চাঁদপুরের বিশিষ্ট আইনজীবী ছিলেন তিনি। খুব দ্রুতই আইন পেশায় তাঁর সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি চাঁদপুর বারের সভাপতি হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। চাঁদপুরে ইংরেজ প্রশাসন তাঁর যুক্তি ও চিন্তার কাছে অসহায় বোধ করতো।
অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তিনি মহাত্মা গান্ধী ও চিত্তরঞ্জন দাশের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আদালত বর্জন করেন। পরবর্তীতে অন্য আইনজীবীরা ফিরলেও তিনি আর কখনো আদালতে ফেরেননি। ইংরেজ শাসন ও শোষণকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন। ব্যক্তিজীবনে ছিলেন মহাত্মা গান্ধীর পরম অনুরাগী। কর্মগুণে তিনি সবার কাছে ‘চাঁদপুরের মহাত্মা গান্ধী’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। কেউ কেউ তাঁকে বলে ডাকতেন।
ইংরেজ শাসন আমলে কুমিল্লা-নোয়াখালি অঞ্চল থেকে যে কজন ব্যক্তি সাধারণ মানুষের আন্দোলন ও সংগ্রামের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে হরদয়াল নাগ অন্যতম। তাঁর জন্ম চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার কাশিমপুর গ্রামে, ১৮৫৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। বাবা গুরুপ্রসাদ নাগ ও মা গোবিন্দ প্রিয়া।
হরদয়াল নাগ ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র ছিলেন। এখান থেকে ১৮৭৪ সালে ১০ টাকা বৃত্তিসহ এনট্রান্স পাস করেন। এফএ পাসের পর ১৮৮৩ সালে তিনি আইনের সনদ লাভ করেন। হরদয়াল নাগ জীবনের প্রথম দিকে সরকারি চাকুরিতে যোগ দেন। তিনি ইনকাম ট্যাক্স অ্যাসেসর পদে কিছুদিন কাজ করেছিলেন। করেছেন শিক্ষকতাও। পরবর্তীতে আইন পেশায় থিতু হন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় এ পেশাও তিনি ত্যাগ করেন।
হরদয়াল নাগ সক্রিয়ভাবে কংগ্রেসের রাজনীতি করতেন। কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই তিনি এর সদস্য ছিলেন। তিনি ভারতের রাষ্ট্রগুরু সম্মানে ভূষিত কংগ্রেস নেতা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৮৮৬ সালে কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশন শুরু হয়। তিনি দ্বিতীয় অধিবেশনে যোগ দেন এবং সদস্য হন। এরপর তিনি অর্ধশতাব্দিরও বেশি সময় ধরে কংগ্রেসের সাথে যুক্ত ছিলেন। সদস্য হিসেবে যাত্রা শুরু করে হরদয়াল নাগ কংগ্রেসের নেতৃত্বস্থানীয়ে পরিণত হন।
১৯৩১ সালে তিনি বহরমপুরে ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক অধিবেশনে’ সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্কে আয়োজিত কংগ্রেসের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে তিনি সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করেন। তাঁকে কংগ্রেসের নবীন-প্রবীণ নেতৃবৃন্দ শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন।
চাঁদপুর-কুমিল্লা-নোয়াখালি অঞ্চলের আন্দোলন-সংগ্রামে হরদয়াল নাগ ছিলেন অনিবার্য নাম। তিনি ১৯০৩ সালে শুরু হওয়া বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে চাঁদপুরে সক্রিয় ছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনে এ অঞ্চলে তাঁর কর্মকা- ছিল প্রশংসনীয়। অন্যদিকে একই বছর চাঁদপুরে চা-শ্রমিকদের হত্যার প্রতিবাদে মুখর ছিলেন তিনি।
১৯২১ সালে ব্রিটিশ দ্বারা অত্যাচারিত আসামের চা বাগান শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলনের নাম দেয়া হয় ‘মুল্লুকে চলো’। আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় এবং ব্রিটিশদের বাধার মুখে হাজার হাজার শ্রমিক পায়ে হেঁটে চাঁদপুর স্টীমার ঘাটে এসে সমবেত হয়। চাঁদপুর রেলস্টেশনে এসে জড়ো হয় প্রায় ৪ হাজার শ্রমিক। উদ্দেশ্য মেঘনা পার হয়ে নিজ অঞ্চলে ফেরা। ক্ষুধার্ত, অবসন্ন শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ান হরদয়াল নাগ। তিনি তাদের জন্যে চাল ও চিড়ার ব্যবস্থা করেন। ক্লান্ত-অবসন্ন শ্রমিকরা সেদিন রান্না করে নয়, ক্ষুধার যাতনায় কাঁচা চাল চিবিয়ে খেয়েছিল।
২০ মে ইংরেজ গুর্খাবাহিনী কুলিদের গতিরোধ করতে চাঁদপুর ঘাটে নির্বিচারে গুলি চালায়। তারা হাজার হাজার কুলির পেট কেটে তাদের মেঘনায় ভাসিয়ে দেয়। এই নারকীয় হত্যাকা-ের প্রতিবাদে চাঁদপুরে হরতাল ঢাকা হয়। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে পাশর্^বর্তী অঞ্চলেও। আন্দোলনের স্থানীয় সংগঠক ছিলেন হরদয়াল নাগ। এ হত্যাকা-ের ঘটনায় চাঁদপুরে ছুটে আসেন মহাত্মা গান্ধী, মওলানা মোহাম্মদ আলী, চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষ চন্দ্র বসুর মতো নেতারা। বর্তমানে ওই দিনকে কেন্দ্র করে ২০ মে ‘চা-শ্রমিক হত্যা দিবস’ পালন করা হয়।
১৯৩০ সালের ১২ মার্চ গুজরাটে মহাত্মা গান্ধী ‘লবণ আইন’ আন্দোলন শুরু করেন। এ আন্দোলনে হরদয়াল নাগ আসাম-নোয়াখালি অঞ্চলের নেতৃত্ব দেন। আনন্দবাজার পত্রিকার ১৩৩৮ সনের শারদীয় সংখ্যায় লেখা হয়েছে :‘হরদয়াল নাগ মহাশয় তখন ত্রিপুরা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি। ত্রিপুরা, নোয়াখালী ও শ্রীহট্টের কর্মীগণ হরদয়াল নাগের নেতৃত্বে নোয়াখালী সমুদ্রতীরে বহু কেন্দ্র খুলে লবণ আইন অমান্য ও গ্রামে গ্রামে প্রচার কার্য শুরু করেন।’
১৯৩২ সালে শুরু হয় ‘আইন অমান্য আন্দোলন’। এ আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন হরদয়াল নাগ। তখন গণগ্রেপ্তার চলছিল। এ বছরের ১৫ জানুয়ারি সরকার হরদয়াল নাগের প্রতি একটি নোটিশ জারি করে। নোটিশে বলা হয় : হরদয়াল নাগ যেন আইন অমান্য আন্দোলনের কোনো সভায় অংশগ্রহণ না করেন।
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এক মাসের মধ্যে তাঁকে কোন সভার আয়োজন না করতেও বলা হয়। এ নোটিশ থেকে বোঝা যায়, ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নিয়ে খুব চিন্তিত ছিল। যদিও সরকারের নোটিশে তিনি কান দেননি। সে কারণে আইন অমান্য আন্দোলনে যুক্ত থাকার অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হন। তাঁকে ছয় মাসের কারাদ- প্রদান করা হয়। হরদয়াল নাগ প্রথম গ্রেফতার হন ১৯০৭ সালে। তিনি ওইসময় শাহরাস্তি মেহের কালীবাড়িতে বিদেশী পণ্য বর্জন আন্দোলনের সভা করছিলেন।
১৯০৬ সালে হরদয়াল নাগ চাঁদপুরে ‘জাতীয় বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এ বিদ্যালয়টির সভাপতি ছিলেন। ১৯২৫ সালের ১০ মে মহাত্মা গান্ধী এ স্কুল পরিদর্শন করেন। ১৯০৬ সালে গঠিত জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সাথেও হরদয়াল নাগ সম্পৃক্ত ছিলেন। যাদবপুর জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে তাঁর অবদান রয়েছে।
তিনি ১৯২২ সাল থেকে আমৃত্যু এ প্রতিষ্ঠানটির সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কলকাতায়ও তিনি ‘উদয়পুর হরদয়াল নাগ আদর্শ বিদ্যালয়’ নামে একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্যালয়টিতে এখনো সগৌরবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। অসাম্প্রদায়িক হরদয়াল নাগ চাঁদপুর শহরে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত ‘বেগম মসজিদ’-এর মসজিদ কমিটির প্রথম সম্পাদক ছিলেন। এ সময়ে এসেও যা বিস্ময়ের দাবি রাখে।
হরদয়াল নাগ নিজে বলতেন, ‘চিরদিনই আমি বিশ^ভ্রাতৃত্বে বিশ^াসী এবং সেই বিশ^াস লইয়াই কাজ করিয়া আসিয়াছি।’ তিনি হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। যুক্ত ছিলেন পত্র-পত্রিকার সাথেও। তিনি ছাত্রাবস্থায় ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। ১৮৮০ থেকে ১৮৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি ‘ভারত হিতৈষিণী’ পত্রিকা প্রকাশনা ও সম্পাদনার সাথে যুক্ত ছিলেন।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের সাথেও হরদয়াল নাগের একটি গল্প রয়েছে। ১৯২১ সালের ৮ জুলাই কুমিল্লা থেকে কলকাতা যাবার পথে নজরুল ইসলাম ও মুজফ্ফর আহ্মদ চাঁদপুরের সাবেক স্ট্র্যান্ড রোডের ডাকবাংলোয় ওঠেন। মূলত কলকাতায় যেতে ভাড়ার কমতি পড়ায় তাঁরা এখানে যাত্রাবিরতি দেন।
মুজফ্ফর আহ্মদ কলকাতার ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার সম্পাদক আফজালুল হককে টাকা পাঠানোর জন্যে টেলিগ্রাম করেন। আফজালুল হক টাকার বন্দোবস্ত করতে কুমিল্লার আশ্রাফ উদ্দীন আহম্মদ চৌধুরীকে অনুরোধ করলে তিনি হরদয়াল নাগকে টেলিগ্রাম করেন। হরদয়াল নাগ সেসময় ভাড়া বাবদ ১২ টাকা শ্রীকুলচন্দ্র সিংহ রায়ের মাধ্যমে তাঁদের কাছে পৌঁছে দেন। এ টাকা পেয়ে নজরুল ইসলাম ও মুজফ্ফর আহমদ কলকাতা যাত্রা করেন।
জনদরদি সংগ্রামী নেতা হরদয়াল নাগকে মহাত্মা গান্ধী শ্রদ্ধা করতেন। তিনি তাঁর ‘ইয়াং ইন্ডিয়া ১৯২১-১৯২৬’ গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে হরদয়াল নাগের বিভিন্ন প্রসঙ্গ উপস্থাপন করেছেন। হরদয়াল নাগ তাঁকে নিয়মিত চিঠি লিখতেন। মহাত্মা গান্ধীও নিয়মিত তাঁর চিঠির জবাব দিতেন। এ পর্যন্ত হরদয়াল নাগকে লেখা তাঁর ৮টি চিঠির সন্ধান পেয়েছি। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরানো চিঠিটি ১৯২৪ সালের ১৮ মার্চ লেখা।
১৯২৫ সালে দাঙ্গার ঘটনায় গান্ধী নোয়াখালি ও চাঁদপুরে এলে হরদয়াল নাগ তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। ১৯২৫ সালের ১৪ মে এ সাক্ষাৎকারটি অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। হরদয়াল নাগের পুত্র মনকুমার নাগ জানিয়েছেন, মহাত্মা গান্ধী তাঁদের বাড়িতে তিনবার এসেছিলেন। তাঁর মাহাত্ম্যের জন্যে এবং গান্ধীর অনুসারী ছিলেন বলে হরদয়াল নাগকে ‘চাঁদপুরের গান্ধী’ বলা হয়। তাঁর জীবতাবস্থায়ই চাঁদপুরবাসী তাঁকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিল।
তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়ে চাঁদপুরে একটি সড়কের নাম রাখা হয় ‘হরদয়াল রোড’। ১৯৪১ সালে চাঁদপুরে তাঁর ৮৯ বছর পূর্তিতে জন্মজয়ন্তী উৎসবের আয়োজন করা হয়। এ উৎসবে বক্তব্য রাখেন তৎকালীন প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সমিতির সভাপতি রাজেন্দ্রচন্দ্র দে। সেদিন তাঁর বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘নাগ মহাশয় সাধারণ সৈনিক হইতে ক্রমে অন্যতম সেনাপতির পদ লাভ করিয়াছেন।’
১৯৪২ সালে হরদয়াল নাগ অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু জনতার জন্যে আন্দোলন-সংগ্রাম তাঁর রক্তে মিশে ছিল। তখন ভারত-ছাড় আন্দোলন চলছিল।অসুস্থ শরীর নিয়েও হরদয়াল নাগ এ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ভারত-ছাড় আন্দোলনের একটি জনসভায়ও যোগ দেন। অর্থাৎ জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি জাতীয় আন্দোলনের সাথে,গণমানুষের সংগ্রামের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। জাতীয়তাবাদে বিশ^াসী স্বাধীনতা সংগ্রামী মহান এ রাজনীতিবিদ ১৯৪২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পরলোক গমন করেন।
তথ্যসূত্র : ১। ইয়াং ইন্ডিয়া ১৯২৪-১৯২৬/মহাত্মা গান্ধী। ২। কালেক্টেড ওয়ার্ক অব মহাত্মা গান্ধী। পাবলিকেশন্স ডিভিশন গভর্মেন্ট অব ইন্ডিয়া। প্রকাশ ১৯৯৯। ৯৮ ভলিয়ম। ৩। সংসদ বাঙালা চরিত্রাভিধান/প্রধান সম্পাদক : শ্রীসুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত; সম্পাদক : শ্রীঅঞ্জলি বসু। প্রথম প্রকাশ মে ১৯৭৬। ৪। কুমিল্লা জেলার ইতিহাস। সম্পাদনা পরিষদের সভাপতি আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া। প্রথম প্রকাশ ১৯৮৪। ৫। অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৭ জানুয়ারি, ১৯৩২। ৬। কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা/মুজফ্ফর আহ্মদ। প্রথম সংস্করণ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫। ৭। মুল্লুকে চলো আন্দোলন ও চা-শ্রমিকদের বর্তমান অবস্থা/মোহন রবি দাস।
লেখক- মুহাম্মদ ফরিদ হাসান, কবি ও সাহিত্যিক
২২ এপ্রিল ২০১৯