Home / চাঁদপুর / ১০ মিনিটে ক্যান্সার নির্ণয় : যা বললেন চাঁদপুরের কৃতি সন্তান ড. ইবনে সিনা
Dr. sina
চাঁদপুরের কৃতি সন্তান ড. ইবনে সিনা।

১০ মিনিটে ক্যান্সার নির্ণয় : যা বললেন চাঁদপুরের কৃতি সন্তান ড. ইবনে সিনা

সাধারণ রক্ত বা বায়োপসি কোষ থেকে সব ধরনের ক্যানসার শনাক্ত করার সহজ ও দ্রুত পরীক্ষা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা। ওই আবিষ্কারের ফলে আগামী দিনে মোবাইল ফোনের মতো সহজ ডিভাইসগুলোর মাধ্যমেও রোগীর ক্যানসার নির্ণয় করা যাবে। নতুন পরীক্ষায় এমন একটি সরঞ্জাম রয়েছে যা গবেষণাগার অনুযায়ী, ১০ মিনিটের মধ্যে পুরো জিনোম পর্যায়ে প্যাটার্ন পরিবর্তনের বিশ্লেষণে সহায়তা করতে সক্ষম। গবেষণা জার্নালটি ‘নেচার কমিউনিকেশন্স’ এ প্রকাশিত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়।

আলোচিত ওই বিজ্ঞানীদের দলে রয়েছেন বাংলাদেশি তরুণ চাঁদপুরের ড. আবু আলী ইবনে সিনা। মেডিকেল পত্রিকা মেডিভয়েসকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন আলোচিত ওই গবেষণা নিয়ে নানা তথ্য। সাক্ষাৎকারটি হুবুহু তুলে ধরা হল-

প্রশ্ন: ক্যান্সার বিষয়ক মৌলিক আবিষ্কারের গবেষক হতে পেরে কেমন লাগছে?

ড. আবু আলী ইবনে সিনা: অবশ্যই ভালো লাগছে। একজন বাংলাদেশী হিসেবে এই গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পেরেছি এটাই গর্বের বিষয়।

প্রশ্ন: এই আবিষ্কারের শুরুর দিকের গল্পগুলো শুনতে চাই।

ড. আবু আলী ইবনে সিনা: এই আবিষ্কারটির গল্পটা দুঃখ, আনন্দ, ত্যাগ এবং ভালোবাসার সমন্বয়ে তৈরি তিন বছরের বেশি সময় আগের কথা। আমি তখন ব্রেস্ট ক্যান্সারের একটি ডিএনএ বায়োমার্কার শনাক্ত করার জন্য একটি পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছিলাম যেটা করতে ডিএনএ-কে অনেক ধরণের জৈবিক বা রাসায়নিক পরিবর্তন করতে হত এনজাইম অথবা কেমিক্যাল বিক্রিয়ার মাধ্যমে। এই কাজটা অনেক সময়সাপেক্ষ এবং কাজটা করে সবসময় সঠিক ফলাফল পাওয়া যেতো না।

তখন অনেকটা বিরক্ত হয়ে হঠাৎ করে আমি চিন্তা করি আচ্ছা ডিএনএ-কে এনজাইম অথবা কেমিক্যাল বিক্রিয়ার মাধ্যমে এত পরিবর্তন না করে সরাসরি ডিএনএ ব্যবহার করলে কেমন ফলাফল পাওয়া যায় দেখি। আর তখনি দেখলাম সরাসরি ব্যবহার করলে আমি ক্যান্সার ডিএনএ-কে শনাক্ত করতে পারি। কিন্তু কেন সরাসরি আমাদের প্লাটফর্মে ব্যবহার করলে ক্যান্সার ডিএনএ নরমালের চেয়ে ভিন্ন রেজাল্ট দিচ্ছে এর পেছনের সূত্র বা থিওরি বের করতে পারিনি তখন।

আর বিজ্ঞান যুক্তি ছাড়া চলে না তাই আমার আবিষ্কারকে থিওরি দিয়ে ব্যাখ্যা না করতে পারলে এর কোন মূল্য নেই। সেই সময়টা খুব হতাশার ছিল। অবশেষে প্রায় দুই বছরের প্রচেষ্টায় এই আবিষ্কারের থিওরি বের করতে সক্ষম হয়েছি। এরপর আরো এক বছর বিভিন্ন ক্যান্সার রোগীর রক্ত ও টিস্যু নিয়ে পরীক্ষা করার পর কাজটি সম্পন্ন হয়।

প্রশ্ন: কেন ক্যান্সারকেই গবেষণার বিষয় হিসেবে বেছে নিলেন?

ড. আবু আলী ইবনে সিনা: গবেষণার মাধ্যমে মানবকল্যাণের জন্য কিছু একটা করার ইচ্ছা ছিল। সেটা রোগ নির্ণয় করা হোক কিংবা রোগ প্রতিরোধ বা নির্মূল করা হোক। যে ল্যাবে পিএইচডি শুরু করি সেই ল্যাবে মূলত রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি নিয়ে কাজ হয়। আমি তাই আমার এডভাইজরদের পরামর্শ নিয়ে ক্যান্সার নির্ণয়ের পদ্ধতি আবিষ্কারকেই আমার গবেষণার বিষয় হিসেবে বেছে নেই।

প্রশ্ন: ‘১০ মিনিটে ক্যান্সার নির্ণয়’- সহজ ভাষায় বুঝতে চাচ্ছি।

ড. আবু আলী ইবনে সিনা: ক্যান্সার নির্ণয়ে এই টেস্টটির পদ্ধতি খুবই সহজ। মানুষের শরীর থেকে রক্ত অথবা টিস্যু স্যাম্পল নিয়ে সেখান থেকে ডিএনএটা বের করে নিতে হবে। এরপর সেই ডিএনএ গোল্ড ন্যানো পার্টিকেলের সঙ্গে মেশানোর পর ক্যান্সার থাকলে এটার কোনো পরিবর্তন হবে না। কিন্তু যদি ক্যান্সার না থাকে তাহলে এটা নীল রঙে পরিবর্তন হবে।’

ইলেক্ট্রোকেমিক্যাল বা তড়িৎ রসায়ন পদ্ধতিতেও কারেন্ট সিগন্যাল মেপে এক ধরণের মেশিনের মাধ্যমে ক্যান্সারের এই পরীক্ষা করা সম্ভব। ভবিষ্যতে হয়তো এই মেশিনটি আরও ছোট আকারে তৈরি করা গেলে একসময় মোবাইল ফোনের সাথে মেশিনটি সংযোগ দিয়েই ক্যান্সার নির্ণয় করা যাবে।’

প্রশ্ন: আপনার পদ্ধতি দ্বারা কি শুধু ক্যান্সার আছে কি নেই এতটুকু ধারণা পাওয়া যাবে না কি ক্যান্সারের গ্রেডিং, স্টেজিং সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যাবে?

ড. আবু আলী ইবনে সিনা: এই মুহূর্তে শুধুমাত্র ক্যান্সারের উপস্থিতি জানা যাবে। ভবিষ্যতে এই পদ্ধতিকে আরো উন্নত করার চেষ্টা থাকবে যাতে গ্রেডিং এবং স্টেজ সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়। তবে আমাদের আবিষ্কারের মূল সুবিধাটি হলো একটি মাত্র টেস্টের মাধ্যমে শরীরে যেকোনো ক্যান্সারের উপস্থিতি নির্ণয়। ভিন্ন ভিন্ন ক্যান্সার শনাক্ত করার জন্য তাই আর ভিন্ন ভিন্ন টেস্টের প্রয়োজন হবে না।

ক্যান্সারের প্রাথমিক স্ক্রিনিং করার এই রকম একটি ইউনিভার্সেল টেস্ট ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিতে পারে। টেস্টটি যেহেতু খুব সহজ এবং স্বল্প খরচে করা সম্ভব, তাই যে কেউ নিয়মিতভাবে এই টেস্টটি করানোর মাধ্যমে আগে থেকেই সাবধান হয়ে যেতে পারবে। আর প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার ধরা পড়লে ৯৫ ভাগ পর্যন্ত রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে।

প্রশ্ন: ক্যান্সারের চিকিৎসা পদ্ধতিকে কি আপনার আবিষ্কৃত পদ্ধতি গাইড করবে যেমনটা হিস্টোপ্যাথলজি করে?

ড. আবু আলী ইবনে সিনা: আমাদের পদ্ধতিটি চিকিৎসা সমন্ধে কোন ধারণা দিতে পারবে না। এটা শুধু ক্যান্সার শনাক্ত করতে পারবে। তবে চিকিৎসা ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা এটা নিয়ে কিছুটা ধারণা দিতে পারবে। এই বিষয়ে আমাদের গবেষণা এখনও চলছে।

প্রশ্ন: লিকুইড বায়োপসির সাথে আপনার পদ্ধতির মূল পার্থক্য কী?

ড. আবু আলী ইবনে সিনা: আমাদের পদ্ধতিটি আসলে এক ধরণের লিকুইড বায়োপসি কারণ আমাদের পদ্ধতির মাধ্যমে বডি ফ্লুইড যেমন রক্ত থেকে ক্যান্সার শনাক্ত করা সম্ভব। এছাড়াও আমরা এখন ইউরিন এবং স্যালাইভা থেকে আমাদের পদ্ধতির মাধ্যমে ক্যান্সার শনাক্ত করার চেষ্টা করছি।

প্রশ্ন: আপনার আবিষ্কৃত পদ্ধতির বাণিজ্যিক ব্যবহার কবে নাগাদ শুরু হবে বলে আশা রাখেন?

ড. আবু আলী ইবনে সিনা: এটা এই মুহূর্তে বলা কঠিন কারণ বাণিজ্যিকভাবে এটাকে বাজারে নিয়ে আসার পথটি অনেক লম্বা এবং অনেক ধরণের নিয়মকানুনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। আমাদের পরবর্তী কাজ হলো আমাদের পদ্ধতির মাধ্যমে একটি বড় ধরণের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সফল হওয়ার পর যে কোনো কোম্পানির মাধ্যমে এটি বাজারজাত করার প্রক্রিয়া শুরু হবে। সব মিলিয়ে পাঁচ থেকে ছয় বছর লেগে যেতে পারে।

প্রশ্ন: আপনার বেড়ে ওঠা ও পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই।

ড. আবু আলী ইবনে সিনা: আমার জন্ম চাঁদপুর জেলার বাবুরহাট অঞ্চলে। আমার মা সুরাইয়া আকতার ছিলেন বাবুরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। মায়ের সাথে স্কুলে যেতে যেতেই শিক্ষাজীবনের শুরু। বাবা ছিলেন বাবুরহাট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মায়ের হাত ধরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে বাবার কাছেই মাধ্যমিকের পাঠ শুরু। অতঃপর বাবুরহাট থেকেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে ভর্তি হই।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে কিছুদিন বার্জার পেইন্টস রিসার্স এন্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগে কেমিস্ট হিসেবে কাজ করি। কিন্তু কর্পোরেট দুনিয়ায় অনেক চাকচিক্য থাকলেও কখনই এই ক্ষেত্রকে ক্যারিয়ারের পথ হিসেবে বেছে নিতে মন চায়নি। তাই কর্পোরেট চাকরির পাঁচ ভাগের এক ভাগ বেতন হওয়া সত্ত্বেও ফিরে আসি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের শিক্ষক হিসেবে। এটা আমার জীবনের একটি চ্যালেঞ্জিং সিদ্ধান্ত ছিল।

এই বিভাগে শিক্ষকতা করার সময়ই ক্যান্সার নিয়ে গবেষণার আগ্রহ জাগে। অতঃপর শিক্ষা ছুটি নিয়ে চলে যাই অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে। পিএইচডি করার সময় থেকে ক্যান্সার গবেষণার শুরু। এখন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ ফেলো হিসেবে আমার ক্যান্সার গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি আমার স্ত্রী সাবিহা সুলতানা এবং ছেলে জাবির ইবনে হাইয়্যানকে নিয়ে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে আছি।

প্রশ্ন: চাঁদপুর থেকে কুইন্সল্যান্ড, পেছনে ফিরে তাকালে যাত্রাপথটা কেমন দেখেন?

ড. আবু আলী ইবনে সিনা: অবশ্যই অবাক হই। অনেক চাওয়া ছিল যেটা পূরণ হয়নি আবার অনেক কিছু হয়তো ভাবিনি কখনো কিন্তু পেয়েছি। পেছন ফিরে তাকিয়ে তাই সেই অপূর্ণতাগুলো নিয়ে কোন আফসোস নেই। মনে হয় জীবনের অপূর্ণতাগুলো মিলেই জীবনকে পূর্ণ করে। শুধু নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস ধরে রেখে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণার ক্ষেত্রে মূল বাধা কোথায়?

ড. আবু আলী ইবনে সিনা: আমাদের মূল বাধা হল গবেষণার সুযোগ এবং আগ্রহের অভাব। প্রতিটি অনুন্নত দেশে গবেষণার একই চিত্র এবং এর প্রধান কারণ হলো গবেষণায় পর্যাপ্ত ফান্ড নেই। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল এবং মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে খুব শীঘ্রই, তাই আমি মনে করি অর্থনৈতিক দিক থেকে আমরা এখন আগের চেয়ে স্বাবলম্বী। অতএব সরকারের উচিত গবেষণার জন্য একটি বড় আকারের ফান্ড ঘোষণা করা। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়য়ের শিক্ষক ও চিকিৎসকদের গবেষণায় উৎসাহী করার জন্য জার্নালে পাবলিকেশনের ওপর ভিত্তি করে কিছু ভাতা বরাদ্দ দিতে পারে সরকার।

প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশের চিকিৎসকদের গবেষণায় আরো আত্মনিয়োগ করা উচিত? কেন?

ড. আবু আলী ইবনে সিনা: বাংলাদেশ হলো চিকিৎসা ক্ষেত্রে গবেষণার গোল্ড মাইন বা সোনার খনি। প্রতিদিন আমাদের হাসপাতাল আর ডায়াগনোস্টিক সেন্টারগুলোতে হাজার হাজার রোগীর তাদের রক্ত বা ইউরিন বা টিস্যু স্যাম্পল আসে যেগুলো বিভিন্ন রোগের গবেষণার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু গবেষণার সুযোগ বা আগ্রহ না থাকায় এই মূল্যবান স্যাম্পলগুলো কোনো কাজে আসে না। অথচ উন্নত বিশ্বে গবেষণার জন্য রোগীদের স্যাম্পল খুঁজে বের করা অনেক কঠিন একটি কাজ।

এছাড়া জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে আমাদের চিকিৎসকরা উন্নত বিশ্বের চিকিৎসকদের চেয়ে অনেক বেশি কেইস স্টাডি করে তাই তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি অনেক ভারি হয়ে থাকে। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তাদের পক্ষে খুব সহজেই দক্ষ গবেষক হয়ে ওঠা সম্ভব।

প্রশ্ন: তরুণ চিকিৎসক যারা ক্যান্সার বিষয়ক গবেষণা করতে চায় তাদের উদ্দেশে কিছু বলুন।

ড. আবু আলী ইবনে সিনা: আমাদের তরুণ প্রজন্ম অত্যন্ত মেধাবী এবং আর তরুণ চিকিৎসকরা হলো দেশের সেরা মেধাবী। তাই তাদের দ্বারা ক্যান্সার গবেষণার মত চিকিৎসা বিজ্ঞানের যেকোনো বিষয়ে যুগান্তকারী আবিষ্কার করা সম্ভব। আমি আশা করি আমার এই আবিষ্কার তাদেরকে অণুপ্রাণিত করবে এবং গবেষণায় আগ্রহী করে তুলবে। (কনটেন্ট ক্রেডিট: মেডিভয়েস)

বার্তা কক্ষ
১৯ জানুয়ারি,২০১৯

Leave a Reply