Home / চাঁদপুর / আমাদের চিন্তার দীনতা : মুহাম্মদ ফরিদ হাসান
Forid-hasan

আমাদের চিন্তার দীনতা : মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

এ কথা সত্য যে, বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি যেভাবে দাঁড়িয়েছে, সেভাবে সামাজিক ভিত্তিগুলো দাঁড়াতে পারেনি। উৎপাদন, রপ্তানি, ক্রীড়াক্ষেত্রসহ বিভিন্ন দিক দিয়ে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ বৈশ্বিকভাবে ভালো করছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিক দিয়েও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দৃষ্টি নিজের দিকে টানতে সক্ষম হয়েছে।

একই সক্ষমতার কারণে আমরা নিজেদের অর্থে পদ্মসেতুর মতো বড় একটি কাজ সম্পন্ন করতে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্যে কেবল অর্থনীতিই প্রধান অনুষঙ্গ নয়। অনুষঙ্গ হিসেবে সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা অর্থনীতির চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

কিন্তু দিন যতোই এগুচ্ছে এসব ক্ষেত্রে আমাদের দীনতা ততোই স্পষ্ট হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি সংকোচিত হয়ে পড়ছে আমাদের চিন্তার জগৎ। অথচ পৃথিবীর যা পরিবর্তন, সভ্যতার যে এগিয়ে চলাÑতার পেছনে যতোটা না অর্থনীতির অবদান রয়েছে, তারচেয়ে বেশি রয়েছে মহৎ চিন্তার অবদান। অপরাপর দেশের চেয়ে আমরা যে চিন্তায়, দর্শনে ও জ্ঞানে-বিজ্ঞানে পিছিয়ে আছি তার প্রমাণ এসব ক্ষেত্রে আমাদের বৈশ্বিক অবস্থান।

পৃথিবী কাঁপানো কোনো আবিষ্কারের জনক হিসেবে আমরা গত কয়েক শ’ বছরে ক’জন বাঙালিকে পেয়েছি? অথবা দার্শনিক হিসেবে আমরা কজন বৈশ্বিক প্রভাবশালি বাঙালি দার্শনিকের কথা বলতে পারবো? আর বৈশ্বিক চিকিৎসা ও গবেষণার ক্ষেত্রে আমাদের অবদানই বা কতটুকু? এসব প্রশ্নের উত্তরগুলো ঠিকই আমাদের এটা প্রমাণ করে দেয় যে, আসলেই চিন্তা চর্চায় আমরা অনেকদূর পিছিয়ে আছি।

তবে বহির্বিশ্বে এসব ক্ষেত্রে আমাদের যে প্রভাব একেবারেই নেইÑতা বলছি না। যাঁরা আছেন, তাঁরা অগ্রগামী এবং উদাহরণ হিসেবে অপ্রতুল। আমাদের দেশে অনেক অনেক গুণী মানুষ আছেনÑকিন্তু বৈশ্বিক বিবেচনায় বিশ্ববাসী চিনবে এমন লোকজন সত্যিই আমাদের কম।

দর্শনের সাথে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়-আশয়সহ বিবিধ অনুষঙ্গগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। আমাদের সচেতনতার অভাব রয়েছে। মূল্যবোধের ঘাটতি তো রয়েছেই। প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ আমাদের দেশে খুন হচ্ছে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, শিশু হত্যা ও কিশোর অপরাধ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।

আমাদের যে কিশোররা দুরন্ত হওয়ার কথা, সৃজনশীলতায় গা ভাসিয়ে দেয়ার কথা-তারা এখন গ্যাং তৈরি করছে। তুচ্ছ ব্যাপারে মারামারি হানাহানিতে জড়িয়ে পড়ছে। প্রায় প্রতিদিনই একজন বা একাধিক শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। ভাবা যায়? বর্তমানে শিশু ধর্ষণ মহামারি আকার ধারণ করেছে।

ধর্ষণ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান দেখলে পিলে চমকে উঠে। ঢাকা ট্রিবিউনের সংবাদ মতে, গত ছয় মাসে ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার ৪শ’ শিশু! এরমধ্যে ধর্ষণের পর ১৬ শিশু মারা যায়। এ তো গেলো শিশু ধর্ষণের পরিসংখ্যান।

অন্যদিকে শুধু ২০১৯ সালের প্রথম সাড়ে তিন মাসে প্রায় ৪শ নারী শিশু হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের শিকার হয়েছে। মানুষের জন্যে ফাউন্ডেশন সংস্থার তথ্য মতে, ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হওয়ার মোট ৩৪৫টি সংবাদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ৩৫৬, যার মধ্যে মারা গেছে ২২ জন এবং আহত হয়েছে ৩৩৪ জন। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও শালিস কেন্দ্র জানিয়েছেÑ২০১৬ সালে ৭শ’ ২৪ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে ৩শ’ ৮জনই শিশু। (সূত্র : প্রথম আলো, ২৫ ফেব্রুয়ারি ’১৭)। এমন নৃশংসতার শিকার হয়েছে ছয় মাসের শিশুও।

কল্পনা করা যায়, আমাদের পশুত্ব কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে? এসব পরিসংখ্যান কাউকে ভয়াবহ রকমের পীড়নের জন্যেই কি যথেষ্ট নয়? প্রতি বছরই খুনের ঘটনা বাড়ে। বছরে কয়েক হাজার মানুষ খুন হয়। স্বার্থগত কারণে নিশ্চয়ই এসব খুনগুলো সংগঠিত হয়েছে। কিন্তু এই স্বার্থগত বিষয় এও জানায় যে, স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে বাংলাদেশে বছরে চার/পাঁচ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।

এরপরে আমাদের মূল্যবোধ যে ক্ষয়ে ক্ষয়ে চরম অবস্থায় পৌঁছে গেছে তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। এসব খুন, ধর্ষণ, হানাহানি, চাঁদাবাজির ঘটনার বিচার হবে, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন। পাশাপাশি এসব ঘটনা যে আমাদের চিন্তার দীনতার কারণে ঘটছে সেটা অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই। তাই কেবলমাত্র শাস্তির মাধ্যমেই সমাজ থেকে এসব ঘটনা দূর করা বা কমিয়ে আনা সম্ভব নয়।

এজন্যে চাই মূল্যবোধ, উন্নত চিন্তা ও নৈতিকতার সমন্বয়। সহনশীলতাও খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে আমাদের মূল্যবোধ, সৃজনশীলতাকে বাড়িয়ে দেয়া যায় সে ব্যাপারে সরকারকে বিশেষভাবেই চিন্তা করতে হবে। এ কাজটি যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে একদিকে যেমন নৃশংস ঘটনার সংখ্যা কমে আসবে, তেমনি সৃজনশীলতার চর্চা বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশীরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে, চিন্তা-দর্শনে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যাবে।

রাজনীতিতে ‘কথার জোর’ বলে একটা কথা আছে। আমাদের মনে হয়, রাজনীতির সাথে চিন্তার জোরের একটা সমন্বয় থাকা খুব বেশি প্রয়োজন। প্রয়োজন সৎ চিন্তা। ব্যক্তি চিন্তা না করে সমাজের জন্যে চিন্তাশীল মানুষ যদি বেশি বেশি রাজনীতিতে আসেন তাহলে প্রকৃতার্থেই বাংলাদেশ উপকৃত হবে।

আবার সাংস্কৃতিক অঙ্গনও অনেক পরিশীলিত হবে। আগাছারা ঝরে পড়বে। ভুল উচ্চারণ, ভিনদেশী সংস্কৃতি লালন, বিকৃতি ও কৃত্রিমতা কমে আসবে। সাহিত্যিকদের দৃষ্টিভঙ্গিও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটধারী হওয়া উচিত। আমাদের দেশীয় উপকরণ ব্যবহার করেই বৈশ্বিকভাবে প্রভাববিস্তারী সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব। আর এমনটা হলে রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীতে সাহিত্যের জন্যে নোবেলের খরা আমরা ঠিকই কাটিয়ে উঠতে পারবো।

আগেই উল্লেখ করেছি, সরকারের উচিত চিন্তার দীনতা রোধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া। কারণ চিন্তার উৎকর্ষ হলে অর্থনীতির উৎকর্ষ বিপুল ভাবে হবে। পাশাপাশি অবক্ষয় দূর হয়ে মানুষ মানবিক ও সৃষ্টিমুখর হয়ে উঠবে। এজন্যে প্রয়োজনে একটি কমিশন গঠন করা যেতে পারে।

যে কমিশন মানুষের সৃজনশীলতা বিস্তার ও মানুষকে দর্শন চর্চার জন্যে প্রণোদনা দিবে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রও তৈরি করবে। পরিবার অবশ্যই এ প্রণোদনার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। পরিবার থেকেই আমাদের মূল্যবোধ গঠন এবং চিন্তাশীলতার পথকে প্রশস্ত করে দিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবেÑভালো থাকার জন্যে, আশেপাশের মানুষদের ভালো রাখার জন্যে, দেশকে কিছু দেয়ার জন্যে একটি মহৎ চিন্তার কোনো বিকল্প নেই। যার চিন্তা বিপথগ্রস্ত, সে বিপথগামী হবেÑএটাই স্বাভাবিক। তার মাধ্যমে সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবেই। মনে রাখতে হবে এর বিপরীতে আছে সুন্দর জীবন ও সমৃদ্ধ পৃথিবী।

আমরা বিশ্বনাগরিক। আমাদের দৃষ্টি দেশের মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক হবে। আগামী বছর এ দেশের একজন সাহিত্যিক নোবেল পুরস্কার পাবেন, অথবা একজন রসায়নবিদ যুগান্তকারী কোনো তত্ত্ব দিয়ে বিশ্বকে আলোড়িত করবেনÑএমন সম্ভাবনার ভাবনা আমাদের যেমন ভাবতে হবে, তেমনি সরকারকেও এমন চিন্তা করতে হবে। কেবল অর্থনীতি কোনো দেশের জন্যে শান্তি আনে না, চিন্তার বিস্তারে মানবিকতাকে জাগ্রত করলেই দেশ সার্বিকভাবে এগিয়ে যাবে।

নয়ন ভন্ডের মায়ের সাক্ষাতকার……… দেখুন ভিডিওতে

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান : কবি ও প্রাবন্ধিক।
১৩ জুলাই ২০১৯