শাহরাস্তি

মা! ‘মা কই’ বলে কোহিনুরকে খুঁজছে প্রবাসীর কন্যা ছোট্ট শিশু লিজা

‘মা কই, মা! মা! মা কই! এভাবেই কিছুক্ষণ পর পর মাকেও খুঁজে বেড়াচ্ছে ছোট্ট লিজা। আর কত সান্ত্বনা, আর কত অপেক্ষার পালা লিজা জানে না। অথচ তার মা আর কোনো দিনও তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিবেন না, আদর করে খাইয়ে দিবেন না।

মাত্র ৪ বছর বয়সী কোহিনুরের ছোট মেয়ে কামরুন্নাহার লিজা। মৃত্যু কী? তা বোঝার আগেই মাকে হারালো সে। খাওয়ার সময় তার মা আর তাকে ডাকছেন না, দুপুরের গোসল, আদর করে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছেন না, আগের মতো কিছুক্ষণ পর পর আদরের সন্তানকে লিজা বলে ডাকছেন না।

মায়ের খোঁজ করলেই লিজার দাদী সান্ত্বনা দিচ্ছেন। ‘মা কাজে গেছে, চলে আসবে।’ এভাবেই মা হারা নাতনীকে সান্তনা দিচ্ছেন আর আচল দিয়ে নিজের চোখের জল মুছছেন পুত্রবধূহারা মাকসুদা।

কোহিনুরের সন্তানদের চোখে টলমল করছে জল। কোহিনুরের বড় মেয়ে মুক্তা আক্তার ভাটনী খোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণিতে পড়ছে। কয়েক দিন ধরে সে স্কুলে যায় না। মায়ের হত্যা সম্পর্কে তার কিছুটা ধারণা থাকলেও তার বিশ্বাস, মা আবার ফিরে আসবে। তাদের আদর করে চোখের পানি মুছে দিবে। হঠাৎ হঠাৎ করে মায়ের জন্যে কেঁদে উঠছে মুক্তা। সুযোগ পেলেই মায়ের কবরের পাশে গিয়ে মাকে যেনো দেখে আসছে আর মুর্ছা যাচ্ছে মুক্তা।

কোহিনুরের একমাত্র ছেলে তারেক হোসেন। টামটা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীর ছাত্র। মাকে হত্যার চিত্র আজও তার চোখে ভাসছে। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মাকে শেষ বিদায় দেয় তারেক। মায়ের কবর বাড়ির সামনেই, কিছুক্ষণ পরপর সেই কবর দেখে আসে সে। চোখে মুখে অন্ধকার ; মা-হারা পৃথিবী কেমন তা শুধু তারেকই বুঝতে পারে।

কোহিনুরের স্বামী সৌদী আরব প্রবাসী আরিফুল ইসলাম, এক সময় রিকশা চালিয়ে জীবন-যাপন করতেন। প্রায় ১৬ বছর পূর্বে কোহিনুরের সাথে তার বিয়ে হয়। তাদের অনেক কষ্টের সংসার, বাড়িতে দোচালা টিনের ঘর। বাড়ির সম্পত্তি বিক্রি করে এর আগে দু’বার বিদেশে গিয়েছিলেন। ভগ্যের নির্মম পরিহাসে সেখানে বেশিদিন থাকতে পারেননি।

অবশেষে তার এক ভাই তাকে বছর খানেক পূর্বে সৌদি আরবে নিয়ে যান। বর্তমানে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন আরিফ। কাজের বেতন তেমন করে পাচ্ছেন না। স্ত্রী হত্যার সংবাদ শুনে দেশে আসার জন্যে ব্যাকুল হয়ে পড়েছেন। অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না থাকায় আসতেও পারছেন না। প্রতিদিন খোঁজ-খবর নিচ্ছেন সেখান থেকেই। একদিকে স্ত্রী পরপারে অন্যদিকে দেশের মাটিতে মা-হারা তিন সন্তান। চোখে মুখে আরিফুলের শুধুই অন্ধকার। মাকে হারিয়ে বাবার চেহারাটুকুও দেখার সৌভাগ্য হচ্ছে না বুঝ জ্ঞান না হওয়া আরিফের সন্তানদের।

আরিফের মা মাকসুদা বেগম সারাক্ষণ কান্না করে দিন পার করছেন। আরিফের ভাই শরীফ আলম দলিল লেখক। নিজের সন্তানদের মত ভাইয়ের সন্তানদের লালন-পালন করার জন্যে সব সময় পাশে থাকার কথা জানালেন। সেই সাথে কোহিনুরের ভাইদের সহযোগিতার কথা স্মরণ করেন শরীফ।

একটি ঘটনার জের ধরে হত্যা করা হয় কোহিনুরকে। শুধুমাত্র ভাসুরের জেদের বশবর্তী হয়ে কোহিনুর প্রাণ হারান। ঘাতক জহির ছোটবেলা থেকেই উশৃঙ্খল, তার স্ত্রী লাকি বেগম তার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে তালাক দেয়। তালাকের এক বছর পর ২য় বিয়ের মাধ্যমে কোহিনুর তার ভাইয়ের বৌ করে লাকি বেগমকে তাদের বাড়ি নিয়ে যায়। তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে ২য় বিয়ের ব্যবস্থা করে দেয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে ঘাতক জহির কোহিনুরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। মাঝে মধ্যে হুমকি-ধমকি দিলেও বাড়ির লোকজন তা তোয়াক্কা করেনি। এ ঘটনার খেসারত এভাবে প্রাণের বিনিময়ে দিতে হবে তা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি।

এদিকে কোহিনুর বেগমকে কুপিয়ে হত্যাকারী মূল ঘাতক জহিরুল ইসলামকে শুক্রবার রাতে চট্রগ্রাম থেকে আটক করে পুলিশ। বিষয়টি শনিবার (২৭ এপ্রিল) সকালে নিশ্চিত করেছেন শাহরাস্তি থানা অফিসার ইনচার্জ মোঃ শাহ আলম। এর আগে পুলিশ ঘটনার পরপরই জহিরুল ইসলামের মা বাবা ও ভাইকে আটক করে জেলহাজতে প্রেরণ করেন।

প্রসঙ্গত, গত ১৮ এপ্রিল রাত ২টায় সিঁদ কেটে জহির নামে বাড়ির সম্পর্কের এক ভাসুর ঘরে ঢুকে ছুরি দিয়ে জখম করে কোহিনুরকে। তিনদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ার পর অবশেষে ২২ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোহিনুর মৃত্যুবরণ করেন।

বার্তা কক্ষ
২৭ এপ্রিল ২০১৯

Share