চাঁদপুরের মাদ্রাসাগুলোতে জেডিসি পরীক্ষার্থীদের প্রবেশপত্র বিতরণের নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হচ্ছে। মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড ১৫০ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে ৪শ’থেকে ৫শ’ টাকা। খোদ জেলা শহরের আহমাদিয়া ফাজিল মাদ্রাসাসহ কয়েকটি মাদ্রাসার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেছেন কয়েকজন শিক্ষার্থী ও অভিভাবক।
এবার চাঁদপুর জেলার ২৬০টি মাদ্রাসা থেকে জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় ২৪কেন্দ্রে ১০ হাজার ৩৫৩ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। যার মধ্যে সদরের দু’ কেন্দ্রে জেডিসি পরীক্ষার্থী ১ হাজার ৪৮৬ জন। অধিকাংশ মাদ্রাসাই প্রবেশপত্র বিতরণের বিনিময়ে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে অন্তত ৫ শ’ টাকা করে আদায় করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চাঁদপুর আহমাদিয়া ফাজিল মাদ্রাসার কয়েকজন জেডিসি পরীক্ষার্থীর সাথে কথা হলে তারা বলেন,‘মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মো.মোস্তাফিজুর রহমান খান দু’ দিন আগে পরীক্ষার এডমিট কার্ড নেয়ার জন্য আমাদের ৫ শ টাকা করে নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ দেন। হুজুরের কথা মতো আমরা বাড়িতে এসে ৫ শ টাকার কথা বললে আমাদের অভিভাবকরা এতো টাকা দিতে পারবে না বলে জানান।
পরবর্তীতে বুধবার ৩০ অক্টোবর আমরা অধ্যক্ষ হুজুরের কাছে গিয়ে বলি, ‘হুজুর আমরা ৫ শ টাকা করে দিতে পারবো না। বাড়ি থেকে ৩শ টাকা দিয়েছে। কিন্তু এ কথা শুনে হুজুর ক্ষেপে গিয়ে বলেন, ৫শ টাকা ছাড়া এডমিট কার্ড দেয়া হবে না। এ অবস্থায় উপায়ন্ত না দেখে আমরা এডমিট না নিয়ে বাড়ি যাই।’কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, অধ্যক্ষ নিজেই শিক্ষার্থীদের হাত থেকে ৫ শ টাকা করে নেন।
এক জেডিসি পরীক্ষার্থীর মা বলেন, ‘ আমরা খুবই গরীব। বুধবার মেয়ে বাড়িতে এসে কান্নাকাটি করে বলে-৫ শ টাকার কম দিলে হুজুর এডমিট কার্ড দেবে না। কিন্তু স্বামীর এখন কোন কাজ নেই, বেকার। সংসার চালাতেই কষ্ট হচ্ছে। মেয়ের কান্নাকাটি দেখে দু’ জনের কাছ থেকে ৫শ টাকা ধার করে মেয়েকে দিয়েছি। তিনি বলেন, এর আগে আরেক মেয়ে পরীক্ষার্থী ৩ শ টাকা দিতে চাইলে হুজুর তাকে ধমকে দেন। ৫ শ টাকার কমে এডমিট কার্ড দেননি।’
বিষয়টি স্বীকার করে আহমাদিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মুস্তাফিজুর রহমান বলেন,‘আমার মাদ্রাসার পরীক্ষার্থী ৩৯ জন। এডমিট কার্ড বিতরণের সময় কেন্দ্র খরচের জন্য সামর্থবান কিছু শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৫ শ’ টাকা করে নেয়া হয়েছে। তবে কোনো কোনো গরীব শিক্ষার্থী ৩শ’ টাকা দিয়েছে। ’
তিনি বলেন,‘ পরীক্ষার কেন্দ্র ব্যবস্থাপনার জন্য হল কর্তৃপক্ষকে আমাদের টাকা দিতে হয়। কেন্দ্র খরচ বাবদ পরীক্ষার্থী প্রতি ৫ শ টাকা কেন্দ্রে দিতে হবে। এ টাকাতো অন্য কোনো ফান্ড থেকে দেয়া হয় না। বিগত দিনেও এভাবেই কেন্দ্র খরচ চালানো হয়েছে। তবে ৫ শ’ টাকা আদায়কে তিনি নিয়ম বহির্ভূত মানতে নারাজ।’
চাঁদপুরের ওচমানিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও কেন্দ্র সচিব বলেন,‘ আহমাদিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ যে কথাটি বলেছেন সেটি সঠিক না। আমরা তার কাছ থেকে পরীক্ষার্থী প্রতি ৫০০ টাকা চাইনি। আমার কেন্দ্র ফি হলো ৩৭৫ টাকা। তিনি বলেন, স্কুল-মাদ্রাসা সবাই এ নিয়মেই চলে।’
মতলব উত্তর উপজেলার সাড়ে পাঁচআনী হোসাইনীয়া সিনিয়র মাদ্রাসার অধ্যক্ষ রেফাত উল্লাহ বলেন, আমার মাদ্রাসায় এবার পরীক্ষার্থী ৪২ জন। এডমিট কার্ড ফি কত ধরেছেন-এ প্রশ্নের জবাবে উত্তেজিত হয়ে তিনি বলেন,‘এটি সেন্টার কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে। তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন। পরে তিনি বলেন, ৪৭০ টাকা করে নির্ধারণ করা হয়েছে। আমি এখন মিটিংয়ে আছি। শনিবার কথা কথা বলতে পারবো।’
মতলব উত্তর উপজেলার ফরাজীকান্দি আর ওয়েসিয়ে কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আতাউল করিম মুজাহিদ বলেন,‘আমার মাদ্রাসায় পরীক্ষার্থী ৪৪ জন। তাদের কাছ থেকে বোর্ড ফি ১৫০ টাকা করে নেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে কেন্দ্রের খরচ ৩৭৫ টাকা হলে আপনি ১৫০ টাকা নিলে কিভাবে হবে এবং শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে তারা ৫ শ’ টাকা করে দিয়েছে-এমন কথা বলার পর তিনি বলেন, সেগুলো হয়তো মিলাদসহ অন্যান্য খরচ মিলে এডমিট কার্ড নেয়ার সময় ৫ শ টাকা করে দিয়েছে।’
সদর উপজেলার ফরাক্কাবাদ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মো.ফখরুল ইসলাম বলেন,‘হল চার্জ দিতে হবে ৩৭৫ টাকা। ক্রীড়া বাবদ ২৫ টাকা। আর বেতন ১ শ টাকা। এডমিট নেয়ার সময় অনেক পরীক্ষার্থীই এ টাকা দিতে পারেনি। স্চ্ছবল পরীক্ষার্থীরা ৫ শ টাকা দিতে পেরেছে। আর অনেকেই ২ শ থেকে ৩ শ টাকা দিয়েছে। এসব মিলে আমাদের পরীক্ষা কেন্দ্রের টাকাও উঠেনি। বাকী টাকা আমাদের পকেট থেকে দিতে হবে।
এ বিষয়ে চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) শওকত ওসমান বলেন, ‘ বিষয়টি জানার পর ডিসি স্যার আহমাদিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষকে ডেকে এনেছেন। আপাতত: শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া বাড়তি টাকা ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিষয়টি আমরা তদন্ত করে দেখছি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে বরখাস্ত করা হতে পারে। অন্য কোনো মাদ্রাসার বিষয়ে আমরা অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘ওচমানিয়া মাদ্রাসা ৩৭৫ টাকা করে নিয়েছে। তারা বলছে, পরীক্ষাকেন্দ্রের জন্য বেঞ্চ আনা-নেয়া করতে হয়। এসব কাজে কিছু খরচ আছে। তাই আমরা বিষয়টি একটু লিবারেলি দেখি। তার মানে এ নয়, পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৫ শ টাকা করে নিতে হবে।’
চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মো.মাজেদুর রহমান খান বলেন,‘কেউ পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।’
আশিক বিন রহিম,১ নভেম্বর ২০১৯