Home / জাতীয় / রাজনীতি / খেলাপি ঋণ আদায় হলে তা দিয়ে তিনটি পদ্মা সেতু বানানো সম্ভব
LOAN

খেলাপি ঋণ আদায় হলে তা দিয়ে তিনটি পদ্মা সেতু বানানো সম্ভব

দেশের ব্যাংকিং খাতে যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ আছে তা আদায় হলে বর্তমানে চলমান বড় বড় অনেকগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। এর মধ্যে ৩টি পদ্মা সেতু অথবা ৩টি পদ্মা রেলওয়ে ব্রিজ, ৩টি মাতারবাড়ি পাওয়ার প্লান্ট, ৫টি মেট্রোরেল বা ৭টি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়ন সম্ভব। সিপিডি বলছে, দেশের সামস্টিক অর্থনীতি আগের চেয়ে দুর্বল হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে দেশের সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাবে না। এতে প্রবৃদ্ধির গতি আরো কমবে।

এদিকে দেশের অর্থনীতিতে ৪টি প্রধান সমস্যার বিস্তারিত তুলে ধরে সংস্থাটি। এগুলো হলো- রাজস্ব আদায়ে গতি কম, ব্যাংক খাতের দুর্দশা, শেয়ারবাজারে সংকট এবং বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে ঝুঁঁকি। গতকাল রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়নে ‘২০১৯-২০ অর্থবছর প্রারম্ভিক মূল্যায়ন’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশকালে সিপিডি এসব তথ্য তুলে ধরে।

প্রতিবেদনগুলো তুলে ধরেন যথাক্রমে সিপিডির সিনিয়র রিসার্স ফেলো ড. তৌফিকুল ইসলাম খান, নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও সিপিডি‘র বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। সেমিনারে বাংলাদেশের রাজস্ব খাত, ব্যাংক, পুঁজিবাজার এবং বৈদেশিক লেনদেনের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে ৪টি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

সিপিডির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ ও রাজনৈতিক প্রভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দুর্বল করে দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। যা ব্যাংক থেকে বিতরণকৃত ঋণের ১১.৬৯ শতাংশ। শক্ত হাতে খেলাপি ঋণ দমন করা গেলে আমাদের দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৪.৪৩ শতাংশ বেশি হতে পারত।

গবেষণায় তুলে ধরা হয়, ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে মোট খেলাপি ঋণের ৪২ শতাংশ ছিল বেসরকারি ব্যাংকের। কিন্তু ২০১৮-১৯ এসে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৬ শতাংশে।

প্রতিবেদন মতে, খেলাপি ঋণ আদায় হলে তার মাধ্যমে আলাদাভাবে বাংলাদেশের চলমান অনেকগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল। যেমন, ৩টি পদ্মা সেতু অথবা তিনটি পদ্মা রেলওয়ে ব্রিজ, ৩টি মাতারবাড়ি পাওয়ার প্লান্ট, ৫টি মেট্রোরেল অথবা ৭টি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র।

ব্যাংকিং খাতের মূলধন সম্পর্কে বলা হয়, ঋণ বিতরণের তুলনায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। এ কারণে দিন দিন বেড়ে চলেছে কল মানি (আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার) থেকে দৈনিক ভিত্তিতে টাকা ধার করার প্রবণতা। এছাড়া সামপ্রতিক সময়ে দেখা গেছে, কিছু বিশেষ ব্যাংকে সরকারি প্রণোদনার মাধ্যমে আমানত বৃদ্ধি করা হচ্ছে। যা আর্থিক খাতের জন্য মোটেও সুখকর নয়। ২০০৯-১৭ সাল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন ব্যাংকে ১৫ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা তারল্য সরবরাহ করেছে সরকার। এ কারণে খারাপ ব্যাংক গুলো আরো উৎসাহিত হবে বলে ধারণা সিপিডির।

ব্যাংকিং খাতের বিভিন্ন তথ্য পাওয়া আগের তুলনায় অনেকটাই দুষ্কর হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে পর্যাপ্ত তথ্য না পাওয়ায় সুশাসন ও জবাবদিহিতার অভাব থেকেই যাচ্ছে বলে মনে করছেন গবেষকরা। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং বিচার ব্যবস্থাকে আরো স্বচ্ছ ও সক্রিয় করার পরামর্শ দিয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি। পুরো প্রতিবেদন নিয়ে সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশে ব্যক্তিখাতের ঋণ প্রবাহ সর্বকালের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে কম, অথচ প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে সেই টাকা ফেরত দিচ্ছে না, ব্যাংকগুলো তারল্য সংকট রয়েছে। ব্যক্তি শ্রেণি বলছে, তারা ব্যবসায় লাভ করতে পারছেন না। তারপরেও প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, এটা কিভাবে সম্ভব হচ্ছে?

তিনি বলেন, সরকার আর্থিক খাত সংস্কার না করে প্রণোদনার পথে যাচ্ছে। কিন্তু এক সময় প্রণোদনা দেয়ার ক্ষমতাও সরকারের কমে যাবে। কারণ রাজস্ব আয় কমে গেছে, দেশে এত প্রবৃদ্ধি হলো, তাহলে আয় গেলো কোথায়, বর্ধিত আয়ের ট্যাক্স কোথায়? হিসাব হলো, রাজস্ব আয় যদি কমে যায়, বাজেট ঘাটতি যদি বেড়ে যায়, ব্যাংকিং খাতে যদি বিপর্যয় নেমে আসে, তাহলে প্রবৃদ্ধি বাড়বে কিভাবে? তিনি বলেন, অর্থনীতি সংস্কারের বিপরীতে তথাকথিত প্রণোদনা ভিত্তিক অর্থনীতি টেকসই হওয়া মুশকিল। তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে বড় ধরনের সঙ্কট রয়েছে। যে সব কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসছে সেগুলো বাজারে আসার পর সমমান ধরে রাখতে পারছে না। তারপরও আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে! শুধু তাই নয়, আমদানির ক্ষেত্রে পুঁজিপণ্য আসার ক্ষেত্রে এবার নেতিবাচক হয়ে গেছে, তারপরেও প্রবৃদ্ধি বাড়ছে!

ড. দেবপ্রিয় বলেন, অর্থনীতির পুরোটাই এখন কর ফাঁকি, বিদেশে অর্থ পাচার, ব্যাংকের টাকা নিয়ে ফেরত না দেয়ার অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে কিভাবে ১০ টাকার জিনিস হাজার টাকায় কেনা যায় সেই অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে।

তিনি বলেন, বিভিন্ন খাতে যে ঘাটতি রয়েছে, সরকার সে সব ঘাটতি মোকাবিলায় কখনো প্রণোদনা দিয়ে, না হয় টাকার সঞ্চার করে কিংবা কর রেয়াদ দিচ্ছে। অর্থাৎ অর্থনীতির ভিতরে এক ধরনের প্রণোদনার আসক্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রতিযোগিতার সক্ষমতার বিপরীতে এই ধরনের আর্থিক প্রণোদনা আর্থিক আসক্তি তৈরি হচ্ছে। এর বড় কারণ হলো- সরকার আর্থিক খাতে কোনো সংস্কার করছে না সেজন্য ব্যক্তিখাত ক্ষতিপূরণ হিসেবে এই ধরনের ব্যয় করছে।

দেবপ্রিয় বলেন, নির্বাচনের আগে সরকার জনগণের কাছ সংস্কারের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল গত তিন মাসে তা বাস্তবায়নের অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। সংস্কারের অভাবে যারা লাভবান হয়েছেন, তারাই সংস্কার করতে দিচ্ছেন না। অর্থাৎ যারা কর না দিয়ে, টাকা বিদেশে পাচার করে এবং ব্যাংকের টাকা নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না, পুঁজিবাজারের টাকা নিয়ে ফটকাবাজি করেন, সরকারি প্রকল্পের টাকা নিয়ে অতিমূল্যায়িত করছেন, তারা সংস্কারের শত্রু হিসাবে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছেন। এই রাজনৈতিক অর্থনীতির দুষ্টচক্র যদি ভাঙ্গতে না পারে তাহলে অর্থনীতিতে কোনো সমাধান আসবে না। আমরা চাই সরকার তার নির্বাচনি প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করুক।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ৪টি প্রধান সমস্যার বিস্তারিত তুলে ধরে সিপিডি। এগুলো হলো, রাজস্ব আদায়ে গতি কম, ব্যাংক খাতের দুর্দশা, শেয়ারবাজারে সংকট এবং বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে ঝুঁঁকি। সিপিডির মতে, ভ্যাট আইনে সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংক খাতের ঋণখেলাপিদের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। শেয়ারবাজারে বেনিফিশিয়ারি ওনার্স হিসাব খুলতে কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন), ব্যাংক হিসাব ও জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করেছে সিপিডি। পুঁজিবাজারে কোন ধরনের সংকট তৈরি হলেই সেখানে অর্থ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু অর্থসংকট পুঁজিবাজারের মূল সমস্যা নয়। দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ কাঠামো এবং করপোরেট সুশাসনের অভাবকেই পুঁজিবাজারে প্রধান সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছে সিপিডি।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, পুঁজিবাজারে দুষ্টচক্রের আনাগোনা বেড়ে গেছে। এরফলেই ক্রমাগতভাবে পতন হচ্ছে সূচকের। দুর্বল আইপিও, অস্বচ্ছ বার্ষিক প্রতিবেদন, বিও অ্যাকাউন্টের অপর্যাপ্ত স্বচ্ছতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের প্রশ্নবিদ্ধ কার্যক্রম অস্থিতিশীল করে তুলেছে পুঁজিবাজারকে। এসব সমস্যা সমাধানে কোম্পানিগুলোর স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার কোন বিকল্প নেই। এছাড়া নীতিনির্ধারণী সংস্থাগুলো স্বাধীনভাবে করছে কিনা এ বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সিপিডির গবেষকরা।

তথ্য উপস্থাপন করে বলা হয়, আমাদের সামনে সবসময় ২৭ লাখ অ্যাকাউন্টের তথ্য উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু প্রকৃত চিত্র আসলে ভিন্ন। বর্তমানে পুঁজিবাজারের মোট বিও একাউন্টের সংখ্যা ৬৬ লাখের অধিক। প্রতিবছর যে হারে বিও একাউন্ট বাড়ছে সে হারে বিনিয়োগ বাড়ছে না। সুতরাং নতুন নতুন একাউন্টের মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে তুলে নেওয়া হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এই সমস্যা সমাধানে বিও একাউন্ট খোলার জন্য টিআইএন নাম্বার, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দেয় সিপিডি।

বার্তা কক্ষ, ৪ নভেম্বর ২০১৯