শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী ও মহান মুক্তিযুদ্ধে ৬ জন শহীদ সন্তানের জননী চাঁদপুরের কন্যা মেহেরজান বিবি। দেশ স্বাধীনের পূর্বে তিনি ছিলেন রাজধানীর মিরপুর বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা।
মুক্তিযুদ্ধে স্বামী ও ৬ সন্তানকে হারিয়ে এখন সহায় সম্বলহীন মেহেরজানের ঠাঁই হয়েছে ফেনী সদর উপজেলার ধর্মপুর আবাসন ও আশ্রয়ণ প্রকল্পে। সেখানকার ব্যারাকের ১১ নং কক্ষে তিনি বসবাস করেন।
গেলো বছর পড়ে গিয়ে ৯০ বছর বয়সী মেহেরজানের কোমরের নিচের অংশের হাড় ভেঙে যাওয়ায় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নেন।
মেহেরজান বিবির বেঁচে থাকা দু’ ছেলের একজন রিকশাচালক, অন্যজন দর্জি। মায়ের চিকিৎসার ব্যয়ভার গ্রহণের সামর্থ্য ছিলো না, তাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই তাদের চিকিৎসার পুরো ব্যয়ভার গ্রহণ করেন।
বয়সের ভারে ন্যুজ্ব ৯০ বছর বয়স্কা অসহায় মেহেরজান বিবি প্রতিদিন মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করেন। তাঁর দুঃখে ভারাক্রান্ত জীবন কাহিনী বলতে বলতে অঝোরে চোখ বেয়ে নেমে আসে বেদনার অশ্রু। নিজে কাঁদেন এবং অন্যকেও কাঁদান।
পায়ের অপারেশনের পর থেকে এ বয়সেও দু’ বগলে স্টে্চারে ভর দিয়ে গ্রামের দারে দারে দু’মুঠো ভিক্ষার জন্য ঘুরে বেড়ান মেহেরজান।
চরম অসহায়ত্বের মাঝে দিন কাটছে তাঁর। সহায় সম্বলহীন মেহেরজারেন আকুতি এখন একটু বেঁচে থাকা জাতির জনক কন্যা প্রধানমন্ত্রীর সাথে একটু সাক্ষাত করা।
পৈতৃক নিবাস চাঁদপুর সদর উপজেলার বাবুর হাটস্থ ২৬ নং দক্ষিণ তরপুর চন্ডী গ্রামে। ১০ অক্টোবর ১৯৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেন মেহেরজান বিবি। তাঁর বাবা ইব্রাহীম উকিল, মা বিবি হনুফা। তারা ছিলেন ৬ ভাই বোন।
সোনাগাজী উপজেলার ৬ নং চরছান্দিয়া ইউনিয়নের বড়ধলী হাজী বাড়ির মরহুম মমতাজ উদ্দিনের ছেলে সুবেদার মেজর এ টি এম সামসুদ্দিনের সাথে মেহেরজান বিবির বিয়ে হয়। পঞ্চাশের দশকে বড়ধলী গ্রাম নদী গর্ভে বিলিন হলে নিঃস্ব হয়ে তারা শহরে চলে আসেন।
বাসা ভাড়া করেন ঢাকার মিরপুর ১ নাম্বারে জালাল দারগার বাড়িতে। মেহেরজান বিবি’র ভাষ্য মতে, তাঁর ৮ পুত্র ও ২ মেয়ে ছিল। তাঁর ছয় পুত্র এবং স্বামী এ টি এম সামসুদ্দিন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হন।
শহীদ ছেলেরা হলেন- ছায়েদুল হক (তৎসময়ে সিলেটে রিলিফ অফিসার পদে কর্মরত ছিলেন), দেলোয়ার হোসেন, বেলায়েত হোসেন, খোয়াজ নবী, নুরের জামান ও আবুল কালাম। অর্থ সংকটে পড়ে বাকী দু’পুত্রও রিকশা চালক শাহ আলম ও দর্জি মেস্ত্রী শাহ জাহান তাঁর খোঁজ-খবর ঠিকমতো নিতে পারেন না। দু মেয়ে মরিয়ম বিবি ও হাসনা বিবিও মারা গেছেন।
মেহেরজান বিবি জানালেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী তাঁর স্বামী ও ৬ সন্তানকে হত্যা করে খ্যান্ত হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা পরিবার জানতে পেরে মিরপুরে তাঁদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে তিনি ঢাকার মিরপুরে বাংলা মিডিয়াম হাই স্কুল (বর্তমানে মিরপুর বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়) এর শিক্ষিকা ছিলেন।
মেহেরজান বিবি জানান, স্বাধীনতার পর তাঁর দুঃখ-কষ্টের কথা দৈনিক বাংলা বাণী পত্রিকায় ছাপা হলে তখন তিনি বঙ্গবন্ধুর নজরে আসেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে ও তাঁর এক পুত্রবধূ করফুলের নেছাকে ডেকে নিয়ে দু’ হাজার টাকা করে অনুদান দেন এবং বঙ্গবন্ধু মেহেরজান বিবিকে পবিত্র হজ্ব পালন করান। মেহেরজান বিবি জানান, এরপর আর কেউ খবর রাখেনি। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আমাকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না।
তিনি জানান, রাষ্ট্রের কাছে আমি আর কিছুই চাই না। এখন আমার একটাই চাওয়া, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাত পাওয়া। বঙ্গবন্ধু ছাড়া অন্য কেউ আমার দুঃখ বুঝবেন না।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর স্বামী সন্তানদের শহীদ হওয়ার খবরে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিনেও তাঁর পুরাপুরি মানসিক সুস্থতা ফিরে আসেনি। স্বজনদের হারিয়ে চরম অসহায়ত্বে পড়ে ভিক্ষাভিত্তির পথ বেছে নেন তিনি।
২০০৯ সালে ফেনী রেল স্টেশনে ভিক্ষা করতে দেখে জনৈক জিআরপি পুলিশ তাঁকে ফেনী জেলা প্রশাসনে পাঠায়। তখন জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে তাঁকে পুর্নবাসন করা হয় ধর্মপুর আবাসন প্রকল্পে। সে থেকে তিনি এখানে বসবাস করছেন।
সোনাগাজী উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সৈয়দ নাসির উদ্দিন জানান, মেহেরজান বিবি সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে, তবে কোন কাজ হয়নি। তাঁর স্বামী-সন্তান যে শহীদ হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি গেজেটে তাঁর নামও দেখেছি।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ফেনী জেলা ইউনিটের ডেপুটি কমান্ডার আবদুর রহমান মজুমদার বলেন,‘ দীর্ঘদিন থেকে মেহেরজান বিবির সাথে আমার সম্পর্ক। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করেন এবং ছেলে ডাকেন।’
ফেনীর জেলা প্রসাশক মনোজ কুমার রায় বলেন, আশ্রায়ন প্রকল্পে সুবিধা ভোগীর একজন মেহেরজান। আমরা তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছি । আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ছয় সন্তান ও স্বামী হারিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁর অনেক করুন কাহিনী শুনেছি। তাঁর জন্য সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।
চাঁদপুর টাইমস রিপোর্ট
২৬ মার্চ, ২০১৯