ফিচার

দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলী চাঁদপুরের হরিপুর জমিদার বাড়ি

হরিপুর জমিদার বাড়ির ছবিটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই দেখেছি। সাথে ছবির নিচে জুড়ে দেয়া সামান্য কিছু তথ্য। সেখানে উল্লেখ করা হয় বাড়িটি চাঁদপুর সদরেই অবস্থিত।

ছেলেবেলা থেকেই আমি একটু কৌতুহলি আর ঘোরাঘুরি স্বভাবের একজন মানুষ। তবে কৃতিম সৃষ্টির চেয়ে ঐতিহাসিক আর প্রাকৃতিক সুন্দরই আমায় বেশি করে ডাকে। স্থির করলাম সময়-সুযোগ করে সহসাই ঐতিহাসিক স্থানটি দেখতে যাবো।

এরই মধ্যে খবর এলো হরিপুর গ্রামের পাশ্ববতী ইউনিয়নে ভারতীয় হাই কমিশনার আসছেন। পত্রিকা অফিস থেকে নিউজটি কভারেজ করার জন্য আমাকে দায়িত্ব দেয়া হলো। একি ! সৌভাগ্য আমার,সময় আর সুযোগটা মিলেমিশে একাকার। খুশি হলাম এ ভেবে, ‘রথ দেখা আর কলা বেচা এক সাথেই হয়ে যাবে। ফোন দিলাম পাটওয়ারী লিটনকে। লিটন ঘুরে বেড়ানোর পাগল খুব। অবসরের আড্ডায়- প্রায়ই সে বলে, ‘কেত্থাও ঘুরতে গেলে আমারে নিয়া যাইস।’ ঘুরে রেড়ানোটা আমার মতো তারও অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে।

ফোনে কথাটা শোনামাত্রই পাওয়ারী লিটন প্রত্যাশিতভাবে খুশির সাথেই সম্মতি প্রকাশ করলো। শরতের আকাশ সাক্ষী রেখে আমরা দু’জন মোটরবাইকে চেপে ছুটে চললাম। তবে কোথায় যাচ্ছি-এ কথা লিটনকে গোপন রাখা হলো। শহরের যানজট আর গ্রামীণ মাঠ-ঘাট পেছনে ফেলে ঠিক এগারোটায় আমরা পৌঁছে গেলাম সদরের ফরাক্কাবাদ ডিগ্রি কলেজে।

দেখি হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা এখনো আসেন নি। ভাবলাম একফাঁকে খোঁজ নিয়ে আসি-বাড়িটি কোন গ্রামে অবস্থিত। কিন্তু এত অল্প সময়ে এমন একটি স্থানের ঘ্রাণ নেয়া যাবে না ভেবে অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার অপেক্ষায় রইলাম।

তাছাড়া সামান্য তথ্যে স্থানটি খুঁজতেও অনেক সময় লাগবে। অনুষ্ঠান শেষে বিকেল চারটায় রওনা দিলাম। জমিদার বাড়ির কথা শুনে আমাদের সাথে যোগ দিলেন সাংবাদিক মুহাম্মদ আলমগীর,পলাশ কুমার দে ও লেকক সুমন কুমার দত্ত।

আমরা ছুটছি গ্রামের পথ ধরে। চোখ-মুখ স্পর্শ করে সাঁই সাঁই ছুটে যাচ্ছে আউলা বাতাস। শরৎ ঋতুর এ এক মুন্সিয়ানা, হঠাৎ মেঘ, হঠাৎ বৃষ্টি। তবে ভাগ্যক্রমে দিনটা আমাদের অনুকলেই ছিলো। বালিয়া ইউনিয়ন থেকে মাত্র পনের মিনিটে আমরা পৌঁছে গেলাম চান্দ্রা ইউনিয়নে।

চান্দ্রা-ফদিগঞ্জ রোড় ধরে বাইক ছুটছে। পথিমধ্যে একজন পথচারীকে জিজ্ঞোস কলাম বাখরপুরটা কোন দিকে। ভুল করে হরিপুরের স্থলে বাখরপুর বলার খেশারত তাই দিলো হলোই। পথচারী সোজা পথ দেখিয়ে দিলেন। আমাদের দু’টো বাইক ছুটছে তো ছুটছেই। প্রায় দশ মিনিট ছুটার পরে হঠাৎ বাইক থামিয়ে দিলাম। এবার আরো একজন পথচারীকে জমিদার বাড়ির কথা জিজ্ঞেসে যে উত্তর শুনেছি ত কে দাঁতে জিব কাঁমড় দেয়া ছাড়া উপায় ছিলো না।

লোকটা বললেন ‘জমিদার বাড়ি তো বাখরপুর নয়, এটি হরিপুর। সেটি আপনারা পেছনে ফেলে এসছেন।’ কি আর করা, পুনরায় পেছনে ছুট। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা হরিপুর জমিদার বাড়ি পৌঁছে গেলাম। বলে রাখা ভালো,বড় রাস্তা থেকে হরিপুর প্রবেশের রাস্তাটি খুব বেশি সুস্থ নয়। সুবিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা জমিদার বাড়িটি স্থানীয়ভাবে চৌধুরী বাড়ি নামে পরিচিত। বাড়ির অদূরে পা ফেলেই বুঝতে পারলাম এ জমিদাররা নিজ এলাকায় এতো সম্মানিত-পরিচিত কোনো। মূল বাড়িতে প্রবেশের আগেই চোখে পড়লো বিশাল দ’ুটি দিঘী- শান বাঁধানো ঘাটলা, স্কুল, মাদ্রাসা, এতিমখানা, সুদৃশ্য মসজিদ ও ঈদগাহ মায়দান।
জমিদার হলেও প্রজাদের সাথে সুন্দর সম্পর্ক, নিজ এলাকায় জনকল্যাণ কর্ম, শিক্ষা বিস্তার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় তাদের যে ভূয়সি প্রশংসা শুনেছি, তার প্রমাণ মিললো। মূল ফটক পার হতেই অবাক হয়ে গেলাম।

দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলীর দু’টো দালান পাশাপাশি। যার একটির গায়ে লেখা শহিদ মঞ্জিল, আপরটি মতি মঞ্জিল। ইট, সুরকি আর রড দিয়ে গড়ে তোলা দ্বিতল ভবন দু’টোর শরীর নান্দনিক কারুকার্য খচিত। মানুষের সৃষ্টিরকর্মও যে এতোটা সুন্দর আর অপূর্ব হতে পারে, না দেখলে তা প্রকাশ করা কঠিন। বাড়ি ভেতরে যতোটা প্রবেশ ঠিক ততোটাই মুগ্ধতা!

একটি বাড়ির ভেতরে ৭ টি ভবন। আমরা তো রীতিমতো অবাক। সম্ভবত এটিই চাঁদপুরের সবচেয়ে বড় জমিদার বাড়ি। বাড়ির পারপাশে প্রায় ১৮ টি দিঘি রয়েছে। পুরো বাড়িজুড়ে নানা জাতের বৃক্ষরাজি। পাতাদের ফাঁকগলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে সূর্যের হলদে আলো। নাম না জানা হরের পাখির কিঁচির-মিটির শব্দে মনে এক অদ্ভুত আনন্দ খেলে যাচ্ছে।

ইতিহাস থেকে তথ্য নিয়ে জানতে পারি, ব্রিটিশ শাসনামলে ব্রিটিশদের দেশ ছাড়া করতে যে সিপাহী বিদ্রোহ আন্দলোন হয়েছে তার প্রথম সারির নেতা ছিলেন তনু রাজা চৌধুরী। যার হাত ধেরে এ বাড়িটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সিপাহী বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশদের ধরপাকড়ে তনু রাজা চৌধুরী চাঁদপুর সদরের চান্দ্রা নামক এ ইউনিয়নে আত্মগোপন করেন।

এরপর এখানেই তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং জমিদারী দায়িত্ব পান। জমিদার তনু রাজা চৌধুরীর একমাত্র সন্তানের নাম আলী আজগর চৌধুরী। পিতার মৃত্যুর পরে পনবর্তীতে তিনি জমিদারিত্ব পান। ১৯ শতকের মাঝামাঝি ব্রিটিশ শাসনামলে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে এ জমিদার বাড়ির জমিদারিত্ব ইতি ঘটে।
আলী রাজা চৌধুরী ছিলেন সাত সন্তানের জনক। এ সাত সন্তানের নামে ৯টি ভবন গড়ে তোলা হয়। প্রতিটি ভবনের গায়ের কারুকার্য খচিত নাম লেখা। তাঁরা হলেন – মতি রাজা চৌধুরী, উমেদ রাজা চৌধুরী, কামিজ রাজা চৌধুরী, হামিদ রাজা চৌধুরী, মোহাম্মদ রাজা চৌধুরী, প্রেম রাজা চৌধুরী ও গোলাম রাজা চৌধুরী। তাদের সবাই এখন মৃত। তবে তনু রাজা এবং তার একমাত্র ছেলে ও সাত নাতির জীবদ্দশার গুণকর্মের মাধ্যমে আজও সারা দেশে সুনামের সাথে পরিচিত।

চৌধুরী বংশের অনেকেই দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন এবং এখনও আছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্যরা হলেন- ঢাকার প্রাক্তন বিভাগীয় কমিশনার মরহুম আমিন মিঞা চৌধুরী, বিশিষ্ট রাজনীতিবীদ ও ফরক্কাবাদ ডিগ্রি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ মরহুম মমতাজ উদ্দিন চৌধুরী , চান্দ্রা ইউপির প্রাক্তন চেয়ারম্যান মরহুম আ. বাসেত চৌধুরী, মরহুম আ. রশিদ চৌধুরী, ঢাকার খিলগাঁও থানার প্রাক্তন অফিসার ইনচার্জ, মরহুম গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী , জনশক্তি ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন যুগ্ম-সচিব, আ.রাজ্জাক চৌধুরী, অর্থ মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম-সচিব রুবিনা ইসলাম চৌধুরী।

আমরা ভেতরে প্রবেশ করে প্রথমে ভেবেছিলাম এখানে মানুষের খুব একটা বসবাস নেই। কারণ সুবিশাল বাড়িটি জুড়ে নীরবতা ছিলো । আমাদের গলার স্বর শুনেই মধ্য বষয়ের একজন পুরুষ ছুটে এলেন। পরিচিত হয়ে জানতে পারলাম, তিনি জমিদারদের চতুর্থ পুরুষ। গোফরান চৌধুরী নামের লোকটা আমাদের জানালেন, ‘বাড়ির বংশধররা খুব একটা এখানে থাকেন না। সবাই তারা তাদের কর্মজীবন নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায়, শহরে এবং কেউ কেউ বিদেশে অবস্থান করছেন। বর্তমানে বিশালায়তনের বাড়িটিতে জমিদারদের ৭-৮টি পরিবার বসবাস করছে। চাঁদপুরের ঐতিহাসিক চৌধুরী ঘাট ও চৌধুরী মসজিদ তাদের নামে নামকরণ করা হয়েছে।’

এরপর তিনি আমাদের অনেকটা সন্তান ¯েœহে একটার পর একটা করে ঘুরিয়ে দেখালেন জমিদার বাড়ির প্রতিটি ভবন, পূর্বপুরুষদের গড়ে তোলা চৌধুরী বাড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্প উইথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গাজীপুর ছোরিয়া ফাজিল মাদ্রাসা, চৌধুরী বাড়ি হাফেজিয়া মাদ্রাসা।

সবশেষে তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন চৌধুবাড়ি মসজিদ ও কবরস্থানে। প্রতিটি কবরের সামনের দেয়ালে ইট-সুরকিতে খচিত করে লেখা রয়েছে চৌধুরী বাড়ির পূর্বপুরুষদের নাম। অল্পভাষী পলাশ কুমার দে প্রতিটি ভবনের দেয়ালে হাত রেখে কিছু একটা অনুভব করার চেষ্টা করছেন। সুমন কুমার দত্ত ঐতিহাসিক এ বাড়ির সাথে নিজেকে ক্যামেরায় বন্দি করতে একের পর এক সেলফি তুলে যাচ্ছেন।

ক্ষাণিক পর পর বিশেষ স্থানে দাঁড়িয়ে ভিডিও চিত্র ধারণ ও কণ্ঠ দিচ্ছেন। ওদিকে পাটওয়ারী লিটন বিভিন্ন ভঙ্গিতে ভবনদের স্থিরচিত্র ধারণ করতে লাগলো। মুহাম্মদ আলমগীর ভাই বাড়ির লোকদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে লাগলেন। একটা সময় উপলব্ধি করলাম, রবি মামা দিনকে বিদায় জানিয়ে অস্থ যাচ্ছেন। ফলে দিনের আলো কমে আসতে শুরু কলো। আমরাও একমত হলাম এবার ফেরার পালা।

কীভাবে যাওয়া যায়: নৌপথ,সড়কপথ কিংবা রেলপথ-এ তিনিটি মাধ্যমেই চাঁদপুর আসা যায়। ঐতিহাসিক এ বাড়িটি চাঁদপুর জেলা সদরের চান্দ্র ইউনিয়নের হরিপুর মদনা গ্রাামে অবস্থিত। ফলে যে কেউ চাইলেই,চাঁদপুর শহরে এসে সিএনজিযোগে অনায়সেই যেতে পারেন হরিপুর জমিদার বাড়িতে।

লঞ্চযোগে ঢাকার সদর ঘাট থেকে চাঁদপুর আসতে ভাড়া পরবে জনপ্রতি ডেকে ১ শ’ টাকা। এছাড়া প্রথম শ্রেণি লঞ্চের প্রকার ভেদে ২শ’৫০ থেকে ৩ ম’ টাকা । কেবিন সিঙ্গেল ৪ শ’,এসি ৫ শ’-ডাবল কেবিন ৮শ’, এসি ৯শ’। সেখান থেকে সিএনজি ভাড়া করার ব্যবস্থা রয়েছে। সিএনজিতে চৌধুরী বাড়ি যেতে খরচ পড়বে পরবে ১শ’৫০ থেকে ২ শ টাকা ।

লেখক : আশিক বিন রহিম,
সাংবাদিক ও সাহিত্যকর্মী,
চাঁদপুর ।
৮ নভেম্বর, ২০১৮ বৃহস্পতিবার

Share