চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলা থেকে দক্ষিণে হাইমচর উপজেলা পর্যন্ত মেঘনা নদীর পশ্চিম পাড়ে প্রায় ৩০টি চরাঞ্চল রয়েছে। এসব চরে বসবাসরতরা অধিকাংশই জেলে ও কৃষক করে থাকেন। নিজেদের উৎপাদিত খাদ্য থাকলেও স্বাস্থ্য-শিক্ষা ব্যবস্থার খুবই সংকট রয়েছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে পায়ে হেঁটে এক কান্দি (মহল্লা) থেকে অন্য কান্দিতে যাওয়া। শহরে কিংবা উপজেলা সদরে যেতে হলে ট্রলার দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মেঘনা নদী পাড়ি দিতে হয়। চরে বাসিন্দাদের নিয়ে সরকার, জনপ্রতিনিধি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো কাজ করলেও এখন মূলধারার নাগরিক সেবা থেকে তারা অনেকাংশ বঞ্চিত। চরাঞ্চলের মানুষের চেহারা দেখতে তা ভেসে উঠে।
সম্প্রতি সময়ে মতলব উত্তর উপজেলার এখলাছপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ বোরোচর এলাকায় গিয়ে দেখা যায় বসতঘরগুলোতে ৪ থেকে ৫ শ পরিবার। আশপাশে বড় বড় মাঠ আর ফসলি জমি। চরাঞ্চলের প্রতিটি পরিবারের লোকজন ৫ থেকে ৭টি গবাদি পশু পালন করে। চরে ট্রাক্টরে ধান নেওয়া হচ্ছে।
মৌসুমী শাক-সবজি, ধান, মরিচ ইত্যাদি আবাদ করেন। এছাড়া প্রতিটি বাড়িতে দেশীয় প্রজাতির ফলগাছ রয়েছে। অনেক বাড়িতেই দেখা গেছে নারিকেল ও কলাগাছ। চরের উৎপাদিত সবজি ও দুধ দিয়ে শহরের বসবাসকারী লোকজনের দৈনন্দিন চাহিদা মেটায়। চরের এসব কৃষকের পরিশ্রমে উৎপাদন হচ্ছে সবজিসহ নানা ফসল।
সদর উপজেলার রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নটি জেলা সদর থেকে মাত্র ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার দূরত্বে মেঘনার পশ্চিম পাড়ে। এই চরেও একই চিত্র। এই চরের পশ্চিম পাশেই পদ্মানদী। এখানে প্রতিবছরই বর্ষাকালে ভাঙন দেখা দেয়।
দীর্ঘদিন ধরে চরে বসবাস করায় ভাঙন দেখলে তারা এখন আর ভয় পায় না। ভাঙা গড়ার খেলায় তারা এখন অভ্যস্ত। নতুন করে ঘর তৈরি করে, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। এই চরেও অধিকাংশ পরিবার গবাদি পশু পালন, শাক-সবজি উৎপাদন ও মৎস্য আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
এখানে একটি মাত্র উচ্চ বিদ্যালয় ও একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ওমর আলী উচ্চ বিদ্যালয় নামে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সবাই থাকে জেলা সদরে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা শিক্ষার গ্রহণের সুযোগ পায় ষষ্ঠ থেকে ১০ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। চরাঞ্চলে বিদ্যুৎ ও যাতায়াতের সু-ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষকরা থাকতে চায় না।মোটরসাইকেলে করে এক গ্রামে থেকে আরেক যাতায়াত করে চরে মানুষ।
দক্ষিণ বোরে চর এলাকার বাসিন্দা মেহেরজান বেগম (৫০) বলেন, আমাগো থাকা খাওয়ার কোনো সমস্যা নাই। তবে বাবা চিকিৎসার জন্য খুবই কষ্ট হয়। চরে কোনো ডাক্তার নাই। চিকিৎসার জন্য নদীর পূর্বপাড়ে গেলেও একদিন চলে যায়।
মেহেরজান বেগমের মতো অনেক বয়স্কলোকই চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত।
কৃষক কলিম ঢালী বলেন, চরের শিশু থেকে সব বয়সের মানুষকেই প্রাকৃতিক দুযোর্গ মোকাবিলা করে চলতে হয়। রোদ-বৃষ্টি সবকিছুই এখন আমাদের সহ্য হয়ে গেছে। চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলে এখনকার মানুষ কিছুটা হলেও কষ্ট থেকে রেহাই পাবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা পায়ে হেঁটে চলা। তবে এখন কিছু মোটরবাইক আছে যা দিয়ে এক মহল্লা থেকে অন্য মহল্লা যাওয়া যায়। গর্ভবর্তী নারীদের নিয়ে অনেক সময় বিপদে পড়তে হয়। তাদের জন্য সরকার চিকিৎসার উদ্যোগ নিতে পারেন।
মতলব উত্তর উপজেলার এখলাছপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুসাদ্দেক আলী মুরাদ বলেন, আমার ইউনিয়নের দক্ষিণ বোরেচরই শুধুমাত্র মেঘনা নদীর পশ্চিম পাড়ে। চরাঞ্চলের মানুষের জন্য সরকার যেসব সাহায্য সহযোগিতা দিয়েছে তা আমি আন্তরিকভাবে পৌঁছানোর চেষ্টা করি। তাদের নাগরিক সেবার জন্য নদীর পূর্বপাড়ে ইউপিতে আসতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ যেকোনো সমস্যায় আমরা পাশে থাকি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
সদরের রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হজরত আলী বেপারি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেই চরাঞ্চের মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে যায়।চরে নারীরা। ছবি: বাংলানিউজ তাদের নাগরিক সেবা দেওয়ার জন্য আমরা ইতোমধ্যে ইউপিতে সৌর বিদ্যুৎ স্থাপন করে সেবা দিচ্ছি। তবে স্বাস্থ্য সেবার জন্য ভালো ব্যবস্থা নেই। প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা নিতে পারে। জটিল রোগ হলে জেলা সদরেই মেঘনা নদী পাড়ি দিতে হয়।
উচ্চ বিদ্যালয়, দাখিল মাদ্রাসা-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে আগের তুলনায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। সরকার ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো এগোলে চরের মানুষের জীবন মান আরও উন্নত হবে। (বাংলানিউজ)
বার্তা কক্ষ
৭ জুন ২০১৯