আগামী দিনে বিএনপি কোন পথে এগোবে বা রাজনীতি কী হবে, তা-ই স্থির করতে পারছে না দলটি। বরং সময়ক্ষেপণের মধ্য দিয়ে এক ধরনের ঢিলেঢালাভাবে এগিয়ে চলছে বিএনপি। দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলোর মতে, নীতিনির্ধারণী বিষয়ে বিএনপির মধ্যে যেমন এখনো অনৈক্য বিদ্যমান, তেমনি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়েও আছে দ্বিধা।
কারণ পরস্পরবিরোধী নেতারা ভিন্ন উদ্দেশ্যে খালেদা জিয়ার মুক্তি চাইছেন। আবার মুক্তির প্রক্রিয়া নিয়েও শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে আছে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। অন্যদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং ২০ দলীয় জোট রক্ষার বিষয়েও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেয়নি বিএনপি। এমন পরিস্থিতিতে অনেকটা লক্ষ্যহীনভাবে এগিয়ে চলছে দলটি।
শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, বিএনপির চেয়ারপারসন কারাগারে এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিদেশে থাকায় পলিসি নির্ধারণের ব্যাপারে সমন্বয় হচ্ছে না। তিনি গত সোমবার বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তি আইনগত প্রক্রিয়ার মধ্যেই হবে। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে অবশ্যই পর্দার আড়ালে সমঝোতা হতে হবে। কিন্তু এই সব কিছুর প্রশ্নে বিএনপিতে ঐকমত্য দরকার, যাতে কিছুটা ঘাটতি আছে বলে মনে হয়।’
এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ উপাচার্য বলেন, ‘২০ দলীয় জোট বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট অটুট রাখা হবে কি না, তা নিয়েও সঠিক রাজনৈতিক অবস্থান নেওয়াটা জরুরি।’ তাঁর মতে, এভাবে সব কিছু ঝুলিয়ে রেখে সমস্যার সমাধান হবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলো আস্তে আস্তে ঠিক করা হবে। প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘কিভাবে এত তাড়াতাড়ি ঠিক হবে? আওয়ামী লীগ তো মেরেই বিএনপিকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিচ্ছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমেই চেয়ারপারসনকে বের করতে হবে। তবে অনেকে রাজনৈতিক উদ্যোগের কথাও বলছেন। তাই আমরা এখন দুই পথেই এগোব।’
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অবশ্য মনে করেন, দেশে ‘কর্তৃত্ববাদী শাসন’ চলছে, তাতে রাজনীতি করার সুযোগই নেই। তিনি বলেন, ‘রাজনীতি থাকলেই শুধু নীতিনির্ধারণের প্রশ্ন থাকে।’ এক প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, ‘বিএনপির ঐক্যবদ্ধ পলিসি হচ্ছে ম্যাডামকে (খালেদা জিয়া) কারামুক্ত করা। তাই আইনি লড়াই চলছে। কিন্তু সরকার আইনি পথে নেই। তারা গায়ের জোরে তাঁকে আটকে রেখেছে। এর পরও আমরা সব ধরনের চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
নীতিনির্ধারণী বিষয়ে ‘অনৈক্য’ : গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী বিষয়ে গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগেও বিএনপিতে অনৈক্য ছিল, যা এখনো আছে বলে জানা যায়। দলের অনেকেই এ প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসেবে টানছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদের ভূমিকা। তাঁদের মতে, খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য ইদানীং প্রায়ই দলীয় কার্যালয়ের সামনে ঝটিকা মিছিল করছেন রিজভী।
আগে ১০ থেকে ১৫ জন নিয়ে করলেও ইদানীং ওই মিছিলে লোক কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু দলের মধ্যেই ওই মিছিল নিয়ে নানা আলোচনা ও গুঞ্জন রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, ওই মিছিল কী দলীয় নাকি রিজভী একক সিদ্ধান্তে করছেন? যদি দলীয় সিদ্ধান্তে হয়ে থাকে, তাহলে মিছিলে অন্য নেতারা যাচ্ছেন না কেন? আবার রিজভী একক সিদ্ধান্তে করে থাকলে তাঁরই বা উদ্দেশ্য কী? কারণ এ ধরনের ঝটিকা মিছিলে তো আর খালেদা জিয়ার মুক্তি মিলছে না। দলটির সর্বস্তরের নেতারা এখন এ ইস্যুতে একমত যে খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রশ্নে আইনি লড়াই যতই হোক, রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া ফল আসবে না। তাই রিজভীর ঝটিকা মিছিলের তাৎপর্য নিয়ে বিএনপিতে নানা আলোচনা আছে। অনেকেই বলছেন, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তিনি মাঝেমধ্যেই মিছিল করেন; যার সঙ্গে দলের কোনো সম্পর্ক নেই। আবার অনেকের মতে, রিজভী তবু তো কিছু করছেন, অন্যরা তাও করছেন না।
একই সঙ্গে দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকারী রিজভী দীর্ঘদিন দলীয় কার্যালয়ে থাকছেন এই অজুহাতে যে বাইরে থাকলে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারে। অথচ ঝটিকা মিছিল করলে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করছে না। অন্যদিকে সিনিয়র নেতারা আবার সব কর্মসূচি পালন করতে পারছেন না পুলিশি বাধায়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সম্প্রতি ডেঙ্গু সচেতনতার জন্য বাহাদুর শাহ পার্কে লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি পালন করতে গেলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বাধায় তা সম্ভব হয়নি।
নীতিনির্ধারণী প্রশ্নে নির্বাচনের পরও বিএনপিতে দ্বিধাদ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়েছে। কারণ নির্বাচনী ফল প্রত্যাখ্যান করার পরও বিএনপির এমপিরা শপথ নিয়েছেন, যে সিদ্ধান্তের সঙ্গে যুক্ত ছিল না বিএনপির স্থায়ী কমিটি। আবার নির্বাচনের আগে জামায়াতকে ধানের শীষ মার্কায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়ার সঙ্গেও দলের স্থায়ী কমিটি সংশ্লিষ্ট ছিল না বলে জানা যায়।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিএনপির সিনিয়র নেতারা ওই চিঠির খসড়া তৈরি করেন। কিন্তু হঠাৎ করেই কেন্দ্রীয় নেতাদের কিছু না জানিয়ে ১২ সেপ্টেম্বর এসংক্রান্ত একটি চিঠি ডাকযোগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পাঠিয়ে দেন বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নওশাদ জমির। ওই ঘটনায় দলের মধ্যে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। তখন দলের মধ্যে আলোচনা ওঠে যে নীতিনির্ধারণী প্রশ্নেই বিএনপিতে ঝামেলা আছে। কাশ্মীর ইস্যুতেও নওশাদ সম্প্রতি একই কাজ করেছেন।
এ ইস্যুতে বিএনপি এখনো স্পষ্ট অবস্থান না নিলেও সম্প্রতি তিনি নিজেই গণমাধ্যমে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের সিদ্ধান্ত জাতিসংঘের রেজল্যুশনবিরোধী। দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলোচনা না করে স্পর্শকাতর ওই ইস্যুতে ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ঘটনায় বিএনপির বেশির ভাগ নেতা ক্ষুব্ধ হন বলে জানা গেছে।
কারামুক্তি প্রশ্নে জটিলতা, সবার উদ্দেশ্যও এক নয় : আইনি লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই খালেদা জিয়ার মুক্তি মিলবে—এমন ধারণা আগে বিএনপির মধ্যে থাকলেও এখন দলের নেতাকর্মীদের বিশ্বাস, দুই পন্থায় খালেদা জিয়ার মুক্তি মিলতে পারে। প্রথমত, সরকারের অনুগ্রহে এবং দ্বিতীয়ত, সরকারকে চাপে ফেলে। অনুগ্রহ পেতে হলে রাজনৈতিক সমঝোতা লাগবে। এমন অবস্থায় খালেদা জিয়াকেই এ বিষয়ে সম্মতি দিতে হবে।
তারেক রহমানও এ ক্ষেত্রে অন্যতম ফ্যাক্টর। কিন্তু এ নিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনা কে করবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। দলীয় কোনো নেতা বা বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল কথা বললে তাঁকে তারেক রহমান বিশ্বাস না-ও করতে পারেন। আবার খালেদা জিয়া মৌখিক সম্মতি দিলেও সাধারণ নেতাকর্মীরা দলের কোনো নেতার এ ধরনের কথা সহজে বিশ্বাস করতে চাইবে না।
কারণ খালেদা জিয়া অনুগ্রহ চাওয়ার মতো নেত্রীই নন বলেই তাদের ধারণা। আবার খালেদার চাওয়াটা ‘প্রকাশ্য’ না হলে দলের মধ্যেই ফখরুল বা সংশ্লিষ্ট নেতার সমস্যায় পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিএনপি নেতাদের সাক্ষাৎ হলেও সমঝোতার বিষয়ে কেউ কথা তোলেননি। অনেকের মতে, নেতাদের বদলে পরিবারের সদস্যদের সম্পৃক্ত করতে পারলে এ ক্ষেত্রে জটিলতা অনেকখানি কমে যায়।
অথচ সে রকম উদ্যোগও দলের মধ্যে নেই। অন্যদিকে সরকারকে চাপে ফেলে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে গেলে আন্দোলনের পাশাপাশি বিদেশি শক্তিগুলোর সমর্থন লাগবে। এটি বর্তমান বাস্তবতায় সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কারণ ওই দুটি পন্থা বিবেচনায় না নিয়ে গত দেড় বছর শুধু আইনি লড়াইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে বিএনপি।
যদিও আন্দোলন বাদ দিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়েই তৎপরতা শুরু করেছে বিএনপি। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার মুক্তি চাওয়ার উদ্দেশ্য সবার এক নয়। আবেগতাড়িত হয়ে দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা যেকোনো মূল্যে খালেদা জিয়ার মুক্তি চাইছে। এ জন্য তারা দলের সিনিয়র নেতাদের দোষারোপও করছে যে তাঁরা ঠিকমতো ‘হ্যান্ডল’ করতে পারছেন না।
অন্যদিকে বিএনপির প্রবীণ নেতারা বর্তমান খারাপ পরিস্থিতির দায় এড়ানোর জন্য খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার পক্ষে। তাঁদের উদ্দেশ্য হলো, যাঁর দল তাঁকে বুঝিয়ে দিতে পারলেই দায়মুক্তি। ওই নেতাদের কারো কারো আবার তারেক রহমানের সঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে অস্বস্তি আছে।
অন্যদিকে আরেকটি অংশ রয়েছে, যারা মনে করে খালেদা জিয়া বেরোলে আগের মতো দলে তাদের প্রভাব বাড়বে। অনেক কিছু তারা নিয়ন্ত্রণে নিতে পারবে। সূত্র মতে, এই অংশের মধ্যে কেউ কেউ খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাসের দিকে আঙুল তুলছেন।
কারণ খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর দলে তাঁর কোনো অবস্থান নেই। মনোনয়ন চেয়েও শিমুল তা পাননি। ফলে অনেকের মধ্যে এমন প্রশ্ন জেগেছে যে খালেদা জিয়া মুক্তি পেলে কী করা হবে, এর সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা থাকা দরকার। আগের মতোই শুধু গুলশানে দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে রাতে অফিস করা কিংবা শুধু কিছু মানুষের দলে দাপট বাড়ানোই যেন তাঁর মুক্তির লক্ষ্য না হয়—এমন আলোচনাও উঠছে দলটির ভেতর। (কালেরকণ্ঠ)
বার্তা কক্ষ, ১৬ আগস্ট ২০১৯