চাঁদপুরের ফাহিম এখন মুন্সীগঞ্জের সহকারী জজ। চাঁদপুরেই জন্ম । বেড়ে উঠা ইলিশের বাড়ি চাঁদপুরের শহরতলীতে । ছোট বেলা থেকেই তাকে কাছে টানতো সৃজনশীল সব আয়োজনগুলো। মায়ের অনুপ্রেরণায় ছোটদের পত্রিকায় লেখালেখি থেকে শুরু সৃজনশীল প্রতিভার বিস্তৃতি। মফস্বলের একটি গ্রাম থেকে মায়ের আগ্রহে আজকের এ অবস্থানে ফাহিম। যদিও তাঁর মা সন্তান সফলতার দ্বারপ্রান্তে আসার পূর্বেই ২০০৬ সালের ৫ মার্চ চলে গেছেন পরপারে।
চাঁদপুর থেকে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম-ঢাকা-যেখানেই উপস্থিত বক্তৃতা, বিতর্ক, রচনা প্রতিযোগিতা, কুইজসহ যে আয়োজনই থাকতো ছুটে চলতো ফাহিম। তাঁর হয়ে তার মা তাঁর লেখাগুলো চাঁদপুরের অফিসে পাঠাতেন। প্রিয় মাকে নিয়ে তাঁর এ ছুটে চলা বেশি দূর এগোয়নি। তাকে ছেড়ে, তাঁর ছুটে চলার পথ থেকে আলাদা হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন তাঁর প্রিয় মা ফাতেমা। তখন সে দশম শ্রেণির একজন ছাত্র।
নাম তাঁর মুহাম্মদ ওমর ফারুক। শিক্ষকসহ পরিচিতরা ফাহিম নামেই তাকে চেনে। বাবা মোহাম্মদ খান এবং মাতা মৃত ফাতেমা বেগম।
চাঁদপুর সদরের উত্তরে বিটি সড়কের পূর্বপাশে রঙ্গেরগাঁও গ্রামে তাঁর পৈত্রিক নিবাস । ১৯৯২ সালের ১১ আগস্ট একই উপজেলার মেঘনানদীর তীর সংলগ্ন সফরমালীর পশ্চিম কল্যান্দি মামার বাড়িতে তাঁর জন্ম। সফরমালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সমাপনি শেষ করে ও একই স্থানে অবস্থিত সফরমালী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে।
ফাহিম সফরমালী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ট্যালেন্টপুলে জুনিয়র বৃত্তি লাভ করার পর মায়ের ইচ্ছায় চাঁদপুরে অবস্থিত নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগে আল-আমিন একাডেমি স্কুল এন্ড কলেজে ভর্তি হয়।
সেখান থেকেই ২০০৭ সালে এস.এস.সি এবং ২০০৯ সালে এইচ.এস.সি পাস করে। এরপর ২০১০ বাংলা পরে ২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে অনার্সে ভর্তি এবং ২০১৫ সালে মাস্টার্সে শীর্ষ তিনজনের মধ্যে উত্তীর্ণ হওয়া ফাহিম একজন।
২০১৬ সালে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু। ২০১৭ সালের ১১তম বিজেএস শিক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর মুহাম্মদ ওমর ফারুক ফাহিম সহকারী জজ হিসেবে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে যোগদান করেন। বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ জেলায় কর্মরত।
অল্প বয়সেই গবেষক হিসেবে দেশ বিদেশের বিভিন্ন মর্যাদাপূর্ণ গবেষণা জার্নালে এবং কনফারেন্সে তার গবেষণা প্রকাশিত ও উপস্থাপিত হয় এবং বর্তমানে হওয়ার কথা রয়েছে।এরমধ্যে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ণ বিশ্ববিদ্যলয়,ভারতের দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় ও এমিটি ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য কনফারেন্সে যোগদান করে।
মানবাধিকার সাউথ এশিয়ান ইন্সটিটিউট অব এডভান্সড হিউম্যান রাইটস স্টাডিজ (সেইলস),এমপাওয়ারমেন্ট থ্র ও ল অব দ্যা কমন পিপলসহ বিভিন্ন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের সাথে তিনি কাজ করেছেন।
সম্প্রতি তিনি মানবাধিকার আইনের ওপর এলএলএম এর জন্য পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান সুইজারল্যান্ডের জেনেভা একাডেমি অব ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যানিটারিয়ান ল এন্ড হিউম্যান রাইটসে-এক বছর মেয়াদী এলএলএম করার জন্যে পূর্ণ শিক্ষাবৃত্তিপ্রাপ্ত হয়েছেন। সেপ্টেম্বরে তাঁর এ যাত্রা শুরু হবে।
ছোট বেলা থেকেই বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা, রচনা প্রতিযোগিতা এবং সাহিত্য কর্মের সাথে সম্পৃক্ততায় মিলেছে শ্রেষ্ঠত্বও অর্জন। জেলা পর্যায় থেকে শুরু করে বিভাগীয় এবং জাতীয় পর্যায়েও ফাহিমের অবস্থান খুবই চমৎকার ছিল। অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়ন কালে উপস্থিত বক্তৃতা, রচনা প্রতিযোগিতাসহ সুন্দর হাতের লেখা চট্টগ্রাম বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে জাতীয় পর্যায়ে নিজকে জায়গা করে নিয়েছিলেন। নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় একাধিকবার কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হয়ে জাতীয় পর্যায়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতার যাত্রা শুরু করেন। বিগত দশকের শ্রেষ্ঠ বিতার্কিকদের মধ্যে তাকে অন্যতম মনে হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে ১৭ বার প্রতিনিধিত্ব করে ১৩ টি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বিতর্কের ফাইনালে উত্তীর্ণ হয়ে ৯ বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন ফাহিম। এরমধ্যে ১১ বার তিনি শ্রেষ্ঠ বিতার্কিকের পুরস্কার অর্জন করেন।
কেবল বিতর্ক প্রতিযোগিতা নয়। আইন বিভাগের ছাত্র হিসেবে ছায়া আদালত হিসেবে পরিচিত ‘মুট কোর্ট ’ প্রতিযোগিতায় তিনি জাতীয় পর্যায়ে চ্যা¤িপয়ন হন। দক্ষিণ এশীয় পর্যায়ে তার দল শ্রেষ্ঠ গবেষণা পুরষ্কার এবং হংকং-এ অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তাঁর দল গবেষণায় ফাস্ট অনারেবল সাবমিশন পুরস্কার প্রাপ্ত হয়।
বিতর্ক এবং মুটিং এ জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনে ওমর ফারুক ফাহিম নিয়মিত বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ ডিবেট ফেডারেশনের কেন্দ্রিয় কমিটিতে তিনি যুগ্ন-সাধারণ স¤পাদক পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
২০০৮ সালে চাঁদপুরের বিতর্ককে এগিয়ে নিতে চাঁদপুর ডিবেট মুভমেন্ট (সিডিএম) প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন এবং প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিতর্ককে নতুন মাত্রায় এনে দিতে নতুন ধারণা সন্নিবেশিত করে চাঁদপুরের বিতর্ককে এগিয়ে নিতে কাজ করেন।
২০১০-১১ কার্যকালে সিডিএম এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সিডিএম আয়োজিত জাতীয় বিতর্ক উৎসব ২০১০-এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। অস্বছল মেধাবী শিক্ষার্থীদের পড়াশুনায় সার্বিক দিক-নির্দেশনা দিতে তিনি ড্যাফোডিল ফাউন্ডেশন নামক একটি সমাজসেবামূলক কার্যক্রমের সাথে এখনও জড়িত আছেন।
আজকের অবস্থানে আসার পেছনে প্রথমত মা,বাবা,পরিবারের সদস্য,শিক্ষকবৃন্দ, আত্মীয়-স্বজন এবং শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি কৃতজ্ঞ তিনি। জানার জন্যে পড়া ও মুভি ডকুমেন্টারি দেখতে ভালোবাসেন। ফটোগ্রাফি করতেও পছন্দ তাঁর। অবসর সময়ে সৃষ্টিশীল এবং মননশীল লেখালেখি করেন। আজীবন প্রিয়দেশকে একটি তুলনামূলক ভালো জায়গায় নিয়ে যেতে অল্প হলেও ভূমিকা রাখতে চান চাঁদপুরের ওমর ফারুক ফাহিম। ব্যক্তিজীবনে অবিবাহিত এ তরুণ বিচারকের আগামি ১১ আগস্ট ২৭ তম জন্মবার্ষিকী।
প্রসঙ্গত, সহকারী জজগণ সাধারণত জেলা কোর্ট,সহকারী জজ কোর্টে বিচারক হিসেবে কাজ করেন। তাঁদের কাজের মধ্যে রয়েছে সহকারী জজ কোর্টের অধীন সকল দেওয়ানী-ফৌজদারি মামলার বিচার করা। সমস্ত বিবাহবিচ্ছেদ,বিভাজন,গার্হস্থ্য সহিংসতা এবং সিভিল মামলার নিষ্পত্তি করা।
প্রতিবেদনে: আবদুল গনি, ৮ আগস্ট ২০১৯
ডিএইচ