‘হিরো আলম কে? কাক খুঁজিচ্চেন? হিরো আলমকে চিনি না।’ পরে চেহারার বর্ণনা দিয়ে মোবাইলে ছবি দেখাতেই বলে উঠলেন- ‘ও এডা তো ডিশ আলম। উই আবার হিরো আলম হলো কদ্দিন। ওই… যে ওই বাড়িত থাকে। ডিশের ব্যবসা করে। কিছু বিটিছোল (মেয়ে) লিয়্যা মিউজিক ভিডিও বানায়। হামরা অবশ্য অল্ল্যা দেকি না। শুননু এমপির ভোটোত খাঁড়া হচ্ছে। কয়েক দিন ধরে পেপারোত লিউজ বারাচ্চে।’
হিরো আলমের বাড়ি খুঁজতে গেলে তার বাড়ি থেকে ৫শ গজ দূরে অবস্থিত ফার্নিচার দোকানের মালিক শহিদুল ইসলাম এভাবেই বলছিলেন।
তার নির্দেশনা অনুসারে বাড়িতে গিয়ে দেখা মেলে হিরো আলমের বাবা আব্দুর রাজ্জাক (সৎবাবা), মা আশরাফুন বেগম, স্ত্রী সাবিহা আক্তার সুমি, বড় মেয়ে ২য় শ্রেণির ছাত্রী আলোমনি, মেজো মেয়ে ১ম শ্রেণির ছাত্রী আঁখি আলো এবং চার বছরের ছেলে আবির হোসেনের।
হিরো আলমের বাবা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ওর বাবা আহম্মদ মারা গেলে আমি আশরাফুন বেগমকে বিয়ে করি। এরা তিন বোন ও এক ভাই। নিজের ছেলে-মেয়ের মতোই তাদের মানুষ করেছি। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। আলমের ডিশের ব্যবসা রয়েছে। এই ব্যবসাটি মূলত তিনিই দেখাশোনা করেন। আলম ইচ্ছা মতো টাকা উড়ায়। মিউজিক ভিডিও বানানোর নামে রাতদিন পড়ে থাকে নানা জায়গায়। বাড়িতে বাবা-মা, স্ত্রী সন্তানদের কোনো খোঁজ রাখে না।
আপনার ছেলেতো অনেক বড় সেলিব্রিটি। ইউটিউবে তার ভিডিওর ভিউয়ার্স সংখ্যা ১ কোটি ১০ লাখ। তার আইডি সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ৮৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন তুলেছেন।
এসব বলতেই হিরো আলমের বাবা বলেন, ‘কিসের সেলিব্রিটি, ভাইরাল? এগুলা কি? হামরা তো অতো কিছু বুঝি না। বাড়ির, ছোলপোলের খোঁজ লেয় না আবার এমপির ভোট করিচ্চে। অক কাহালু নন্দীগ্রামের কে চেনে? আসলে এগলা অর ট্যাকা খাওয়ার জন্য কিছু মানুষ ভুল বুঝে অক ল্যাচা (নাচা) লিয়্যা বেড়াচ্চে’।
আলমের মেয়ে আলোমনি জানে না তার বাবা এখন কোথায়, কি করছে? বাড়ির কোনো খোঁজ রাখে না সে।
এরুলিয়া ইউনিয়নের জনপ্রিয় চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ মণ্ডল। পরপর পাঁচবার তিনি ওই এলাকার চেয়ারম্যান। হিরো আলমের বিষয়ে জানতে চাইলে এক গাল হেসে বলেন, ‘এক বছর আগে ওর শালি (স্ত্রীর ছোট বোন) বিলকিসকে নিয়ে পলাসলো। সেই বিচার করে দেয়া লাগছে। আর বিচার তো হামার মাঝে মধ্যেই করা লাগে। ট্যাকা লিয়্যা দু-একদিন পরপরই ঝামেলা লাগায়। তারপরও এলাকার ছোল, ভালোই আছলো। শুনলাম আবার নির্বাচন করিচ্ছে। আসলে মাতাপাগলা হলে ইংকাই হয়। এটি মেম্বরত উটবার পারেনি। আবার জাতীয় লির্বাচন। আসলে এনা ট্যাকা হচে তো। গরমে থাকপার পারিচ্চে না।’
বগুড়ার এরুলিয়া ইউনিয়নের আরজি পলিবাড়ি এলাকা। মূল সড়ক পার হয়ে ছোট একমুখো পথের সড়কটি মূলত কাঠ ব্যবসায়ীদের দখলে। সেই সুবাদে সেখানে গড়ে উঠেছে কাঠের ফার্নিচার তৈরির ব্যবসা।
হিরো আলমের বাড়ির ঠিক সামনের বাড়ির বয়স্ক তিন নারী বলেন, ‘ওই দেকেন এখনো গাছত আলমের পোস্টার ঝুলিচ্চে। মেম্বর ভোট করার পোস্টার। হামরা এলাকার মানুষ হিসেবে ভোট দিসনু। তাও উটপার পারেনি। তবে ছোলডা ভালো। খালি এনা বিটিছোলপোল লিয়্যা নাচ গান করার অব্যাশ (অভ্যাস) আছে।’
বর্তমান সময়ে অন্যতম আলোচিত বগুড়ার হিরো আলম। ফেসবুক ও ইউটিউবে ভিডিও আপলোডের মাধ্যমে আলোচনায় আসেন তিনি। সম্প্রতি সংসদ সদস্য পদে মনোনয়নপত্র তুলে দেশের মতো নন্দীগ্রাম-কাহালুতেও আলোচনায় এসেছেন।
চায়ের দোকান থেকে শুরু করে অফিসপাড়ায় তাকে নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। যারা তাকে দেখেননি তারা নতুন প্রজন্মের কাছে নাম শুনেই চিনে নিচ্ছেন। আসলেই তিনি আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে মহাজোটের প্রার্থী হতে পারবেন কি-না তা নিয়েও চলছে হিসাব-নিকাশ।
প্রতিদিন বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে তিনি লাইভ অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন। নিজেকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে জনসমর্থনের কথা বলছেন। কিন্তু বাস্তব চিত্র কি? সেটি খুঁজে বের করতেই অনুসন্ধান চালানো হয় হিরো আলমের নিজের বাড়ি এরুলিয়া ও নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া কাহালু ও নন্দীগ্রাম উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এলাকার তরুণ প্রজন্ম হিরো আলম সম্পর্কে জানলেও প্রবীণরা তাকে চেনেন না। প্রবীণদের কাছে হিরো আলম সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তারা বলেন বর্তমান প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা যেভাবে এলাকায় গণসংযোগ করছেন হিরো আলম বগুড়া-৪ আসনে গণসংযোগ করেননি। এমনকি তার নিজ দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই।
তথ্যমতে, হিরো আলম লাঙ্গল প্রতীকে যে আসনে লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন সেই বগুড়া-৪ নন্দীগ্রাম-কাহালু উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসন। এ আসনে এবার ভোটার ৩ লাখ ১২ হাজার ৮১।
২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শহীদুল আলম দুদু (নৌকা) প্রতীকে ৭২ হাজার ৪৬৪ ভোট পান এবং বিএনপি থেকে ডা. জিয়াউল হক মোল্লা (ধানের শীষ) প্রতীকে ১ লাখ ১৪ হাজার ৮১৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন।
২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের বগুড়া জেলা কমিটির সভাপতি একেএম রেজাউল করিম তানসেন (নৌকা) প্রতীকে ৭৫ হাজার ৯৯১ ভোট পান এবং বিএনপি থেকে ইঞ্জিনিয়ার মোস্তফা আলী মুকুল (ধানের শীষ) প্রতীকে ১ লাখ ৩১ হাজার ৪১৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন।
২০১৪ সালের নির্বাচনে নন্দীগ্রাম উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি হাজি নূরুল আমিন বাচ্চু (লাঙ্গল) প্রতীকে ১৩ হাজার ৪৮৯ ভোট পান এবং বগুড়া জেলা জাসদের সভাপতি একেএম রেজাউল করিম তানসেন (মশাল) প্রতীকে ২২ হাজর ২০৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন।
এবার হিরো আলমের বিপক্ষে প্রার্থী রয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য কেন্দ্রীয় জাসদের সহ-সভাপতি একেএম রেজাউল করিম তানসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ মমতাজ উদ্দিন, সাবেক উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইউনুছ আলী, কাহালু উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন কবিরাজ, বগুড়া জজ আদালতের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) হেলালুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আলহাজ অধ্যাপক আহছানুল হক ও আওয়ামী লীগ নেতা রেজাউল করিম।
বিএনপি থেকে সাবেক সংসদ সদস্য ডা. জিয়াউল হক মোল্লা, সংসদ সদস্য জেডআইএম মোস্তফা আলী মুকুল, জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট রাফি পান্না, জিয়া শিশু-কিশোর সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি আলহাজ মোশারফ হোসেন, জেলা বিএনপির ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক মাওলানা ফজলে রাব্বী তোহা, পৌর বিএনপির সভাপতি আহসান বিপ্লব রহিম, জেলা যুবদলের সদস্য এমএ রাজ্জাক সুমন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সাবেক ছাত্রনেতা গোলাম আকতার জাকির, প্রবাসী বিএনপি নেতা মিন্টু ও আনিছুজ্জামান আনিছ। এছাড়া জাতীয় পার্টি থেকে উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি হাজি নূরুল আমিন বাচ্চুও মনোনয়ন তুলেছেন।
নন্দীগ্রাম উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি হাজি নূরুল আমিন বাচ্চু বলেন, নির্বাচনী এলাকায় হিরো আলমের কোনো জনপ্রিয়তা নেই। তাকে কেউ চেনেই না। হিরো আলমকে মনোনয়ন দেয়ার প্রশ্নই উঠে না।
কাহালু উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি ইব্রাহিম আলী ধুলু বলেন, কে এই হিরো আলম। এটা কি যাত্রা পার্টি নাকি? নাচ-গান করলেই মনোনয়ন পেয়ে যাবে। দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে হিরো আলমের কোনো যোগাযোগ নেই। হঠাৎ করেই মনোনয়ন তুলেছে পত্রিকা-টিভিতে দেখছি। তাকে তরুণ প্রজন্ম ভালো চিনতে পারে। কিন্তু ইউটিউব, ফেসবুক আর ভোটের মাঠ এক কথা নয়।
গোপালপুর গ্রামের আব্দুল জলিল বলেন, ‘হামরা এই হিরো আলমক চিনি না। ক’দিন ধরে শুনিচ্ছি। হামরা ভোট আসলে যে নেতা এলাকাত উন্নয়ন করবি তাকিই ভোট দিমু।’
পৌর এলাকার রাজু আহম্মেদ বলেন, শুনেছি হিরো আলম সংসদ নির্বাচন করবেন। কিন্তু সে এখনও এলাকায় আসেননি। তবে তাকে ফেসবুকের মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণায় দেখেছি।
তৈয়বপুর গ্রামের মিঠু বলেন, ইউটিউব, ফেসবুকে হিরো আলম বিভিন্ন ধরনের ভিডিওতে দেখিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। ফেসবুকের জনপ্রিয়তা আর নির্বাচনের মাঠের জনপ্রিয়তা এক নয়। সেই হিসাব মতে, বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত এলাকায় যেখানে চারদলীয় জোট এবং মহাজোটের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয় সেখানে হিরো আলম সুবিধা করতে পারবে বলে মনে করি না।
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ২৮ নভেম্বর মনোনয়নপত্র দাখিল, ২ ডিসেম্বর বাছাই, ৯ ডিসেম্বর প্রত্যাহার এবং ৩০ ডিসেম্বর ভোটগ্রহণ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্প্রতি সবচেয়ে চর্চিত বিষয়গুলোর মধ্যে একটি হলো হিরো আলম। ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে তার ভিডিও ও ছবি। কি করে তৈরি হলেন এ হিরো আলম?
জানা গেছে, আশরাফুল আলম নামের এই হিরো আলম প্রথমে চানাচুর বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তখন তাকে মানুষ চিনতো চানাচুর আলম বলে। এরপর সিডি বিক্রি করতেন। তখন ছিলেন সিডি আলম। সেটা বেশ আগের ঘটনা। সিডি যখন চলছিল না তখনই মাথায় আসে ক্যাবল নেটওয়ার্ক ব্যবসার। ভাবলেন নিজ গ্রামেই সেটা করবেন। করেও ফেললেন। বগুড়ার এরুলিয়া ইউনিয়নের আশপাশের গ্রামেই শুরু হয় আলমের ডিশ ব্যবসা। এখনও লোকে তাকে ডিশ আলম নামেই চেনে। ভার্চুয়াল জগতে আসার পর তিনি হয়ে যান হিরো আলম। একের পর এক মিউজিক ভিডিও বানানো শুরু করেন আলম। নিজের ক্যাবল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সেগুলো প্রচারও করতেন তিনি।
স্থানীয় স্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন হিরো আলম। এরপর জীবিকার তাগিদে সিডি বিক্রি থেকে আলম ডিশ ব্যবসায় হাত দিয়ে সফলতা অর্জন করেন। সেখান থেকে এখন তার মাসিক আয় ৭০-৮০ হাজার টাকা।
সিডির ব্যবসা করতেন আলম। ক্যাসেটে দেখতেন মডেলদের ছবি। সেই থেকে মাথায় ঢোকে মডেল হওয়ার। ২০০৮ সালেই করে ফেলেন একটা গানের মডেলিং। সেটাই ছিল শুরু। এরপরে সেসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সংসারে মনোযোগী হন। ২০০৯ সালে বিয়ে করেন পাশের গ্রামের সুমী নামের এক তরুণীকে। আলম সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়লেও সুমী পড়েছেন এসএসসি পর্যন্ত।
হিরো আলম বলেন, আমার মডেল হওয়ার ইচ্ছা ছিল আগে। যখন সিডি বিক্রি করতাম। আমি জানি না এসব ইচ্ছা পূরণ হয় কি-না, তবে লেগে ছিলাম। হয়েছে। অনেকে বলে বাজে হয়েছে। তাতে আমি কান দেই না। অনেকে আবার বলে ভালোই হয়েছে।
নির্বাচন সম্পর্কে তিনি বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এবার আমি মাত্র ৭০ ভোটে হেরেছি। এর আগেরবারও হেরেছি অল্প ভোটে। তবে এলাকার মানুষের ভালোবাসার জন্য আমি আরেকবার নির্বাচন করবো। আমি বলেছিলাম আর দাঁড়াবো না, কিন্তু ভালোবাসার জন্য দাঁড়িয়েছি। (জাগো নিউজ)
বার্তা কক্ষ
১০ ডিসেম্বর,২০১৮