সাত বছরের ছোট্ট মাহিবের মা স্কুল শিক্ষিকা। মায়ের স্কুলেই প্রথম শ্রেণীতে পড়ে সে৷ বাবা প্রবাসী। চোখভরা দুষ্টুমিমাখা হাসি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মাহিবের জন্য মা-ই তাই দুনিয়া। মায়ের কাছেও নিশ্চয়ই ছোট্ট মাহিবই সবকিছু।
৩ ডিসেম্বরের দিনটা তাই মাহিবের মা শাহিনা আক্তারের জন্য বিভীষিকাময় হয়েই এলো৷ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মাহিবকে। আশেপাশে অনেক খবর নিয়েও পাওয়া গেল না তাকে।
যখন মায়ের চিন্তা হাহাকারের কান্নায় রূপ নিচ্ছে, তখনই একটা কল এলো, ‘মাহিব ভাল আছে’, এই একটা কথাই শুধু বললো অপিরিচিত কন্ঠ৷ তাতে কি আর মায়ের দুশ্চিন্তা কমে! নির্ঘুম রাত কাটিয়ে নানাজনের কাছে ছেলেকে খুঁজে দেবার অনুরোধ করেন তিনি।
৪ ডিসেম্বর মাহিবের জ্যাঠা জামাল আসেন মতলব দক্ষিণ থানায় জিডি করতে। নিষ্ঠুর পুলিশ সব শুনেও নির্বিকার, জিডি নিলেও কোন সাহায্য করার আগেই বললেন মাহিবের বাবা-মাকে নিয়ে আসতে। ছেলে যখন তাদের, তাদের সাথে কথা বলতে হবে।
এমন অসহায় পরিস্থিতিতে পুলিশের এমন আচরণের ব্যাখ্যা পেলেন না জামাল, বিরক্ত হয়েই নিয়ে এলেন শাহিনাকে। শুরুতেই পুলিশের এমন কার্যক্রম দেখে মাহিবকে খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী হতে পারলেন না তারা। শুধু ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আর কীসব মোবাইলের নাম্বার নিয়েই দায় সারছে পুলিশ!! এলাকায় মাইকিং আর খোঁজ নেয়ার শুরু হলো তাই।
গল্পের আসল শুরুটা হলো যখন মতলব দক্ষিণ থানার অফিসার ইনচার্জ এ কে এম এস ইকবাল হোসেন আগেরদিন শাহিনা মোবাইলে যে নাম্বার থেকে কল এসেছিল তা ট্র্যাকিং করা শুরু করলেন। পুলিশ সুপার চাঁদপুর, জিহাদুল কবির পিপিএম স্যারের নির্দেশে তাৎক্ষনিকভাবে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যাবহার করে পাওয়া গেলো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য৷ প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেশী ‘সজিব’কে নিয়ে আসা হলো।
মতলব সার্কলের সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার রাজন কুমার দাসসহ ওসি ইকবাল এবং তদন্ত কর্মকর্তা ইব্রাহিম নানাভাবে সজিবকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। মাহিবের জ্যাঠা জামাল তক্ষুনি সজিবকে বিবাদী করে মামলা দিতে চাইলে আবারও ঝামেলা করল পুলিশ৷ দুষ্ট পুলিশের ফন্দি নিয়ে এবারও বিরক্ত জামাল। আসামী প্রমানসহ পেয়েও কেন তারা তার বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নিচ্ছে না! তাহলে কি একটা ছোট্ট শিশুকে খুঁজতেও এতটুকু আন্তরিকতা নেই এইদেশের পুলিশের?এতই নিষ্ঠুর যে মায়ের কান্নাও তাদের স্পর্শ করে না?
মাহিবের পরিবার ও এলাকাবাসীর নানা প্রশ্নবাণ পাত্তা না দিয়ে পুলিশ তখন ছুটে চলেছে মূল আসামীর সন্ধানে৷ সজীবের দেয়া তথ্য আর কিছু প্রমান মিলিয়ে সন্দেহের তীর এমন একজনের দিকে যাকে গ্রেফতার করা যাচ্ছিল না তখনই। এদিকে মাহিবের জ্যাঠা জামাল হুট করেই দৃশ্যপট থেকে লাপাত্তা। মূল আসামীর সন্ধানে কুমিল্লা গিয়েও শূন্যহাতে ফিরতে হলো। এদিকে বাড়ছে এলাকার অসন্তোষ, মাহিবের মায়ের চোখের পানি, মাহিবের বাবাও ছেলের চিন্তায় চলে এসেছেন দেশে। ওইদিকে রাতের ঘুম হারাম করে তদন্ত কর্মকর্তার সাথে ওসি প্রতিনিয়ত পরামর্শ নিচ্ছেন সার্কেল এএসপি এবং পুলিশ সুপার স্যারের। নানা কৌশলে মাহিবের জ্যাঠা জামালকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে বেরিয়ে এলো আসল নিষ্ঠুরতার গল্প। যেকোন স্বাভাবিক মানুষকে বাকরুদ্ধ করে দিবে সেই গল্প।
ভাতিজা মাহিবকে অপহরণ করে তার বাবা-মায়ের থেকে দফায় দফায় টাকা আদায়ের ফন্দি আটে জামাল। এমনকি বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে রাখার ঝামেলাও করতে চায়নি সে। তাই সজীবের সহায়তায় শ্বাসরোধ করে হত্যা করে সে। প্রথমে নিজের দোকানে, পরে পাশের হাজী তাজুল ইসলামের স্যাপটিক ট্যাংকে লুকিয়ে রাখে লাশ। তার পরিকল্পনা ছিল একটু সুযোগ বুঝেই টাকা দাবী করার। কিন্তু দুষ্ট পুলিশের কারনে ভেস্তে যায় সব পরিকল্পনা। লোভের ফলাফল হিসেবে জেলখানাই হলো তার ঠিকানা।
ট্যাংকের দূর্গন্ধময় গহন থেকে নিষ্পাপ শিশুটির নিথর দেহ তুলে আনার সময় নিষ্ঠুর পুলিশদের কেউ কেউ অশ্রু মুছেছেন বলে শোনা যায়! ছোট্ট শিশুটাকে আর ফিরিয়ে আনতে না পারলেও তার খুনীদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করার প্রতিজ্ঞাও করেছেন এইসব নিষ্ঠুর পুলিশেরা।
লেখকঃ শাকিলা ইয়াসমিন সূচনা, সহকারি পুলিশ সুপার, চাঁদপুর ।
বার্তা কক্ষ
১২ ডিসেম্বর,২০১৮