বিশেষ সংবাদ

অভাবের তাড়নায় বিক্রি করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে পাওয়া স্বর্ণের মেডেল

একজন শিল্পীকে তুলির আঁচড়ে কীভাবে আরও সুন্দর করে তোলা যায়, সেটাই ছিল তার একসময়কার প্রধান কাজ। নিজেকে গড়েছেন রূপসজ্জাকর হিসেবে। কিন্তু জীবনের নির্মম পরিহাস। এখন অর্থ উপার্জনের জন্য সেই মানুষটিকেই ঘুম ভাঙার সাথে সাথে হিসাব কষতে হয়, হাত পাততেই হয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে।

রোজই তিনি যান নতুন কোনো এলাকায়। উদ্দেশ্য, ভিক্ষা করে মানুষের কাছ থেকে দুই-চার টাকা পাওয়া। জীবিকার তাগিদে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া মেকআপ আর্টিস্ট এখন আঁধারে বন্দী।

অর্থের তাড়নায় বিক্রি করে দেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের সাথে পাওয়া স্বর্ণের মেডেলটিও। পিতলের আরেকটি মেডেল পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বিক্রি করতে না পারায় সেটিও ফেলে দেন। এ নিয়ে দুঃখবোধ হয় তার।

যার কথা বলা হচ্ছে, তিনি মেকআপ আর্টিস্ট কাজী হারুণ। তার রং-তুলির স্পর্শেই বহু তারকার জীবন রঙিন হয়েছে। সে সুবাদে তারা পেয়েছেন সুনাম, প্রতিপত্তি। নিজের কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন হারুণও।

এই রূপসজ্জাকরের ঝুলিতে রয়েছে ‘বেদের মেয়ে জোছনা’র মতো ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র। অথচ সেই মানুষটাকেই এখন সাফল্যের চিন্তা বাদ দিয়ে করতে হয় বেঁচে থাকার লড়াই।

হারুনের জীবনের আলোকশিখাটি দপ করে নিভে যাওয়ার গল্প শুনতে এই প্রতিবেদক হাজির হয়েছিল তার যাত্রাবাড়ীর চন্দনকোঠা এলাকার বাসায়। ১৬ অক্টোবর সকালে প্রিয়.কমের সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা আলাপ হয় তার। এ সময় একটু একটু করে খোলাসা হয় তার জীবনের উত্থান-পতনের গল্প।

এক কক্ষের স্যাঁতস্যাঁতে একটি বাড়িতে হারুণ ও তার স্ত্রীর বাস। সেই ঘরে বসে উত্থান-পতনের গল্প বলতে গিয়ে তার মুখটা যেন জীর্ণশীর্ণ ঘরের মতো হয়ে গিয়েছিল। চাপা কান্না যেন ঘিরে ধরেছিল, ধরে আসছিল গলা।

রুপালি পর্দায় যাত্রা শুরু ও বিদায়

হারুনের গল্পটা শুরু হয় চলচ্চিত্রে অভিষেককে কেন্দ্র করে। তিনি জানান, ১৯৭৯ সালে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু তার। এর প্রায় দেড় যুগ পর ১৯৯৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হৃদয় থেকে হৃদয়’ ছবির জন্য তিনি পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

২০০৯ সালে হঠাৎ ঝড়ে ধরাশায়ী হন হারুণ। মস্তিষ্কে তার রক্তক্ষরণ (ব্রেইন স্ট্রোক) হয়। এরপর থেকেই এ রূপসজ্জাকরের শরীরের ডান পাশ প্রায় পুরোটা অকেজো হয়ে যায়; সাথে ডান হাতও।

হারুণ অস্পষ্ট স্বরে কথা বলেন। যা বলেন, তার কিয়দংশ ঠাওর করা যায়। তাই শুরু থেকেই তার কথা বোঝার জন্য সহযোগিতা নেওয়া হয় স্ত্রী মহুয়া আকতার ও তার ভায়রা আবুল কাশেমের। তবে হারুণ কথা বলতে না পারলেও তিনি ঠিকঠাক শুনতে পান। কোনো তথ্য ভুল দিলে তা সাথে সাথে শুধরে দেন। এমন চিত্র পাওয়া গেল আলাপজুড়েই।

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া এ শিল্পীর দিনযাপন চলছে স্ত্রীর অন্যের বাড়িতে কাজ করে আয় করা ও নিজের ভিক্ষাবৃত্তির টাকায়। সামাজিক চক্ষুলজ্জার ভয়ে তিনি তার এলাকাতে খুব একটা ভিক্ষা করেন না। অন্য এলাকায় গিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিন সন্তানের জনক হলেও হারুণ তাদের কাছ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পান না বলে জানান। হারুণ মনে করেন, ভাগ্য তার সহায় হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হারুণের ছোট ছেলে ড্রাইভিং শিখছে। সে এখনো উপার্জনক্ষম হয়নি। আর বড় ছেলে পরিবারিক জটিলতার জের ধরে ৯ মাস ধরে কারাগারে রয়েছে। হারুণের একমাত্র মেয়ের বিয়ে হলেও সেদিক থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা পান না। জামাতার যে আয়, তা দিয়ে দুজনের সংসার কোনোরকমে চলে। তাই হারুণের মেয়ের পক্ষে বাবার সংসারে অবদান রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

হারুণের স্ত্রী মহুয়া জানান, ২০০৯ সালে তার স্বামীর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের পরপরই তিনি শয্যাশয়ী হয়ে যান। খাওয়া থেকে শুরু করে টয়লেট, সব বিছানাতেই করতেন তিনি। এরপর বছরখানেক যাওয়ার পর তিনি লাঠিতে ভর করে একটু একটু করে হাঁটতে লাগলেন। ততদিনে অর্থ সংকট প্রবল হয়ে দাঁড়ায়। জীবনটাও দুর্বিষহ হয়ে যায়।

মহুয়ার ভাষ্য, ‘তখন দেখি কোনো উপায় নাই, খাওন দিতে পারি না। তখন আমি বাসা থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিছি, বলছি যাও ভিক্ষা করে খাও। এরপর তিনি প্রায় এক মাস ঘরে ফিরেননি। তারপর নানান জায়গায় খুঁজছি তাকে। কিন্তু পাই নাই।’

‘পরে যখন বাসায় ফিরলেন, তখন জানলাম কমলাপুর স্টেশন চলে গিয়েছিল সেদিন। যেদিন ঘরে ফিরেছে, সেদিন পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে এসেছে। পরে জানতে পারি, সে স্টেশনে কাজ করে করে টাকা জমিয়েছে।’

মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের পর থেকেই গৃহবন্দী হয়ে যান হারুণ। সঞ্চয় করা অর্থ তিনি তার চিকিৎসায় ব্যয় করতে থাকেন। একটা সময় গিয়ে তাও শেষ হয়ে যায়। আর বাধ্য হয়েই ২০১১ সাল থেকে হারুণ ভিক্ষা করতে শুরু করেন।

অর্থের তাড়নায় বিক্রি করে দেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের সাথে পাওয়া স্বর্ণের মেডেলটিও। পিতলের আরেকটি মেডেল পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বিক্রি করতে না পারায় সেটি ফেলে দেন। এ নিয়ে দুঃখবোধ হয় তার।

মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের দিনের ঘটনা স্মরণ করতে গিয়ে চোখ ভার হয়ে যায় হারুণের। কিছুটা সময় নিয়ে সামলে নেন। এরপর অস্পষ্ট স্বরে কপালে দুটি থাপ্পড় দিয়ে বলেন, ‘আমি সেদিন যখন বাথরুমে গিয়েছিলাম, তখন বাসায় কেউ ছিল না। আমি ভেতরে গিয়ে পড়ে যাই। এরপর আর কিছু মনে নাই। পরে জানতে পারি, প্রায় তিন ঘণ্টা ওখানে ছিলাম। কারণ সে সময় বাসায় কেউ ছিল না।’

‘বাসায় আমার স্ত্রী আসার পর আমাকে খুঁজে না পেয়ে বাথরুমে গিয়ে দেখে ভেতর থেকে লাগানো, তখন সন্দেহ হয়। তারপর সে দরজা ভাঙার পর আমাকে দেখতে পায়। সেখান থেকে আমাকে বের করে। তারপর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর জানতে পারি, ব্রেইন স্ট্রোক করেছে।’

‘এরপর আর কোনো সিনেমাতে কাজ করতে পারি নাই। আমি যখন প্রবলেমে পড়ি, তখন সিনেমার কেউ কেউ আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু যেমন সহযোগিতা দরকার ছিল, সেটা পাই নাই।’

হারুন ও তার স্ত্রী অভিযোগ করে জানান, অসুস্থ হওয়ার পর রূপসজ্জাকারকে সাহায্য করেছিলেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অনেকেই। এর মধ্যে রয়েছেন মৌসুমী, ওমর সানী ও ইলিয়াস কাঞ্চন।

এই তিনজনসহ আরও অনেকের কাছ থেকে প্রায় দুই লাখ টাকা তোলা হয়েছিল বলে দাবি হারুণ ও তার স্ত্রীর। যাত্রাবাড়ীতে বসবাসকারী এক মেকআপ আর্টিস্টকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি টাকাটা দেননি।

এ বিষয়ে মেকআপ আর্টিস্ট সমিতির সভাপতি শামসুল ইসলাম বলেন, এ অভিযোগ সত্য নয়। এ ধরনের কোনো ঘটনা তার জানা মতে, ঘটেনি।

এ নেতার দাবি, অসুস্থ হওয়ার পর প্রতি মাসে সমিতির পক্ষ থেকে হারুণকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হতো। কিন্তু সেখানে দেখা যায় জটিলতা। এরপর তারা টাকা ফার্মেসিতে দিয়ে দেন। কিন্তু সেখানেও ঝামেলা। হারুণের পরিবারেরই একজন সদস্যই টাকা নয়-ছয় করতেন। আর সে কারণে আস্থার সংকট দেখা দেয়। এরপরও সমিতি সহায়তা অব্যাহত রেখেছে।

স্বর্ণের মেডেল বিক্রি, অতঃপর…

অর্থ সংকটে পড়ার পর একটা সময় গিয়ে জীবনের সেরা অর্জনের জন্য স্বর্ণের যে মেডেলটা পেয়েছিলেন, সেটাও বিক্রি করে দেন হারুণের স্ত্রী। সে সময় হারুণ শয্যাশয়ী। পরিবারের একমাত্র যে মানুষটির হাত ধরে টাকা আসত, ঘরে তাও তখন বন্ধ হয়ে গেছে। চিকিৎসা খরচ ও মেয়ের বিয়ের জন্যই এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে বলে দাবি করেন হারুণের স্ত্রী মহুয়ার।

হারুণের যখন শরীর ভালো থাকে, সে সময় ভিক্ষা করে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পান। সে টাকা দিয়েই প্রতিদিনকার ওষুধ ও খাবারের ব্যবস্থা হয়। কথা প্রসঙ্গে এ তথ্য জানান হারুণের স্ত্রী।

হারুণের স্ত্রী চান, তার স্বামীর জীবনের এ দুঃসময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পাশে যেন দাঁড়ান। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রধানন্ত্রী তো কত শিল্পীর বিপদেই তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। এখন আমার স্বামী অসুস্থ হয়ে কাজ করতে পারছেন না।’

‘ভিক্ষা করে দিন চলছে তার। এভাবে আর কত? আমি মেয়ে মানুষ, বাসাবাড়িতে কাজ করি। এভাবে তো সংসার চলতে পারে না। কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। ভাবি নাই, জীবনে এমন সময়ের মুখোমুখি হব।’

মহুয়া তাদের সুন্দর জীবনের সময়গুলোর কথা স্মতিচারণ করে বলেন, ‘আমি দেখেছি আমার স্বামী কত কত টাকা নিয়ে ঘরে আসছে। কত মানুষের বিপদে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে আমার স্বামী। কিন্তু এখন তার পাশে নির্ভরযোগ্যতার তেমন কোনো মানুষ নাই। যাদের ইচ্ছা আছে, তাদের সাধ্য নাই। এভাবে আর কতদিন চলতে হবে জানি না। জীবনটা এমন কেন?’

আলাপের এক পর্যায়ে হারুণের বাসায় আসেন তার ভায়রা আবুল কাশেম। তিনি বিষয়টি নিয়ে বলেন, ‘রাস্তায় গিয়ে কারো কাছে হাত পাতাটা হচ্ছে নিন্দার কাজ। যদি সরকার থেকে কোনো সহযোগিতা পেত, তার চিকিৎসার খরচের ব্যবস্থা হতো, তাহলে সে সুস্থ হয়ে যেত বলে মনে হয়।’

‘যদিও আমরা তাকে ডাক্তার দেখাতে পারি না, যার কারণে তার শরীরের কনডিশনও বুঝতেছি না, এখন কী অবস্থায় আছে। আমি যতটা পারছি, সহযোগিতা করছি। আমারও তো সীমাবদ্ধতা আছে, পরিবার আছে।’

কথার শেষে অস্পস্ট স্বরে হারুণ যা বললেন, তার মানে দাঁড়ায়, তিনি যদি সরকারের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা পান, সেটা দিয়ে চিকিৎসা করলে ফের আগের মত সুস্থ হয়ে যাবেন। হারুণ বলেন, ‘আমি উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারত যেতে চাই। এ পৃথিবীতে আরও কিছুদিন বাঁচতে চাই।’ (প্রিয়.কম)

১৭ অক্টোবর, ২০১৮

Share