Home / জাতীয় / এত লাশ রাখবো কোথায়
fire
চকবাজার

এত লাশ রাখবো কোথায়

পুরান ঢাকার বাতাসে ফের ছড়িয়ে পড়েছে পোড়া লাশের গন্ধ। বুধবার রাতে শোকের শহরে পরিণত হয় ঢাকা। ২০১০ সালের নিমতলী ট্র্যাজেডির পর এ রাতে ফের ঘটে গেল আরেক ট্র্যাজেডি। রাজধানীর চকবাজার এলাকার কয়েকটি ভবনে লাগা আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে অঙ্গার হয়েছে ৭৮টি তাজা প্রাণ।

এখনও নিখোঁজ ৯ জন। পোড়া লাশ উদ্ধার করে নেয়া হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে। এলাকাবাসীসহ হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের অনেকের মুখেই উচ্চারিত হচ্ছিল- ‘এত লাশ রাখব কোথায়।’

এছাড়া অগ্নিদগ্ধ ও আহত অন্তত ৬০ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। ৯ জনকে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

এই ঘটনায় নিহতের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। এ ব্যাপারে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন ধরনের তথ্য দিয়েছেন। এদিন দুপুরে ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান সাংবাদিকদের বলেন, মৃতের সংখ্যা ৮০ থেকে ৮১ জন হতে পারে। তবে এটা প্রকৃত তথ্য নয়। পরে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

কিন্তু রাত সাড়ে ১২টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে পরিদর্শক আতাউর রহমান টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৬৭ জন। এর আগে মনে হয়েছিল নিহতের সংখ্যা ৮১ জন। কারণ, ব্যাগে করে সিরিয়াল দিয়ে লাশ মেডিকেলে পাঠানো হয়।

পরে দেখা যায়, কোনো ব্যাগের লাশের নিচের অংশ আছে, আবার উপরের অংশ নেই। হাত আছে, পা নেই। এসব মিলিয়ে দেখার পর লাশের প্রকৃত সংখ্যা ৬৭টি নির্ণয় করা হয়। এর মধ্যে ৪৫ টি শণাক্ত হয়েছে। বাকি ২২টি এখনও শণাক্ত হয়নি। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে এসব লাশ শণাক্ত করা হবে। যেসব লাশ শণাক্ত হয়েছে সেগুলো স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।

এছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ সকালে সাংবাদিকদের জানান, এখন পর্যন্ত আমাদের মর্গে (মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গ) ৬৭টা লাশ পেয়েছি। আরও ১১টা লাশ আমাদের হাসপাতালে মর্গে আছে। এ ৭৮ লাশের মধ্যে কিছু কিছু আছে তাদের চেহারা দেখে শনাক্ত করা যাবে।

আর কিছু লাশ আছে তাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট লাগবে, ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে শনাক্ত করা যাবে। তবে কিছু লাশ আছে চেহারা এবং ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে শনাক্ত করা যাবে না, তাদের আমরা ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের মাধ্যমে শনাক্ত করব। তিনি আরও জানান, নিহতের মধ্যে ৩৩ জনের লাশ শনাক্ত করা হয়েছে। সুরতহালের পর লাশগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

কিন্তু রাত পৌনে ৯টার দিকে ডা. সোহেল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ৪২টি মৃতদেহ আমরা পুলিশের মাধ্যমে তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করেছি। আরও ২৫টি মৃতদেহ মর্গে আছে। তাদের শনাক্ত করা যায়নি। এর মধ্যে যদি কেউ এসে মৃতদেহ শনাক্ত করেন, তবে তাকে তা বুঝিয়ে দেয়া হবে।

ডা. সোহেল আরও বলেন, হস্তান্তর না করতে পারলে অবশিষ্ট মৃতদেহ বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠানো হবে। কারণ, ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে এত লাশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। পরবর্তীতেও যদি কেউ লাশ দাবি করে তাহলে তাদের ওই হাসপাতালে পাঠানো হবে। সেখানেও তারা লাশ শনাক্ত করার সুযোগ পাবেন। আমরা প্রতিটি মৃতদেহ থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছি। তা ডিএনএ ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। কেউ যদি আরও খোঁজ করেন তাহলে তাদের ডিএনএ ল্যাবে পাঠানো হবে।

এ ঘটনায় কেমিক্যাল আইনে চকবাজার থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করেছে পুলিশ। আর ফায়ার সার্ভিসের ডেপুটি ডিরেক্টর দিলীপ কুমার ঘোষকে প্রধান করে গঠন করা হয়েছে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি। এক সপ্তাহের মধ্যে তাদের রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া ১২ সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়।

এ কমিটিকে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। আর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় স্বজনদের তথ্য জানতে হটলাইন চালু করেছে চকবাজার থানা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। এ হটলাইনে (৯৫৫৬০১৪) কল করে নিখোঁজসহ স্বজনরা যে কোনো ধরনের তথ্য জানতে এবং জানাতে পারবেন।

এদিকে হতাহত হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা বৃহস্পতিবার ভোর থেকেই ভিড় করতে থাকেন হাসপাতালে। প্রিয়জনের খোঁজে ছোটেন জরুরি বিভাগ থেকে মর্গে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পড়ে থাকা লাশের সারি থেকে প্রিয়জনকে অনেকে চিনতেও পারছেন না। মোবাইল ফোনে ছবি দেখিয়ে খুঁজছেন স্বজনদের। কেউ প্রিয় সন্তান, কেউবা বাবা এবং অনেকে ভাইকে হারিয়ে পাগলপ্রায়। স্বজনদের কান্নায় হাসপাতাল ও চকবাজারের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। তাদের সান্ত্বনা দিতে গিয়েও অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে ঘটেছিল ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। ওই ঘটনায় ১২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। সেই শোক এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন পুরান ঢাকার মানুষ। চকবাজারের ভয়াবহতা যেন নিমতলী ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি। একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় কেমিক্যাল কারখানা থাকায় আগুন দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক ঘণ্টায় চকবাজার এলাকা রূপ নেয় ‘মৃত্যুপুরীতে’।

ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিটের ২শ’ কর্মীর প্রায় ৫ ঘণ্টার প্রাণপণ চেষ্টায় রাত সোয়া ৩টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এতে অংশ নেয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীও। চকবাজার এলাকার বিদ্যুৎ ও গ্যাসলাইন সংযোগ সাময়িক বিচ্ছিন্ন করে আশপাশের ভবনের বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

আগুনের ভয়াবহতা যাতে আশপাশের ভবনে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য সেইসব ভবনও পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেয়া হয়। ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উদ্ধার কাজে অংশ নেন এলাকার সাধারণ মানুষও। খুবই ঘনবসতি এবং রাস্তা সরু হওয়ায় আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয় ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের।

আগুনের সূত্রপাতের ১৫ ঘণ্টা পর বৃহস্পতিবার দুপুর ১টায় আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ধারকাজের সমাপ্তি ঘোষণা করেন দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। অভিযান সমাপ্ত হলেও ফায়ার সার্ভিসের তিনটি টিম ঘটনাস্থলে থাকবে বলে জানান তিনি।

মর্মান্তিক এ ঘটনায় গভীর শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। নিহত ও আহতদের পরিবারকে সব ধরনের সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। পুরো ঘটনা প্রথম থেকেই সরাসরি পর্যবেক্ষণ করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ঘটনার পরপরই সেখানে ছুটে যান ঢাকা সিটি কর্পোরেশন দক্ষিণের মেয়র সাইদ খোকন। বৃহস্পতিবার সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতারা ঘটনাস্থল ও হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। আগুনের ভয়াবহতার খবর পেয়ে ভোর থেকে হাজার হাজার উৎসুক জনতা চকবাজারের ঘটনাস্থলে আসেন। জনতার ভিড়ে উদ্ধারকাজ চালাতে বেশ বেগ পেতে হয় উদ্ধারকর্মীদের।

জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের সমন্বয়কারী অধ্যাপক সামন্তলাল সেন বলেন, চিকিৎসাধীন ৯ জনের অনেকেই ঝুঁকিমুক্ত নন। এদের মধ্যে চারজন বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। একজনকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেয়া হয়েছে। নিমতলী ট্র্যাজেডি থেকে আমরা কেউই আসলে শিক্ষা নেইনি বলে জানান তিনি।

আগুনের সূত্রপাত নিয়ে ভিন্নমত পাওয়া গেছে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা জানান, রাত পৌনে ১১টার দিকে পুরান ঢাকার নন্দকুমার দত্ত সড়কের চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের সামনে একটি গাড়ির সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকেই এ আগুনের সূত্রপাত। সিলিন্ডার বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে বৈদ্যুতিক খুঁটির ট্রান্সফরমার বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এরপরই পাশের খুঁটির আরও দুটি ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।

তবে যেখান থেকেই আগুনের সূত্রপাত হোক মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে পড়ে পাঁচটি ভবনে। চারতলার ওয়াহিদ মনজিলের নিচতলায় প্লাস্টিক ও দোতলায় প্রসাধনসামগ্রী, প্লাস্টিক দানা ও রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের গুদাম থাকায় দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের আরও চারটি ভবনে।

পাশের কয়েকটি খাবারের হোটেলের গ্যাস সিলিন্ডারেও বিস্ফোরণ ঘটে। মুহূর্তেই পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আগুনের লেলিহান শিখা থেকে রেহাই পাননি পথচারীরাও। রাস্তায় জ্যামে পড়েই কয়েকজন আগুনে পুড়ে মারা যান। আগুন লাগার পর চুড়িহাট্টার বাসিন্দারা রাস্তায় নেমে আসেন।

প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই বলেন, ভবনের ভেতরে থাকা দাহ্য পদার্থ থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। রিপন নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, চকবাজারে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডারগুলো অনেক পুরনো। অনেক সময় মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডারগুলো বিস্ফোরিত হয়। এখানেও মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে।

ইসমাইল নামের এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, ঘটনার দেড় ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিস এসেছে। ফায়ার সার্ভিস দ্রুত এলে ক্ষয়ক্ষতি হয় তো আরও কম হতো।

সরেজমিন দেখা গেছে, চুড়িহাট্টা জামে মসজিদের সামনেই পাঁচটি সড়কের সংযোগস্থল। পূর্ব দিক থেকে প্রধান সড়কটি এসে মসজিদের সামনে আরও চারটি সড়কের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এ পাঁচটি সড়ক এতটাই সরু যে, এর প্রশস্থতা ১৪ থেকে ১৬ ফুটের বেশি নয়। দুটি গাড়ি পাশাপাশি চলাচল করতেও যেন গা ঘেঁষা হয়।

এ পাঁচ সড়কের সংযোগস্থলে মূলত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে মসজিদের তিন পার্শ্বের পাঁচটি ভবন এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে, সেগুলোর মধ্যে তিনটি ঝুঁকিতে রয়েছে। দেখে যেন মনে হয় এক ধ্বংসস্তূপ। অগ্নিকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজী ওয়াহেদ মঞ্জিল।

রেড ক্রিসেন্টের পক্ষ থেকে দফায় দফায় মাইকিং করে এ ভবনের আশপাশে মানুষের চলাচল ও অবস্থান না করার জন্য বলা হয়। তবুও সেখানে ছিল উৎসুক জনতা, ফায়ার সার্ভিস ও গণমাধ্যম কর্মীদের ভিড়।

সরেজমিন আরও দেখা গেছে, চুড়িহাট্টা মসজিদের সামনের সড়কে পুড়ে অঙ্গার হয়ে আছে অর্ধশতাধিক গাড়ি, রিকশা, ভ্যান, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল ও ঠেলাগাড়ি। এসব যানবাহনের শুধু ধাতব অংশগুলো পড়ে আছে। আগুন নেভানোর পানির সঙ্গে কয়লা ধোয়া কালো পানি রাস্তায় জমে আছে।

সড়কগুলোতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য বডি স্প্রের বোতল, শ্যাম্পু, পাউডারসহ বিভিন্ন প্রসাধনীর বোতল, প্লাস্টিকসামগ্রীর কাঁচামাল (গুঁড়ো আকৃতির পিপি দানা)। যত্রতত্র জুতা, ভ্যানিটি ব্যাগ ও কাপড় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। বিদ্যুতের লোহার দুটি খাম্বা ভেঙে রাস্তায় পড়ে আছে। আগুনে পুড়ে গেছে বৈদ্যুতিক তার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বৈদ্যুতিক মিটার।

আগুনের তীব্র তাপ ও লেলিহান শিখায় চুড়িহাট্টা মসজিদের পূর্ব ও দক্ষিণ অংশের টাইলস ভেঙে নিচে পড়েছে। মসজিদের দেয়ালে কালো ও হলুদ ছোপ ছোপ দাগ। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, হাজী ওয়াহেদ মঞ্জিলের দোতালায় ছিল বডি স্প্রের গোডাউন।

অগ্নিকাণ্ডে এসব স্প্রের বোতল বিস্ফোরিত হয়ে আশপাশের ভবন ও মসজিদে বুলেটের মতো আঘাত হেনেছে। একদিকে আগুনের উত্তাপ ও অপরদিকে বডি স্প্রের বোতলের আঘাতে মসজিদের পূর্ব ও দক্ষিণ অংশের দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ওয়াহেদ মঞ্জিলের দোতলায় থাকা দাহ্য পদার্থের গোডাউন আগুনের তীব্রতা অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। ওই ভবনের দোতলায় ছিল বডি স্প্রের গোডাউন। আগুনে বডি স্প্রের বোতলগুলো বিস্ফোরিত হয়। এতে ওই ভবনের দোতলার দেয়াল ভেঙে পড়ে।

এমনকি বিপরীতে থাকা ভবনটিতে আঘাত হানে। ভবন দুটি অবকাঠামোগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। ওয়াহেদ মঞ্জিলের পশ্চিমে থাকা আরেকটি ভবন যেখানে বিভিন্ন ধরনের কারখানা ছিল সেই ভবনটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুড়ে গেছে ওই ভবনের ভেতরে থাকা কল-কারখানাগুলো।

এলাকাবাসীর সহযোগিতায় ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা রাত ৩টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস কন্ট্রোল রুম। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান বলেন, এখানে আসার রাস্তার দু’পাশই সরু। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি সহজে ঢুকতে পারেনি।

তবে শেষ পর্যন্ত কয়েক ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছি। ভবনে দাহ্য পদার্থ থাকার কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আগুনের সূত্রপাত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে একটি কমিটি করা হয়েছে। তদন্ত করলেই প্রকৃত কারণ জানা যাবে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. জাবেদ পাটোয়ারী জানিয়েছেন, পুরান ঢাকা কেমিক্যালমুক্ত করতে সব সংস্থা একসঙ্গে কাজ করলে পুলিশ তাতে সহায়তা দেবে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। তিনি যুগান্তরকে বলেন, এটা একটি মানবসৃষ্ট বিপর্যয়। এ বিপর্যয়ের পেছনে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো গাফিলতি আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আমরা বিষয়টি নিয়ে সোমবার বৈঠক করে তদন্ত কমিটি গঠন করব। ঘটনার সঠিক তদন্ত ও ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে সরকারের করণীয় নিয়ে পর্যালোচনা প্রতিবেদন দেব।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির মহাসচিব জহিরুল হক ভূঁইয়া সাংবাদিকদের জানান, এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে ১০০ কোটি টাকার মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমরা বিস্তারিত পরে জানাব।

নিহতদের পরিবার, আহত এবং ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণ কাজ চালানোর জন্য সিপিবির প্রধান কার্যালয়ে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দলটি।

অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মামলা : চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ৫-৭ জনকে আসামি করে বৃহস্পতিবার বিকালে চকবাজার থানায় অপমৃত্যু মামলা করে। পুলিশের চকবাজার জোনের এডিসি কামাল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। ওই মামলায় সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

চকবাজার মডেল থানার ওসি শামীম অর রশিদ তালুকদার বলেন, দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে একটি মামলা করা হয়েছে। মামলায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়েছে। ভবনের মালিককে আসামি করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এখনও নিশ্চিত নই, ভবন মালিক জীবিত নাকি মৃত। (যুগান্তর)

২২ ফেব্রুয়ারি,২০১৯