবা নেসার আহমেদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কিন্তু গত ১৪ দিনেও এখনো আমার মেয়ের কোনো হদিস পাইনি।’
ঊর্মিলা আরো অভিযোগ করেন, ‘নিজের অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে হারিয়ে আমি যখন পাগলপ্রায়, সেই সময় অপহরণকারী নিয়াদ খানের মামা লিয়াকত আলী খান ও আব্দুল মালেক খান আমাকে ফোন করে অকথ্য ভাষায় গালাগাল, হুমকি ও ‘পারলে কিছু করিস’ বলে দম্ভ দেখান। শুধু তাই নয়, লিয়াকত আলী খান আমার আপন ছোট ভাই সাইফুল আলম রাশেদকে ‘গুম করে ফেলা’র হুমকি দিয়েছেন।
শুধু তাই নয়, বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করে তথাকথিত সমঝোতার জন্য হুমকি দিচ্ছেন। অন্যথায় আমাদের পুরো পরিবারকে ‘জেলের ভাত খাওয়ানো ও নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। বিষয়টি আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও জানিয়েছি। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার মেয়ের ছবি ছড়িয়ে দিয়ে সামাজিকভাবেও বিব্রত করার চেষ্টা করছেন তাঁরা।’
সংবাদ সম্মেলনে মেয়েকে অপহরণ ও অপহরণকারী নিয়াদ খানকে পৃষ্ঠপোষকতার জন্য তাঁর সহযোগী আরমান খান, তাঁর মামা চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয়দানকারী তাঁর মামা লিয়াকত আলী খান, আব্দুল মালেক খান, আব্দুল খালেক ও তাঁর বাবাকে দায়ী করেন আনানের মা ঊর্মিলা ও বাবা দেলোয়ার হোসেন।
তাঁরা বলেন, ‘আমার মেয়ের বয়স ১৬ বছর। তার প্রকৃত জন্মতারিখ ২০০৩ সালের ৮ ফ্রব্রুয়ারি। কিন্তু এই জন্ম নিবন্ধনটিকে এডিটিং করে তাঁরা চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের কাছে কপি সরবরাহ করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়েছে। অথচ জন্মনিবন্ধন পরিবর্তন করাও আইনত অপরাধ বলে মনে করি আমরা। অবৈধভাবে এই বিয়েকে জায়েজ করার জন্য তাঁরা আমার মেয়ের জন্মতারিখ পরিবর্তন করে যে তারিখ দিয়েছে, তা আমার নিজের বিয়েরও আগের। অর্থাৎ যে জন্মনিবন্ধন করে বিয়ে করা হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে সেই তারিখটিও ভুয়া।
অপহৃত আনানের বাবা দেলোয়ার হোসেন প্রশাসন ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে করজোড়ে মিনতি করে বলেন, ‘এক অসহায় পিতামাতাকে দুর্বিসহ জীবনযাপন থেকে উদ্ধার করে একটি পরিবারকে বাঁচাতে আমাদের মেয়েকে উদ্ধার করুন। একইসঙ্গে অপহরণকারী নিয়াদ খান ও আরমানসহ তাঁদের সহযোগীরা, তাঁদের বাবা নেসার আহমেদ, মামা লিয়াকত আলী খান, আব্দুল মালেক খান ও আব্দুল খালেককে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি জানাচ্ছি।’
একইসঙ্গে ভুয়া জন্মনিবন্ধন দিয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক এক কিশোরীকে বিয়ে পড়ানোয় কাজি ইউসুফ আলী চৌধুরীকে গ্রেপ্তার ও তাঁর নিবন্ধন বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন মেয়ের বাবা।
দেলোয়ার হোসেন আরো বলেন, ‘আমার নাবালিকা মেয়েকে দিয়েই চট্টগ্রামে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে অসংখ্য মিথ্যা-বানোয়াট অভিযোগ ও ভুয়া জন্মনিবন্ধন প্রদর্শন করে অপহরণকারীর পরিবার অনৈতিক এই কাজটির সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রমাণ করেছে।’
সংবাদ সম্মেলনে সরবরাহ করা কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অপহৃতা আনানের প্রকৃত জন্মতারিখ ৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৩। কিন্তু যে কাগজপত্র দেখিয়ে মেয়েটিকে বিয়ে করা হয়েছে বলে জানিয়েছে তাতে মেয়েটির জন্মতারিখ ঠিক রেখে জন্মসাল তিন বছর পিছিয়ে ২০০০ সাল করা হয়েছে।
রাঙামাটি পৌরসভার জন্মনিবন্ধন শাখার ইনচার্জ ফিরোজ আল মাহমুদ সোহেল জানিয়েছেন, মেয়েটির পরিবার আমাদের কাছে তার জন্মনিবন্ধন সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য যোগাযোগ করলে আমরা আমাদের সার্ভারে মেয়েটির জন্মতারিখ ৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৩ সালই দেখতে পেয়েছি। যে কেউ চাইলে এই তারিখ ইচ্ছেমত পরিবর্তন করতে পারে না।’
এ বিষয়ে অভিযুক্ত নিয়াদ খানের মামা পরিচয়দানকারী লিয়াকত আলী খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিজ ভাগিনার পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, ‘জন্মনিবন্ধন সনদে নাম পরিবর্তনের সঙ্গে আমার ভাগিনা জড়িত নয়, এটি করলে মেয়েটিই করেছে।’
মেয়ের পরিবারকে হুমকি ও রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের অভিযোগ অস্বীকার করে লিয়াকত আলী বলেন, ‘আমি চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের দুইবারের সভাপতি ছিলাম। চট্টগ্রামে সবাই আমাকে এক নামে চেনে। অথচ আমার বাসায় পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে।’
মেয়ের মামা ছাত্রলীগ নেতা রাশেদ প্রভাব বিস্তার করে পুলিশ ও ডিআইজিকে ম্যানেজ করে আমাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে।’ তার ভাগিনা শুরুতে তাঁর কাছে থাকলেও এখন কোথায় আছে তিনি জানেন না বলেও দাবি করেছেন।
রাঙামাটির কতোয়ালি থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) খান নুরুল ইসলাম জানিয়েছেন, আমরা ইতিমধ্যেই অপহরণকারীর বাবাকে গ্রেপ্তার করে চালান দিয়েছি। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি কিশোরীটিকে উদ্ধার ও অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করার।’
কোনো চাপ নেই জানিয়ে খান নুরুল ইসলাম আরো বলেন, ‘এই বিষয়ে আমরা ন্যূনতম ছাড় দেব না।’
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur