বাংলাদেশে প্রতিবছর মোট উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় ৩০ শতাংশই নষ্ট হয়ে যায়। অপচয়কৃত এ খাদ্যের আর্থিক মূল্য প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (FAO) এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক যৌথ গবেষনায় এ তথ্য জানা গেছে।
অন্যদিকে ঢাকায় রেস্টুরেন্ট এবং বিয়ে বাড়িতে যে পরিমান খাদ্য প্রস্তুত হয় তার ১০ শতাংশই নষ্ট হয়ে যায় বলে জানিয়েছেন বাড়তি খাদ্য সংগ্রহ ও অসহায়দের মধ্যে বন্টনকারী প্রতিষ্ঠান পারি ফাউন্ডেশন।
এছাড়া ক্রয়কৃত খাদ্যের শতকরা সাড়ে ৫ শতাংশ অপচয় করেন একজন গ্রাহক। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ডঃ নাজনিন আহমেদ এবং ইকবাল আহমেদ এর তত্ত্বাধানে এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
শুধু তাই নয়, গবেষনা প্রতিবেদন অনুযায়ী ধান উৎপাদনের পর তা সংগ্রহ ও বাজারজাত করার সময় যে অপচয় হয় তার আর্থিক মূল্য ৩ হাজার ২শ ১৬ কোটি টাকা। এবং তা দিয়ে ৭০ লাখ মানুষকে তিন বেলা ভাত খাওয়ানো যাবে।
রাজধানীসহ সারাদেশে রান্না করা খাবার বেঁচে যাওয়ার পর তা সংগ্রহ করে অসহায়দের মাঝে বন্টন করে পারি ফাউন্ডেশন। পারি ফাউন্ডেশন এর খাদ্য সংগ্রহ ও বন্টন সমন্বয়ক ওয়াসিম খান জানান তারা মূলতঃ বিয়ে বাড়ির খাবার সংগ্র্রহ করেন এবং তা অসহায়দের মাঝে বিলি করেন।তিনি বলেন রাজধানীর অভিজাত এলাকায় খাদ্য বেঁচে যাওয়ার হার বেশী।
মুলত ঢাকা শহরে বড় বড় যে কনভেনশন হল গুলি আছে সেখানেই বেশি খাবার অতিরিক্ত হয়। আইসিসিবি, গল্ফ ক্লাব, সেনা মালঞ্চ, সেনা কুঞ্জ, রাওয়া, পুলিশ কনভেনশন, লেডিস ক্লাবসহ ভিআইপি কনভেশন হল গুলো থেকে ডাক পাই আমরা।
তিনি জানান মাসে এসব উদ্বৃত্ত খাবারে কমপক্ষে ৫ হাজার লোকের এক বেলা খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায়। তিনি বলেন প্লেটে নেয়ার পর যেসব খাবার নষ্ট হয় তা তারা সংগ্রহ করেন না। সেসব খাবার ডাষ্টবিনে চলে যায়। পারির হিসেব অনুযায়ী বছরে ৬০ হাজার লোক একবেলা ভালো খাবার খেতে পারে এমন সব খাবারে যা না দিলে নষ্ট হয়ে যেত। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, সবগুলো কনভেনশন হল সচেতন হলে সারাদেশে এ সংখ্্যা ৬০ লাখও হতে পারত।
এ প্রসঙ্গে রাজধানীর তোপখানা রোডের বাগদাদ রেঁস্তোরার ম্যানেজার মোঃ মোক্তাদির বলেন, তাদের রেস্টুরেন্টে যারাই খাবারের আদেশ দেন তার প্রায় ১০ শতাংশ খাবারই প্লেটে অবশিষ্ট রয়ে যায়। আর তারা তা ডাস্টবিনে ফেলে দেন। তিনি বলেন, সাধারণত ভিআইপি গ্রাহকদের খাবারে অপচয় করেন। সাধারণ গ্রাহকদের অপচয়ের হার শূণ্য।
ক্রয় করা খাদ্যের অপচয় নিয়ে গবেষণা করে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষনা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। বরিশালের ছয়টি ইউনিয়ন এবং সিটি করপোরেশনের দুটি ওয়ার্ডের ৫৪০ টি খানার উপর করা এ গবেষনা তত্ত্বাবধান করেন প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ডঃ নাজনিন আহমেদ ও ইকবাল আহমেদ।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী ক্রয় করা খাদ্যের সাড়ে পাঁচ শতাংশ অপচয় হয়। এর মধ্যে খাদ্য সংগ্রহ ও প্রস্তুত করা সময় তিন শতাংশ, খাবার প্রস্তুত থেকে পরিবেশনের সময় ১ দশমিক ৪ শতাংশ, এবং খাবারের থালা থেকে অপচয় হয় ১ দশমিক ১ শতাংশ।
জরিপের তথ্যমতে, ৪০ শতাংশ মানুষ তাদের রান্না করা খাবার প্রতিদিন শেষ করে। বাকী ৬০ শতাংশ মানুষের খাবার উদ্বৃত্ত থেকে যায়। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ মানুষ পরের দিন এই খাবার খায়্। ১৩ শতাংশ মানুষ খাবার অন্যদের দিয়ে দেয়। ৭ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ হাঁস-মুরগিকে খাওয়ায়। বাকী ৫ শতাংশ মানিুষ খাবার ফেলে দেয়।
কিছু মানুষ যখন তাদের সামর্থ্যের প্রচারের জন্য বেশী পরিমান খাদ্য কিনে নানান ভাবে নষ্ট করছে, ঠিক পাশাপাশি বাস করা কিছু মানুষ তখন তাদেরেই ফেলে দেয়া খাদ্য দ্বারা তাদের জীবন বাঁচিয়ে রাখছে। শহরের ডাস্টবিনের পাশে বসে সেখান থেকেই খুঁজে খাবার সংগ্রহ করা এবং তা খাওয়ার দৃশ্য হয়ত সব নাগরিকের চোখে পড়ে।
জাতি সংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনষ্টিটিউট এক যৌথ গবেষনায় দেখিয়েছেন বাংলাদেশে জনপ্রতি বছরে ২০ কেজী খাবার অপচয় করেন।
খাদ্যে অপচয় গবেষনায় যুক্ত ছিলেন খাদ্য উৎপাদন বিশেষজ্ঞ ডঃ মোঃ দেলোয়ার হোসেন মজুমদার। তিনি টেলিফোনে এ প্রতিবেদককে বলেন, খাদ্যে মারাত্মক অপচয় হচ্ছে আমাদের দেশে। তিনি বলেন ধানে আমাদের দেশে অপচয় হয় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। সবজীতে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ। ফল-মূলে ৩৫ শতাংশ। গড়ে আমাদের দেশে খাদ্য অপচয় ৩০ শতাংশ। যার আর্থিক মূল্য ৩০ হাজার কোটি টাকা।
তিনি বলেন, সিরিয়াল খাওয়া কমাতে হবে। একজন লোকের ৪০০ থেকে ৪৫০ গ্রামের বেশী ভাত খাওয়া উচিত নয়। তিনি চালের উৎপাদনে কৃষি জমি ব্যবহার কমানোর উপর মত দেন। উন্নত জাতের চাষ ও বীজ ব্যবহার করলে কৃষি জমি কমলেও উৎপাদন একই থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ডঃ মজুমদার বলেন, চালের আমদানী শুল্ক ৩৫% করা উচিত। তাতে আমাদের কৃষক বাচঁবে। তিনি ধান চাষের পরিবর্তে অন্যান্য শাক সবজী চাষের পরামর্শ দেন। যাতে কৃষকরা লাভবান হবে।
গবেষনার তথ্য অনযায়ী উৎপাদনের পর ধান কাটা, পরিবহন, সংগ্রহ, ধান মাড়াই-শুকানো প্রভৃতি নানা কর্মে কৃষকদের অজ্ঞতা এবং অসচেতনার কারনে বছরে ২৬ লাখ ৮০ হাজার টন চাল অপচয় হয়। যার আর্থির মূল্য ৩ হাজার ২১৬ কোটি টাকা। এভাবে বছরে ৭০ হাজার টন গম, ২ লাখ ৫০ হাজার টন ভুট্টা, ৭০ হাজার টন ডাল জাতীয় শস্য, ১ লাখ ২০ হাজার টন তেলবীজ, ২২ লাখ ৬০ হাজার টন ফল-মুল, ২২ লাখ ৩০ হাজার টন শাকসবজি, ২৩ লাখ টন আলু, ২ লাখ ২০ হাজার টন মিষ্টি আলু, ৭ লাখ টন আখ, ৫ লাখ ৮০ হাজার টন মসলা, ৪ লাখ ৬০ হাজার টন মাছ, ১ লাখ টন মাংস, ২ লাখ ৩০ হাজার টন দুধ এবং বছরে ৮০ কোটি ডিম নষ্ট এবং অপচয় হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রনালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের এক গবেষণা এবং তথ্যে এর আর্থিক মূল্য দেখানো হয়েছে ২৯ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জাতীয় এমিরেটাস বিজ্ঞানী ড. কাজী এম বদরুদ্দোজা বলেন, বিশ্বব্যাপী সবুজ বিপ্লব হওয়ার পর সারা বিশ্বে যে খাদ্য উৎপাদন হয় তা বর্তমান চাহিদার তুলনায় বেশি। কিন্তু শুধু মাত্র অপচয়ের কারনে আমরা এখনো ঘাটতিতে। আর এই অপচয়ের কারন হলো গবেষণার তুলনামুলক অভাব।
তিনি বলেন, উৎপাদন নিয়ে আমাদের প্রতিনিয়ত যে গবেষণা হয় তার অনেক কম ভাবা হয় অপচয় নিয়ে। উন্নত বিশ্বে এটার পরিবর্তন দৃশ্য মান । তাই তাদের উৎপাদন পরবর্তী অপচয় অনেক কম। আমাদের মতো দেশগুলোতে বেশি। আমি মনে করি, আমাদের এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার। আমাদের তরুন গবেষকদের উচিত এই সেক্টর নিয়ে কাজ করা। তাহলে এটা ঠেকানো সম্ভব।
বাংলাদেশের এ খাদ্য অপচয় নিয়ে কথা হয় সুশাষন এর জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক অধ্যাপক ডঃ বদিউল আলম মজুমদারের সাথে। তিনি বলেন, অপচয়ের এ মাত্রা কমানো যেমন সরকারের দায়িত্ব, তেমনি সকল নাগরিকের এ ব্যাপারে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
তিনি বলেন, নেতৃত্ব ও সমন্বয়ের অভাবে এ অপচয় ঘটছে। শুধু সমন্বয় করলে অনেক অপচয় রোধ করা সম্ভব । পশ্চিমা বিশ্বের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন সেখানে মানুষ সচেতন বলে তাদের অপচয় অনেক কম।
ডঃ মজুমদার বলেন, খাদ্যের অপচয় রোধ করার পাশাপাশি সরকারের উচিত নিরাপদ খাদ্য জনগণের জন্য নিশ্চিত করা। কারন মানুষ আসলে প্রতিদিন বিষ খাচ্ছে।
তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, বগুড়ার আকবরিয়া হোটেলের মত যদি সারাদেশের রেস্টুরেন্টগুলো তাদের বেঁচে যাওয়া খাবার অসহায়দরে মাঝে বন্টন করত, তাহলে অনেক মানুষকে রাস্তায় না খেয়ে কাটাতে হতো্ না।
তিনি পারি ফাউন্ডেশনকে তাদের কাজের জন্য শুভেচ্ছা জানিয়ে আরো দক্ষতার সাথে খাবার সংগ্রহ ও অসহায়দের মাঝে তা বন্টন করার পরামর্শ দেন।
লেখকঃ একেএম রাশেদ শাহরিয়ার পলাশ,
মফস্বল সম্পাদক ও বাংলা বিভাগের প্রধান,
বার্তা সংস্থা ইউএনবি
২৯ মে ২০১৯