পুর্বের নির্ধারিত লাল সংকেত হিসেবে ঠিক রাত ১২ টা ১ মিনিটের সময় ভারতের ‘শিলিগুড়ি বেতার’ থেকে বাজানো হলো সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে একটি গান- ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শশুর বাড়ি।’ গানটি বাজার সাথে সাথেই চাঁদপুরের আতœঘাতী নৌ-কমান্ডোদের লাগানো মাইনগুলোর পর পর বিকট শব্দে পুরো চাঁদপুর শহর ও এর আশ-পাশের এলাকা প্রকম্পিত হয়ে বিস্ফোরণ হয়।
পরদিন আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে ফলাওভাবে প্রচার হয় । এজন্যে ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় দিন। ওই দিনের হামলাকে ‘ অপারেশন জ্যাকপট’ হিসেবে চিহ্নিত করা। অপারেশন জ্যাকপটের এ রাতে পূর্ব নির্ধারিত চাঁদপুরসহ ৮টি স্থানে হামলা চালায় নৌ কমান্ডোরা।
চাঁদপুরে ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে দু:সাহসিক নৌ-কমান্ডো বাহিনীর ভূমিকা একটি গৌরবময় অধ্যায় হয়ে আছে। নদীমাতৃক দেশ হিসেবে নৌ-কমান্ডো যুদ্ধেও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই নৌ-কমান্ডো যুদ্ধেও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় । দেশের অভ্যন্তরে পাক বাহিনীর অগ্রযাত্রাকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রত্যেকটি নৌ-পথে নৌ-কমান্ডো বাহিনীর অকুতোভয় সদস্যারা অর্তকিত আক্রমণ চালাবার পরিকল্পনা চালায় ।
১৯৭১ সালে নিজস্ব প্রচেষ্টায় উদ্ভাবিত রণসম্ভার নিয়ে জীবন হাতের মুঠোয় করে অবর্তিত হয়েছে তার নৌ-যুদ্ধে। নৌ- কমান্ডোরা পাকিস্তানী অবস্থানের ওপর তান্ডবলীলা চালিয়ে তাদের ভেতর প্রচন্ড ভীতি ও হুমকি সৃষ্টি করেছিল।
উদ্দেশ্য ছিলো নদীমাতৃক বাংলাদেশের সাথে অভ্যন্তরীণ ও আন্তজার্তিক ভাবে পাক হানাদার বাহিনীর যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা।
এজন্য নদী এলাকা হিসেবে চাঁদপুর সদরের সফরমালী এলাকার ৮ জন নৌ-কমান্ডো বাহিনীতে যোগ দেয়ার অনুমতি পায়।
অপারেশন জ্যাকপটে চাঁদপুরের অংশে সাবমেরিনার বদিউল আলমের নেতৃত্বে অভিযানে অংশ নেন চাঁদপুর সদরের একই উপজেলার সফরমালীর উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন শহীদ ইব্রাহীম বিএবিটির দু’কৃতি সন্তান নৌ কমান্ডো শাহজাহান কবির বীরপ্রতীক ও নৌ কমান্ডো শামসুল কবির দুদু। শাহতলীর বীরপ্রতীক মমিন উল্যাহ পাটওয়ারী, পশ্চিম কল্যাণদীর নৌ কমান্ডো জহিরুল ইসলাম (বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা), দাসাদী গ্রামের কৃতি সন্তান নৌ কমান্ডো আবুল হোসেন (বর্তমানে বিদ্যুৎ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) ও একইগ্রামের মরহুম সালাউদ্দিন বীরউত্তমসহ (সাবেক বিডিয়ারের মহাপরিচালক)সহ অন্যান্য জেলার অন্তত ২০ জনের একটি চৌকস দল অংশ নেয়।
অংশগ্রহণকারী সদস্যদের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন অভিযানে অংশগ্রহণকারী নৌ কমান্ডো শামসুল কবির দুলু।
তাঁরা জানায় যতদূর জানা গেছে, ১৭ মার্চ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার সংগ্রামে সাড়া দয়ে ফ্রান্সের সূদূর তুলন শহর থেকে ৮ জন বাঙালি নৌ -সেনা পালিয়ে এসে নৌ -কমান্ডো বাহিনী গঠন করার পরিকল্পনা হাতে নেয়।
এদিকে চাঁদপুর সদরের উত্তরে সফরমালী এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব , সফরমালী হাই স্কুলের তৎকালীন প্রধানশিক্ষক ও সংগ্রাম কমিটির অন্যতম সংগঠক ইব্রাহিম বিএবিটি ও অন্যান্য সদস্যদেও সার্বিক সহযোগিতায় সম্ভবত এপ্রিল মাসে এ এলাকায় ১১ জন যুবক একত্রে একই রাতে মুক্তিযুদ্ধেও উদ্দেশ্যে ও দেশকে স্বাধীন করতে ভারতে রওনা দেন।
এদেও মধ্যে ছিলেন নৌ-কমান্ডো এম. এ. রাজ্জাক, নৌ-কমান্ডো আবুল হোসেন, শাহজান কবীর (বীর প্রতিক) , নৌ -কমান্ডো সামসুল কবীর ,বীর প্রতিক মমিন উল্যাহ পাটোয়ারী, নৌ-কমান্ডো মো.জহিরুল আলম,নৌ-কমান্ডো মো.সালাউদ্দিন বীর উত্তম,বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাসেম বেপারী । এরা সবাই চাঁদপুর সদরের সফরমালী এলাকার।
এম এ রাজ্জাকের বর্ণনা মতে, সর্বপ্রথম এ দলটি ভারতের বক্স নগরে পৌঁছে। সেখান থেকে হাতিমারা যাওয়া হয়। হাতিমারা প্রায় একমাস প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার পর একটি রিক্রোটিং দল এ ক্যাম্পে চলে আসেন এবং গোপনে জানানো হলো নদীঅঞ্চলে জন্ম এমন কিছু শিক্ষিত, সাহসী, উদ্যোমীদের নিয়ে একটি নৌ-কমান্ডো দল গঠন করা হবে। পরবর্তীতে ১৫০কি.মি.দূরে পাহাড়ি এলাকায় আকাবাঁকা , উচুঁ নিচু, ঢালু রাস্তা অতিক্রম করে সকল বাছাইকৃত নৌ-কমান্ডো বাহিনী সদস্যদের ভারতের ধর্ম নগরে নিয়ে যাওয়া হয়। ধর্মনগর থেকে পুনরায় ট্রাকে করে ভাগিরথী নামক স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে।
পলাশীর ভাগিরথীতেই সকল নৌ-কমান্ডেদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এদের সংখ্যা ছিলো ৩৫০ জনের মতো। যুদ্ধে ও প্রশিক্ষণের সফলতার কৌশল হিসেবে সুঠামদেহী বাঙালি যুবকদেরকে পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ঐতিহাসিক বাংলার শেষ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজিত সেই প্রান্তরে সমবেত করা হয়।
কেননা এখানে রয়েছেই বাংলার শেষ নবাব আলীবর্দী খারঁ দৌহিত্র নবাব সিরাজের স্মৃতি বিজড়িত একটি মুহূর্ত। সেই স্মৃতি স্পর্শ করেই প্রতিটি যুবকের শপথ নিতে হয়েছিল।
শপথ বাক্য গুলো এমন ছিলো: ‘ ৯৫৭ সালের ২৩ জুন সেখানে বাংলার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল,ঠিকই সেই স্থানে দাঁড়িয়েই শপথ নিচ্ছি যে, বাংলার সূর্য আমরাই আবার উদিত করবো। এছাড়াও আমি দেশের স্বাধীনতার জন্য বিসর্জন দিতে সম্মত হয়েই এ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছি। যুদ্ধে আমার মৃত্যু হলে কেউ দায়ী থাকবে না।’
প্রথম উদ্ভোধনী পর্বে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিলো, ‘নৌ-কমান্ডো বাহিনী মূলত: সুইসাইডাল স্কোয়াড। ’ তাই তাদেরকে বলা হতো ‘ আতœঘাতী নৌ-কমান্ডো বাহিনী।’ প্রশিক্ষণ গ্রহণের ক’দিন পর (২২জুন,’৭১) সাহস যোগানোর জন্য নৌ -কমান্ডোদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল এমএ জি ওসমানী পলাশির ভাগিরথীতে কমান্ডোদের সাথে দেখা করতে আসেন।
সম্ভবত ১১ কি ১৩ আগস্ট রাতে সাবমেরিনার বদিউল আলম এর নেতৃত্বে ২০ জনের একটি চৌকষ নৌ-কমান্ডো দল সারাদেশের মত চাঁদপুর নৌ-বন্দর দখল মুক্ত করার লক্ষ্যে সফরমালী এলাকায় এসে পৌঁছে। শিক্ষাবিদ বিএবিটি ’র বাড়িতে রাত্রি যাপন করে তাকে তাদের পরিকল্পনার কথা জানানো হয়। ভাগ্যক্রমে সে দলের সদস্য ছিলেন বিটির দু’ছেলে শাহজাহান কবির সাজু ও সামছুল কবির দুলু ।
এ ছাড়া তারই দৌহিত্র বীর প্রতীক মমিন উল্যাহ পাটোয়ারী, বাড়ি পাশে তাঁর ছাত্র নৌ-কমান্ডো মো.জহিরুল ইসলাম ,মো. সালাউদ্দিন বীর উত্তম, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাসেম ও গফুর মাস্টার নামের একজন নৌ-কমান্ড এ দলের সদস্য ছিলেন।
চাঁদপুর নৌ-বন্দর হামলা করার বিষয়টির দিন ,তারিখ, ধরন ,কীভাবে, কোথায়, কখন কী করতে হবে -এ সময় ছিলো সম্পূর্ণ পরিকল্পনা মোতাবেক এবং সাবমেরিনার বদিউল আলমের ওপর ন্যস্ত ছিলো।
১৪ আগস্ট রাতে নৌকার মাঝি বা চালক স্থানীয় ক’জন যুবকের সাথে নিয়ে ৮-৯ টি ছই ওয়ালা নৌকাসহ জেলের বেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চাঁদপুর নৌ-বন্দর মোহনা দিয়ে পুরাণ বাজার রঘুনাথপুর হাজী এ করিম খানের বাড়িতে তারা আশ্রয় নেয়। এছাড়া ৪-৫ জন ওই আতœঘাতী নৌ-কমান্ডো বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন বেশে চাঁদপুরের নৌ-বন্দরে নোঙ্গরকৃত পাকিস্থানী জাহাজগুলোর অবস্থান জেনে নেয়।
পূর্ব পরিকল্পনা মতে রাতে প্রশিক্ষণের সকল কলা-কৌশল অবলম্বন করে খাদ্যবাহী জাহাজ, তৈলবাহী ট্যাংক, লন্ডনঘাটে পাক হানাদার বাহিনীদের জাহাজগুলোতে মাইন স্থাপন করে ¯্রােতের টানে কচুরীপানার আড়ালে ক্যামো-প্লাইজ (বিভিন্ন রুপ ধারণ) করে মেঘনা মোহনা দিয়ে পুরান বাজারের দক্ষিণে দিকে বের হয়ে আসে ।
পুর্বের নির্ধারিত লাল সংকেত হিসেবে ঠিক ১২ টা ১ মিনিটের সময় ভারতের ‘শিলিগুড়ি বেতার’ থেকে বাজানো হলো সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে একটি গান -‘আজকে যাবে আমার পুতুল নতুন শশুর বাড়ি।’ গানটি বাজার সাথে সাথেই আতœঘাতী নৌ-কমান্ডোদের লাগানো মাইনগুলোর পর পর বিকট শব্দে পুরো চাঁদপুর শহর ও এর আশ-পাশের এলাকা প্রকম্পিত হয়ে উঠে। পরদিন আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে ফলাওভাবে প্রচার হয়।
অপারেশনের পর তাঁরা পুনরায় ভারত চলে যান। পরবর্তীতে নভেম্বরের মাঝামাঝিতে চাঁদপুর শহরের উত্তরে এখলাছপুরের নিকট বীর উত্তম সালাউদ্দিন ও বীর প্রতীক শাহজাহানসহ কয়েকজন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধার সহায়তায় নৌ – কমান্ডো¡ মো.সেলিমের নেতৃত্বে ‘এম ভি সেমী ’ নামক নোঙ্গর করা একটি অস্ত্র ও রসদ বোঝাই জাহাজ ডুবিয়ে দেন।
তারা হাইমচরের নিকট পাক সেনাদের আরো দু’টো রসদ বোঝাই জাহাজ ডুবিয়ে দেন।
পরবর্তীতে পাক হানারা জানতে পারে নৌ-কমান্ডোদের বাড়ি সফরমালী এবং শহীদ বিএবিটির বাড়িতে তারা আত্মগোপন করে আছে তাই ওই রেষধরেই হঠাৎ কয়েকজন পাকহানা ও এদেশীয় তাদের দোসরদের সহায়তায় ১৯৭১ সালের ১৭ আগস্ট ভোরে শহীদ বিএ বিটির বাড়িতে নৌকা যোগে আসে এবং হাতে নাতে বিএ বিটিকে ধরে ফেলে।
পুরো বাড়ি তল্লাশী চালানোর পর শহীদ বিটি ও বিন্দাবন নামক জনৈক ব্যক্তিকে আটক করে। পরে হিন্দু লোধবাড়ির পেছনে তাদের দু’জনকে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা নৌকা যোগে চলে আসে।স্বাধীনতা যুদ্ধে অবিস্মরণীয় ভুমিকার জন্য চাঁদপুরের নৌ-কমান্ডোরা বাঙালী জাতির হৃদয়ে চির অম্লান হয়ে থাকবেন।
প্রতিবেদক- আবদুল গনি
৭ ডিসেম্বর, ২০১৮
রেডিওতে বেজে উঠা সেই গান—–