আগামি ৯ থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত চাঁদপুরসহ দেশে ৬টি ইলিশ বিচরণক্ষেত্রে ২২ দিন ইলিশ ধরা সম্পুর্ণ নিষিদ্ধ করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) মন্ত্রণালয় থেকে জারি হওয়া এক প্রজ্ঞাপনে এ কথা জানানো হয়েছে।
রোববার সচিবালয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আন্তমন্ত্রণালয় সভা শেষে প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু বলেন, ‘এ সময়ে মা ইলিশ ডিম পাড়ে। এ সময়ে ডিম পাড়ে ৮০% ইলিশ। আর এ ডিম পাড়ে মূলত: মিঠা পানিতে। তাই আশ্বিনের পূর্ণিমার ৪ দিন আগে এবং পূর্ণিমার পর ১৮ দিন এ ২২ দিন দেশের উপকূলীয় অঞ্চল ও নদীর মোহনাসহ যে সব জেলার নদীতে ইলিশ পাওয়া যায়, সেখানে মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে।’
পাশাপাশি ইলিশের আহরণ,পরিবহন,মজুত,বাজারজাতকরণ,ক্রয়-বিক্রয়ও বিনিময় নিষিদ্ধ থাকবে। অতীতের চেয়ে এবার কঠিন অবস্থানে থাকবে প্রশাসন ও ট্রাস্কফোর্স। মা ইলিশ রক্ষায় চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনাসহ দেশের ৭ হাজার বর্গকি.মি.নদী এলাকায় ৬ টি অভয়াশ্রম ঘোষণা করেছে সরকার। এর আয়তন ৪শ ৩২ কি.মি। মূলত:ইলিশের ডিম ছাড়ার সুযোগ করে দিতেই এ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
এ সময়ে নদীতে সকল প্রকার মাছ আহরণ বন্ধসহ মা ইলিশ ও জাটকা ইলিশ আহরণ,বিক্রয়, বিপনন,মজুদ কিংবা বাজারজাতকরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর ) অপরাহ্নে চাঁদপুর টাইমসের সহ-সম্পাদক আবদুল গনি চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ,নদী কেন্দ্র চাঁদপুরে ৩১ বছর ধরে ইলিশ গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্ত ড.আনিসুর রহমানের একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।
আগামি ৯ থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ সম্পর্কে চাঁদপুরে ৩১ বছর ধরে ইলিশ গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র চাঁদপুরের এ প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড.আনিসুর রহমান বলেন,‘ ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত মা ইলিশের ডিম ছাড়ার জন্যে ১১ দিন নিষেধাজ্ঞা ছিল। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে তা বাড়িয়ে ১৫ দিন করা হয়। ২০১৬ সাল থেকে এবছর পর্যন্ত ২২ দিন করার প্রস্তাব হলে মন্ত্রণালয় তা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যা গবেষণালদ্ধ ফলাফলের কারণে করা হয়েছে। যার ফলেই ইলিশের উৎপাদন ক্রমান্বয়েই বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি আরো বলেন,‘চাঁদপুরসহ অন্যান্য জেলার ট্রাস্কফোর্স,সাংবাদিক ও মৎস্য বিভাগীয় কর্মকর্তা,জনপ্রতিনিধিগণ ও সংশ্লিষ্ঠ জেলেদেরও এ ব্যাপারে যথেষ্ঠ ভূমিকা থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে। এ জন্যে সংশ্লিষ্ঠ সকলকে ধন্যবাদ জানাই।’
চাঁদপুরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড.আনিসুর রহমান এ বছরে ইলিশ সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে কী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,‘মৎস্য বিভাগের সিদ্ধান্ত মতে ইলিশ বিচরণকারী এলাকায় ট্রাস্কফোর্সের মধ্যে রয়েছে-জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সকল ঊর্ধতন কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা,নৌ-পুলিশ,কোস্টগার্ড,কোনো কোনো ইলিশ অঞ্চলে নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্য,স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণমাধ্যমকর্মীদের সম্পৃক্ত করে অবরোধ চলাকালে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে। দেশের সব অভয়াশ্রমে কোনো অবস্থাতেই অবরোধ চলাকালে ছাড় দেয়া হবে না এমনই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। জেলেদের প্রণোদনা তো থাকবেই । আবার এসময় ইলিশ ধরতে গিয়ে একবার যে ধরা পড়বে দ্বিতীয় বারের বেলায় তার শাস্তি দ্বিগুণ হবে।”
তিনি আরো বলেন ,‘বিগত ক’বছরের ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি ,আহরণ ও সংখ্যাবৃদ্ধি ,অভয়াশ্রমের সংখ্যা ও আয়তন বাড়ানোই এর ফলাফল। মেঘনা ও পদ্মা ছাড়াও এখন যমুনা,মধুমতি ,চিত্রা ,নবগঙ্গা ,কুশিয়ারা ও আড়িঁয়াল খাঁ পর্যন্ত ইলিশ বিচরণ আবার শুরু করেছে। প্রতিদিন ডিম ছাড়ার মুহুর্তে ইলিশ প্রায় ৭২ কি.মি পর্যন্ত বিচরণ করতে সক্ষম। ইলিশের এ সময় এফআরআই’র গবেষকগণ দেশের প্রতিটি অভয়াশ্রমে গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করবে ।’
অপর এক প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন,‘গত বছর ৪৮% শত্যাংশ ডিম রক্ষায় প্রায় ৩,৬৪২ হাজার কোটি জাটকা অভয়াশ্রমগুলোতে নুতনভাবে ইলিশের কাতারে যোগ হয়েছে। যার ফলে এবার ইলিশের প্রাচুর্যতা লক্ষ্য করা গেছে তাই দেশের ইলিশ অভয়াশ্রমের ব্যাপ্তি বা দৈর্ঘ্যও বৃদ্ধি করা হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী দেশে ২০০২-২০০৩ অর্থবছরে যেখানে ইলিশের উৎপাদন ছিল ১ লাখ ৯৯ হাজার ৩২ মে.টন। জাটকা ধরা নিষিদ্ধকরণ, প্রজননের সময় ইলিশ ধরা বন্ধসহ সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে ইলিশের উৎপাদন ক্রমান্বয়েই ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০১২-১৩ অর্থবছরে ৩ লাখ ৫১ হাজার মেট্রিক টন, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৩ লাখ ৮৫ হাজার মে. টন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩ লাখ ৮৭ হাজার মে. টন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩ লাখ ৯৫ হাজার মে. টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪ লাখ ৯৬ হাজার মে. টন এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫ লাখ ১৭ হাজার মে. টন ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, ইলিশ উৎপাদনে ৬ষ্ঠ অভয়াশ্রম স্থাপনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট,নদীকেন্দ্র চাঁদপুর ধারাবাহিকভাবে গবেষণা পরিচালনা করেছে। বরিশাল সদর ও বরিশালের হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা অঞ্চলে মেঘনার শাখা নদীগুলিতে জাটকার প্রাচুর্যতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। সকল গুণাবলীর মাত্রা নদীর জীববৈচিত্র্যের জন্যে অনুকূল। একই অঞ্চলে প্ল্যাকংটনের আধিক্য লক্ষ্য করা যায় যা মাছের খাদ্য প্রাচুর্যতা নিশ্চিত করে।
সামগ্রিক ফলাফলের ভিত্তিতে জাটকার প্রাচুর্যতা,নদীর পানির গুণাগুণ এবং নদীর পানির প্ল্যাকংটন ইত্যাদি সহ সার্বিক বিবেচনায় জাটকা বা ইলিশের জন্য উক্ত অঞ্চলের পরিবেশ অনুকূল রয়েছে একথা নিশ্চিত হওয়া যায়।
ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে অধিক মাত্রায় ডিমওয়ালা ইলিশ ও জাটকা আহরণ হতে রক্ষা করে মাছের অবাধ প্রজনন এবং বিচরণের সুযোগ সৃষ্টি করার মাধ্যমে সহনশীল উৎপাদন বাজায় রাখাসহ উৎপাদন বৃদ্ধি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ অপরিহার্য। বরিশাল অঞ্চলের নদ-নদীসমুহ আরো ইলিশ সমৃদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে অভয়াশ্রমটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এমনকি ভৌগলিক অবস্থানগত কারণেও এ অঞ্চলটি ৮২ কি.মি.অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণার যোগ্য ।
এ প্রেক্ষাপটে এ অঞ্চলকে ৬ষ্ঠ অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা ও স্থাপনের নির্মিত্তে জোর সুপারিশ করা হয় এবং সেটি বাস্তবায়নের পর্যায়ে আসে। এক একটি অভয়াশ্রম হচেছ এক একটি রূপালী ইলিশ উৎপাদনের কারখানা । প্রয়োজন শুধু ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়ন। তাহলেই বাংলাদেশের জলসীমায় ইলিশ সম্পদ উন্নয়নের ও সহনশীল উৎপাদনের গতিধারা বজায় থাকবে এবং জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হবে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণে : আবদুল গনি , ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ।