বাংলাদেশে ২৪ ঘণ্টা নিউজ চ্যানেলের দিন মোটামুটি একটা লম্বা সময়ের জন্য বলতে গেলে শেষের দিকে, বা শেষ হয়েছে। মানুষ টিভি দেখছে না। প্রযুক্তির কারণে এমনিতেই টিভি দেখা কমছে। তার সাথে যোগ হয়েছে নিউজে অরুচি।
দিন দিন টিভি ভিউয়ারশিপ আরও কমতে থাকবে। পত্রিকা মালিকরাও এরইমধ্যে তলে তলে বেশ উদ্বিগ্ন। গত কয়েক মাসে নাকি বেশ বড়োসড়োভাবে পাঠকের ধ্বস নেমেছে। আরও অনেক অনেক ধ্বস নামবে।
বিজ্ঞাপনদাতারা এমনিতেই প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রোনিক মিডিয়ার চেয়ে ফেসবুক/ইউটিউবে ঝুঁকছেন অনেক দিন ধরেই। নামিধামি কোম্পানিগুলো ফেসবুকে বুস্ট (বিজ্ঞাপনের জন্যে ফেসবুককে অর্থায়ন) করছেন। এটা সারা দুনিয়ায়ই হচ্ছে।
কিন্তু আমাদের এখানে ট্রাডিশনাল মিডিয়ার ভিউয়ারশিপ ও রিডারশিপ যেভাবে কমছে, তাতে লোকাল বিজ্ঞাপনদাতারা আরও নাক সিটকানো শুরু করবে আস্তে আস্তে। বিজ্ঞাপনের রেট কমতে থাকবে এখানে।
ট্রাডিশনাল মিডিয়ার জন্য ওরা ওদের ইয়ারলি মার্কেটিং বাজেট কমিয়ে দেবে। নিউজ চ্যানেলগুলো পরিসর ছোট করতে থাকবে। এন্টারটেইনমেন্ট-নির্ভর চ্যানেলগুলোতে নিউজ ডিপার্টমেন্ট আরও গৌণ হতে থাকবে। এরইমধ্যে চ্যানেল নাইন তাদের সংবাদ ডেস্ক প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তারা এখন খেলা ও বিনোদন নির্ভর প্রোগাম দেখাবে বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে তাদের সংবাদকর্মীদের জানিয়ে দিয়েছে।
এভাবেই সাংবাদিকদের চাকরির সংখ্যা কমতে থাকবে। পত্রিকাতেও একই অবস্থা হবে, হচ্ছে। ৯ম ওয়েজবোর্ড করার জন্য চাপ আছে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে। সরকারপন্থীরা এই দাবিতে সরব থাকার কারণে হয়তো বাস্তবায়ন হবে মালিকদের নাখুশির মধ্যে। আয় কমছে, ব্যয় বাড়ছে। মালিককে ব্যালেন্স করার চেষ্টা করতে হবে। এতে নতুন করে সংবাদকর্মী ছাটাই শুরু হবে অনেক জায়গায়।
সবাই অনলাইনে গুরুত্ব বাড়াচ্ছে, এবং আরও বাড়াবে। কিন্তু যেহেতু পাঠকের আকাঙ্ক্ষা মেটাতে পারছে না, পারবে না- তাই অনলাইনেও ‘নিউজ-নির্ভর’ বাংলাদেশি আউলেটগুলোর গুরুত্ব কম হবে। গুরুত্ব বাড়ছে এবং বাড়তে থাকবে এন্টারটেইনমেন্ট-নির্ভর আউটলেটের। মূলত আয়-ইনকামই নির্ধরণ করছে, করবে গুরুত্ব। নিউজের কন্টেন্টে পাবলিক হিট কম করবে, ফলে টাকা কম আসবে। ফলে গুরুত্ব কম।
নাটক পাবলিক বেশি দেখবে, টাকা বেশি আসবে। ফলে নাটকের গুরুত্ব বেশি হবে। মোট কথা, অনলাইনের গুরুত্ব বাড়লেও অনলাইনে সাংবাদিকদের গুরুত্ব তেমন বাড়বে না।
এদিকে অনলাইনে বিজ্ঞাপনদাতারাও নিউজের কন্টেন্টে বিজ্ঞাপন দেয়ার ক্ষেত্রে খুবই সিলেক্টিভ। একটু ভায়োলেন্ট কিছু থাকলে, বেশি পলিটিক্যাল ইস্যু হলে (বিশেষ করে কোনো কনফ্লিক্ট জোন নিয়ে) নোটিশ দিয়ে বিজ্ঞাপন অফ করে দেয়। তারা নিউজের বাইরের কন্টেন্টে বিজ্ঞাপন দিতে বেশি আগ্রহী (এটা শুধু বাংলাদেশ না, গ্লোবালি এমনটা হচ্ছে)।
দেশের সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকতার ওপর পাবলিক আস্থা মারাত্মকভাবে কমে গেছে। পাবলিক পারসেপশনে (জনমতে) সাংবাদিকদের বেশিরভাগই- দালাল, দুর্নীতিগ্রস্ত। আর একাংশের এবিলিটি বা সততার ওপর আস্থা থাকলেও তাদের অক্ষমতা ব্যাপারে পাবলিক ওয়াকিফহাল। ফলে অনেক সত্য খবরও শুধু বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমে পাবলিশ হওয়ার কারণে মানুষজন বিশ্বাস করতে চায় না। অনেক গুজবকে মূলধারার মিডিয়া এভয়েড করলেও পাবলিক সেগুলো বিশ্বাস করতে চায়।
প্রথম আলো, ডেইলি স্টার প্রতিনিয়তই কম্প্রোমাইজ করে চলছে। সময়ের সাথে সাথে কম্প্রোমাইজ আরও বাড়বে। এ দুটি পত্রিকা লস প্রজেক্ট হতে সময় নিলেও শেষ পর্যন্ত হতে বাধ্য হবে। পাঠকের চাহিদা আর অথরিটির চাহিদা একসাথে পূরণ করা সম্ভব না।
বাংলাদেশের মানুষ যে, নিউজ বা নিউজ সংক্রান্ত প্রোগ্রামাদি দেখা কমিয়ে দিয়েছে তা কিন্তু নয়। মানুষ কমিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশি মিডিয়ার নিউজ বা নিউজ সংক্রান্ত প্রোগ্রামাদি দেখা। মানুষ বাইরের মিডিয়ার ওপর আস্থা রাখছে। কোটা সংস্কার/ছাত্র আন্দোলনের সময় হাজারো ছেলে মেয়ে দেশি মিডিয়ার বিরুদ্ধে হ্যাশট্যাগ চালু করে, এবং বিদেশি মিডিয়াকে তাদের খবর কভার করতে অনুরোধ করে হ্যাশট্যাগ ভাইরাল করেছিলো। বিদেশি ব্লাগার/সেলিব্রিটিরা তাদের আহ্বান সাড়াও দিয়েছিল। নির্বাচনের সময়ও এমনটা দেখা গেছে, বাইরের মিডিয়ার দিকে মানুষের চেয়ে থাকা।
বিদেশি মিডিয়ায় বাংলাদেশ সংক্রান্ত খবরাদি মানুষ দেখে/পড়ে। গত সপ্তাহে আল জাজিরার একটা অনুষ্ঠানকেই উদাহরণ হিসেবে নেয়া যায়। হেড-টু-হেডে আল জাজিরার নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে সবচেয়ে বেশি ভিউ হওয়া এপিসোডটি (রিচার্ড ডকিন্সের সাথে) দেড় মিলিয়নের কিছু বেশি মানুষ দেখেছেন (৬ বছরে)। গত ৭ দিনে বাংলাদেশ নিয়ে করা এপিসোডটি (গওহর রিজভীর সাথে) ৬ লাখ মানুষ দেখে ফেলেছেন।
ভারত-পাকিস্তান-আরব ওয়ার্ল্ড এবং বৈশ্বিক গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ইস্যুতে করা অন্যান্য ৫/৬টি এপিসোড কয়েক বছরে মিলিয়নের কোটায় ভিউ হয়েছে। মোট ৪৩টি এপিসোডের তুলনায় বাংলাদেশের এপিসোডটির ভিউ অনেক অনেক বেশি- টপ ১০/১২ এর মধ্যে চলে এসেছে।
অথচ বাংলাদেশ ওয়ান পার্টি স্টেট হয়ে ওঠেছে- এটি গ্লোবাল, এমনকি রিজিওনাল কোনো আলোচিত ইস্যুও নয়। এটা একান্তই বাংলাদেশের জাতীয় ইস্যু। এই দেশের মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এপিসোডটির এত বেশি (তুলনামূলক) ভিউ হওয়ার মানে, দেশে-বিদেশে থাকা বাংলাদেশিরাই এটি বেশি দেখেছেন।
যদি এটির ভাষা ইংরেজি না হয়ে বাংলা হতো তাহলে তা এরইমধ্যে দেশি যে কোনো জনপ্রিয় নাটকের ভিউর চেয়ে কম হতো না। সাধারণত জনপ্রিয় নাটকগুলো প্রথম সপ্তাহখানেকের মধ্যে ২ থেকে ৪ মিলিয়ন ভিউ হয়ে যায়! দেশি চ্যানেলে এমন প্রোগ্রাম প্রতিদিন হলেও মানুষ লাইন ধরে দেখতো।
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা বেঁচে থাকার একটা উপায় আছে। বিদেশে বসে পত্রিকা চালানো। কনফ্লিক্টে আক্রান্ত অনেক দেশের ভালো ভালো কিছু মিডিয়া এরকমভাবে চলছে। ছোট পরিসরে হলেও ভালো মানের অনলাইন নিউজপেপার চালানো খুব সম্ভব। অথবা ইউটিউব কেন্দ্রিকও প্রফেশনাল কাজ হতে পারে, তবে বিদেশে বসে। এরকম মডেলে চালালে দেশ থেকে প্রচুর তথ্য পাওয়া যায়।
দেশে সাংবাদিকতায় এখন মেধাবী ও ভিশনারী যারা আছে এরা প্রফেশন বদলাতে বাধ্য হবে (বদলাচ্ছে), বা মিইয়ে যাবে। এক্ষেত্রে সিনিয়রদের মুশকিল বেশি। তাদের নতুন করে যাওয়ার যায় পাওয়া টাফ। জুনিয়রদের মধ্যে নাছোড়বান্দারা বিদেশি গিয়ে এই ফিল্ডে কিছু করতে চেষ্টা করতে পারে।
নতুন করে এখানে মেধাবীরা আসবে না। স্বল্প মেধার অল্প টাকায় চলার এবং দুই অথোরিটির অনুগত দাস টাইপের লোকজন আসবে ও টিকতে পারবে। কারণ ভালো মতো দাসগিরি করতে পারলে টাকা পয়সার অভাব হবে না!
আরো অনেক ব্যাপার স্যাপার আছে। তো, সব মিলিয়ে হ্যাপি সাংবাদিকতা! শুধু, মেধাবী ও স্বপ্নদেখা তরুণ-তরুণী সাবধান!
সম্পাদকীয়
১১ মার্চ, ২০১৯