ঢাকার বাতাসে বিষ—কথাটা প্রায় সবারই মুখস্থ। কিন্তু কতটা বিষ, কতটা বিপজ্জনক, কতটা ভয়ংকর তা কি সঠিকভাবে আমরা জানি? সেটাও এত দিন ঢাকাবাসীসহ দেশের অনেকেই জেনেছে আমাদের দেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিদেশি কারো যৌথ গবেষণার ফলাফল থেকে, যা মাঝেমধ্যে দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকায় ছাপা হতো।
চার বছর হলো যুক্তরাষ্ট্র সরকারের একটি প্রকল্পের আওতায় ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বসিয়ে ঢাকার বাতাসে দূষণ ও বিপদের মাত্রা, সেই সঙ্গে তাত্ক্ষণিক করণীয়ও জানান দিয়ে আসছে। ইন্টারনেটে এটি রিয়াল টাইম এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) নামে পাওয়া যায়, যেটিকে বাংলায় ‘সার্বক্ষণিক বায়ুমান সূচক’ বলে এই প্রতিবেদনে ব্যবহার করা হলো। এটিই এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ও নির্ভরযোগ্য বায়ুমান সূচক বলে দেশে দেশে স্বীকৃত।
১৫ দিনের বেশির ভাগ সময় ধরে এই সূচকের দিকে তাকিয়ে থেকে শিউরে শিউরে উঠতে হয়েছে আমাদের প্রিয় রাজধানী শহর, প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষের আবাসস্থল এই ঢাকার বাতাসে দূষণ বা বিষের অবস্থা দেখে। আরো আঁতকে উঠতে হয়েছে দেশের বিশিষ্ট স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতামত শুনে। কারণ সূচকটির দিকে শুধু তাকিয়ে থেকেই নয়, সঙ্গে সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের মতামতও নেওয়া হয়েছে। তাতে উঠে এসেছে আরো ভয়াবহ সব তথ্য। এসব তথ্য-উপাত্তের কিছু কিছু এখানে তুলে ধরা হলো।
গত রবিবার সকাল ১০টায় সার্বক্ষণিক বায়ুমান সূচকে দেখা যায়, ঢাকা হয়ে আছে লাল, মানে ঢাকার বাতাস অস্বাস্থ্যকর। সূচকটি বিশ্বের ১০ হাজার শহরের বায়ুমান জানায় কয়েকটি রং ও বাতাসে ভাসমান ক্ষতিকর বস্তুকণার (ওজোন গ্যাস, হাইড্রোজেন সালফাইড, সিসা, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড) পরিমাণ দিয়ে। বায়ুমান ভালো হলে সবুজ, মোটামুটি ভালো হলে হলুদ, কারো কারো জন্য অস্বাস্থ্যকর হলে কমলা, সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর হলে লাল, অতি অস্বাস্থ্যকর হলে বেগুনি আর বিপজ্জনক হলে খয়েরি রং দিয়ে সূচকে চিহ্নিত করা হয়। গত ১৫ দিনের ৩৬০ ঘণ্টার কোনো একটি মুহূর্তও সূচকটিতে ঢাকার রং সবুজ তো দূরের কথা, হলুদ, এমনকি কমলাও দেখা যায়নি। বেশির ভাগ সময় দেখা গেছে বেগুনি রং, মানে অতিমাত্রায় অস্বাস্থ্যকর।
এরপর বেশি দেখা গেছে লাল রং বা অস্বাস্থ্যকর। আর বিপজ্জনক রং খয়েরি দেখা গেছে লালের চেয়েও বেশি সময়। ওই দিনের সূচকে ৩৬ ঘণ্টার ঢাকার গড় বায়ুমান দেখানো হয়েছে বেগুনি রঙে, অর্থাৎ অতি অস্বাস্থ্যকর। একিউআইয়ের গত চার বছরের সংরক্ষিত সার্বক্ষণিক তথ্য ঘেঁটেও একই রকমের চিত্র দেখা গেছে।
গত রবিবার সকাল ১০টার সূচকে অস্বাস্থ্যকর বায়ুর কারণে ঢাকার বাসিন্দারা স্বাস্থ্যগত সমস্যায় পড়তে পারে—এমন হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছিল। বিশেষ করে বক্ষব্যাধির রোগী ও শিশুদের বাইরে যেতে বারণ করা হয়েছিল। ওই দিন বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বায়ুমান সূচকে ঢাকা শহরকে অতি অস্বাস্থ্যকর বা বেগুনি হতে দেখা যায়। দুপুর ২টার পর থেকে বেগুনি হতে থাকে আর ঢাকাবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে সতর্ক করা হয়। এ ছাড়া ফুসফুসজনিত ও বক্ষব্যাধি রোগীদের বাইরে যেতে পুরোপুরি বারণ করা হয়। এ ছাড়া সুস্থ ব্যক্তিরাও বাইরে গিয়ে অসুস্থ হতে পারে—এমন সতর্কতাও দেওয়া হয়।
সার্বক্ষণিক বায়ুমান সূচকে ঢাকার বাতাস লাল, বেগুনি ও খয়েরি অর্থাৎ অস্বাস্থ্যকর, অতি অস্বাস্থ্যকর ও বিপজ্জনক যখন যে অবস্থায় দেখা গেছে, তখনই ফোন করে বিশিষ্ট স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছে। রবিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্ষব্যাধি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ কে এম মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বায়ুদূষণের ফলে সবচেয়ে বেশি রোগাক্রান্ত হয় শিশুরা। ঢাকা শহরের দূষিত বায়ুর কারণে প্রাথমিকভাবে অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে দূষিত বায়ুর মধ্যে থাকলে ফুসফুস, লিভার বা কিডনির ক্যান্সার হতে পারে।’
বাংলাদেশে লাং ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ডা. সাইফুদ্দিন বেননূর বলেন, ‘বায়ুতে থাকা সিসা মস্তিষ্কের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এর ফলে মানুষ দ্রুত বুড়িয়ে যায়, মস্তিষ্কের ক্ষমতা কমে যায়। বিশেষ করে শিশুরা দুর্বল বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বেড়ে ওঠে। এ ছাড়া বায়ুতে থাকা ক্ষতিকর বস্তুকণা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করলে ফুসফুস শক্ত হয়ে অক্সিজেন প্রবেশে বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে ক্যান্সারসহ নানা রোগ জন্ম নেয়।’
পরদিন সোমবারও ওই সূচকের দিকে তাকিয়ে থেকে দেখা যায়, বিকেল ৩টা পর্যন্ত ঢাকা হয়ে আছে বেগুনি। আর সন্ধ্যা ৬টার দিকে হয়ে ওঠে খয়েরি, মানে বিপজ্জনক। এই দিনের সূচকে ঢাকার ৪৮ ঘণ্টার গড় বায়ুমান সূচক দেখানো হয় খয়েরি রঙে, অর্থাৎ বিপজ্জনক। সূচকে সব বয়সের নাগরিকদের বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা জারি করা হয়। বাইরে গেলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয়।
ঢাকার বাতাসের এ দুরবস্থা আর সতর্কবার্তা দেখে ওই দিন সন্ধ্যায় ঢাকাবাসীর অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য রাস্তায় বের হলে বিষয়টি নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয়নি। কারো প্রাত্যহিক কাজকর্মে কোনো পরিবর্তনও লক্ষ করা যায়নি।
সড়কে যানবাহন আর মানুষ গিজগিজ করছে। সব বয়সের মানুষের সঙ্গে দেখা গেছে শিশুদেরও। বারিধারার নতুন বাজার এলাকার ফুট ওভারব্রিজ দিয়ে পাঁচ বছর বয়সের মেয়েকে নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন সুমাইয়া পারভীন। তাঁর কাছে বিষয়টি উত্থাপন করলে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিনই মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যেতে হয়। বেশিক্ষণ বাইরে থাকলে সর্দি ও অ্যালার্জির সমস্যা দেখা যায় মেয়েটার। ঢাকার বাতাসের মান খারাপ জানি; কিন্তু কী বা করার আছে! মেয়েটার স্কুল তো মিস দেওয়া যায় না।’
গতকাল রাতে এই প্রতিবেদন লিখে জমা দেওয়ার সময় একিউআই-এর দিকে তাকিয়ে আরেকবার আঁতকে উঠতে হয়। গতকাল শুক্রবার ছুটির দিন সত্ত্বেও সূচকে ঢাকার গত ৪৮ ঘণ্টার গড় বায়ুমান দেখানো হয়েছে বেগুনি রঙে, অর্থাৎ অতি অস্বাস্থ্যকর (এই দুই দিনের ঢাকার বাতাসে ক্ষতিকর বস্তুকণার পরিমাণ ছিল ২৩৪)।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, খোদ রাজধানী শহরে বায়ুদূষণের এ ভয়ংকর অবস্থা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোরও কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে নরওয়েভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এনআইএলইউ বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে যৌথভাবে একটি গবেষণা পরিচালনা করে। ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা, সড়কের ধুলা, যানবাহন এবং বায়োগ্যাস পোড়ানোকে দায়ী করে তারা। ঢাকার বায়ুদূষণে ইটভাটা ৫৮ শতাংশ, সড়কের ধুলা ১৮ শতাংশ, যানবাহনের ধোঁয়া ১০ শতাংশ, বায়োগ্যাস পোড়ানো ৮ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণ ৬ শতাংশ দায়ী বলে জানানো হয়।
ইন্টারনেটে তথ্য ঘেঁটে জানা যায়, অন্যান্য দেশে বায়ুমান সূচক বিপজ্জনক, এমনকি অস্বাস্থ্যকর দেখালেই ব্যাপক সতর্কতা অবলম্বন করা হয় । শহরের উন্নয়নকাজ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রেও মানা হয় পরিবেশ সম্পর্কিত সব আইন-কানুন। প্রতিবেশী দেশ ভারতের ১০টি শহরের বায়ুর মান দেখানো হয় একিউআইতে। সেখানকার বাতাস বিপজ্জনক বা অস্বাস্থ্যকর হলেই স্কুল-কলেজ ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়।
চিকিৎসাবিদ ডা. এ কে এম মোশারফ হোসেন বলেন, ‘বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি থাকলে বিদেশে স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। অথচ আমাদের দেশে বিষয়টি নিয়ে সরকারি কোনো সংস্থা তেমন কাজই করে না। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ চাইলে আবহাওয়া ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মাধ্যমে বায়ুদূষণের মাত্রা জনগণকে অবহিত করতে পারে।’
ডা. সাইফুদ্দিন বেননূর বলেন, ‘ঢাকার বেশির ভাগ মানুষ জানেই না যে তারা কত ভয়ংকর বায়ুদূষণের শহরে বাস করে। অন্যান্য দেশের পরিবেশ ও আবহাওয়া বিভাগ থেকে তথ্য নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালানো হয়। আমাদের দেশে এসবের কিছুই না হওয়ায় শহরবাসী থাকে চরম ঝুঁকির মধ্যে। ’
একিউআইতে সার্বক্ষণিক বায়ুমানের পাশাপাশি পূর্বাভাসও দেওয়া হয়। জানা গেছে, বাংলাদেশ আবহাওয়া বা পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে বায়ুর মান সম্পর্কে কোনো পূর্বাভাস দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। এমনকি বায়ুদূষণের তীব্রতা পরিমাপের নির্দিষ্ট প্রযুক্তিও নেই দেশে।
২০০৯ সালের দিকে জাতীয় সংসদ ভবনের ছাদে বায়ুমান পরিমাপের যন্ত্র বসানো হলেও তা থেকে কোনো তথ্য পায় না আবহাওয়া অধিদপ্তর। এ ছাড়া বায়ুদূষণ কমাতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, আবহাওয়া অধিদপ্তরেরও কোনো ধরনের কর্মসূচি নেই। অথচ সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সময় দেওয়া হয় আবহাওয়ার পূর্বাভাস। বায়ুর মান নিয়ন্ত্রণে নির্দিষ্ট কোনো কর্মসূচি না থাকার বিষয়টি সিটি করপোরেশন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর এবং আবহাওয়া অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কাজী সারওয়ার ইমতিয়াজ হাশমী বলেন, ‘বায়ুদূষণ পরিমাপের কোনো প্রকল্প এখন পরিবেশ অধিদপ্তরের হাতে নেই। উন্নয়ন প্রকল্প এলাকার ধূলিকণা ও মালামাল বায়ুদূষণের বড় কারণ। মেট্রো রেল, সড়ক উন্নয়ন, ভবন ভাঙাসহ বেশ কয়েকটি কারণে ঢাকার বায়ুর মান নিম্নতর। প্রকল্প এলাকায় পানি ছিটানোর ব্যাপারে এরই মধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এটি নিশ্চিত না করলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’ (কালের কণ্ঠ)
বার্তা কক্ষ
১২ জানুয়ারি,২০১৯