৩০ ডিসেম্বরের ভোট সামনে রেখে দলীয় নেতাদের ২৪২, আর দুই জোটকে ৫৮টি আসন দিয়ে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। আজ সিলেট থেকে শুরু হচ্ছে তাদের আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচারণা। তবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয়ে এখনও ঘাটতি রয়েছে। এ নিয়ে দলটির নেতাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে দীর্ঘশ্বাস!
বিএনপির মধ্যম সারির একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, নির্বাচনের জন্য একদিকে যেমন প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা দরকার, অন্যদিকে দলের পক্ষ থেকে আসন্ন ভিত্তিক সেরা প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া দরকার। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রশাসনও নিরপেক্ষ আচরণ করছে না, আবার দলের পক্ষ থেকে বেশকিছু আসনে অখ্যাত ও অজনপ্রিয় ব্যক্তিকে প্রার্থী করা হয়েছে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য বিএনপি তাদের ২৩ দলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামকে ২২টি এবং এ জোটের অন্য শরিকগুলোকে ১৭টি আসনের পাশাপাশি ঐক্যফ্রন্ট্রের শরিকদের ১৯টি আসনে ছাড় দিয়েছে। আর ২৪২ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে বিএনপির নিজস্ব প্রার্থী।
বিএনপির এ মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় দলটির নেতাদের মধ্যে তীব্র অসোন্তষ লক্ষ্য করা গেছে। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে রাজনীতিকে বিদায় জানিয়েছেন ঝিনাইদহ-৩ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপির সহ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক কণ্ঠশিল্পী মনির খান।
চাঁদপুর-১ আসনে বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আ ন ম এহসানুল হক মিলনকে মনোনয়ন না দেয়ায় তার সমর্থকরা বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা দিয়ে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদসহ অন্যান্য নেতাদের অবরুদ্ধ করেন। একই কাজ করেন পটুয়াখলী-৩আসনের মনোনয়নবঞ্চিত হাসান মামুনের সমর্থকরা।
এদিকে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়েও মনোনয়নবঞ্চিতদের সমর্থকরা হামলা চালায়। ভাঙচুর করা হয় বিএনপি মহাসচিবের গাড়ি, রক্তাক্ত হন ফখরুলের গাড়িচালক আমিরুল ইসলাম হেলাল।
এছাড়া গুলশান কার্যালয়ের সমানে কুমিল্লা-৪ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী মঞ্জরুল আহসান মুন্সী, নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী তৈমুর আলম খন্দকার, ঢাকা-৬ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী ইশরাক হোসেন, গোপালগঞ্জ-১ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী সেলিমুজ্জামান সেলিমসহ বেশ কয়েকজন মনোনয়নপ্রত্যাশীর সমর্থরা বিক্ষোভ করেন।
পরিস্থিতি সামাল দিতে বেশ কয়েকটা আসনে ঘোষিত প্রার্থী পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় বিএনপি।
নড়াইল-১ আসনে সাজ্জাদ হোসেনের মনোনয়ন বাতিল করে জাহাঙ্গীর বিশ্বাসকে দেয়া হয়। ময়মনসিংহ-৩ আসনে আগে দেয়া হয়েছিল আহাম্মদ তায়েবুর রহমান হিরণকে। পরে তার জায়গায় এস এম ইকবাল হোসেনকে মনোনয়ন দেয়া হয়। মানিকগঞ্জ-১ আসনে এস এম জিন্নাহ কবীরের পরিবর্তে দেয়া বিএনপির দুঃসময়ের কাণ্ডারীখ্যাত প্রয়াত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের ছেলে খোন্দকার আখতার হামিদ ডাবলুকে। পরবর্তীতে ডাবলুকে বাদ দিয়ে সেখানে জিন্নাহকে মনোনয়ন দেয়া হয়।
যশোর-৫ আসনে শহীদ ইকবালকে মনোনয়ন না দেয়ায় সেখানকার অন্তত ২০হাজার নেতাকর্মী বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেছেন। মনোনয়ন নিয়ে অনেকেই প্রকাশ্যে ক্ষোভ দেখালেও চাপা অভিমান নিয়ে আছেন অনেকে।
প্রার্থিতার প্রক্রিয়া থেকে আগেভাগেই দূরে রয়েছেন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ। কয়েক ধাপ এগিয়েও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। এছাড়া এবার আলোচিতদের মধ্যে মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোর্শেদ খান, বিএনপির কূটনৈতিক উইংয়ে নেতা ইনাম আহমেদ চৌধুরী, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি শামসুজ্জামান দুদু, আসাদুজ্জামান রিপন, আব্দুল কাদির ভূইয়া জুয়েল, মহিলা দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা, সাবেক এমপি আশরাফ উদ্দিন নিজাম, শাম্মী আক্তার, নিলোফার চৌধুরী মনি, সৈয়দা আশরাফি আসিফা পাপিয়া প্রমুখ।
এ বিষয়ে সঙ্গে কথা হয় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা তৈমুর আলম খন্দকারের। তিনি বলেন, ‘মনোনয়ন নিয়ে ভোটের পর মুখ খুলবো।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মনোনয়নবঞ্চিত ছাত্রদলের সাবেক এক সভাপতি বলেন, ‘নিয়ম হলো স্ব স্ব আসন থেকে তৃণমূল নেতারা তিন বা পাঁচজনের নাম হাইকমান্ডের কাছে প্রস্তাব করবেন, সেখান থেকে হাইকমান্ড প্রার্থী চূড়ান্ত করবেন। কিন্তু মনোনয়নের ক্ষেত্রে তা হয়নি। এবারের মনোনয়নে বিভিন্ন কানেকশন প্রাধান্য পেয়েছে। এ কারণে সংস্কারপন্থী, অচেনা অখ্যাত নেতা, দুর্নীতির দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত এবং নির্বাচনে অযোগ্য নেতার স্ত্রী-সন্তান, বা কেউ কেউ একাধিক আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন। গত ১০ বছরে যারা রাষ্ট্রীয় জুলুম ও নির্যাতনে শিকার হয়েছেন তাদের মূল্যায়ন হয়নি। এ কারণে মনোনয়ন বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠছে। ’
বিএনপির নির্বাহী কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘বিশ্ব রাজনীতিতে নেতৃত্বের বয়স ৪০ থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকলেও এবার বিএনপির মনোনয়নে তরুণদের উৎসাহ দেয়া হয়নি। নির্বাচনের আগেই ১০০টি আসনে বিএনপিকে ছাড় দিতে হয়েছে। এর মধ্যে দুই জোটকে দেয়া হয়েছে ৫৮টি আসন। জামায়াতকে ২২টি আসন দেয়া হয়েছে অথচ এককভাবে নির্বাচন করলে জামায়াত ৪/৫টি আসনের বেশি পাবে না। এছাড়া ৩৫ থেকে ৪০ আসনে নিম্নমানের প্রার্থী দেয়া হয়েছে। তবে কিছু আসন রয়েছে সেখানে সংস্কারপন্থী হলেও তাদের কোনো বিকল্প নেই; যেমন নোয়াখালী-৬, বরিশাল-১ আসন। সব মিলিয়ে বিএনপি এবার ২০০ আসনে লড়ছে।’
মনোনয়নবঞ্চিত সেলিমুজ্জামান সেলিম তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘প্রিয় গোপালগঞ্জ-০১ (মুকসুদপুর-কাশিয়ানী) আসনের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদল, মহিলাদ সহ সকল অঙ্গ-সংগঠনের সম্মানিত নেতৃবৃন্দ, কর্মীবৃন্দ, আমার সহকর্মীবৃন্দ, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ী বন্ধুবান্ধব,আত্বীয়-স্বজন, এলাকবাসী, প্রবাসী সবাইকে আমার সালাম,আদাব ও শুভেচ্ছা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির পক্ষে আমার প্রার্থিতা পাওয়ার জন্য আপনারা অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টা করেছেন, আমি আপনাদের সবাইকে আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই। আমাদের কারও মনক্ষুণ্ন হওয়ার কোনো কারণ নাই। নির্বাচন একবারের জন্য নয়, দল যাকে মনোনয়ন দেবে তাকেই আমাদের স্বাগত জানাতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন, এটাকে শুধু নির্বাচন না ধরে মূলত আন্দোলন হিসাবে গণ্য করতে হবে।’
তবে দলের মনোনয়ন নিয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘মনোনয়ন নিয়ে ছোটখাটো দু-একটি প্রতিক্রিয়া থাকবেই। এটা নতুন কিছু নয়। বরং যাদের দেয়া হয়েছে, তারা অত্যন্ত জনপ্রিয়। আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে শুরু করে এলাকায় তাদের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত নিবিড়।’
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত নিয়েই দলের মনোনয়ন চূড়ান্ত হয়েছে।’ (জাগো নিউজ)
বার্তা কক্ষ
১২ ডিসেম্বর,২০১৮