সারাদেশ

স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি’তে বড় পরিবর্তন আসছে

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গুণগত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে ‘স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি’তে বড় পরিবর্তন এনেছে সরকার। বিদ্যালয় পরিচালনায় একজন সভাপতিসহ ১১ সদস্যবিশিষ্ট এসএমসি’র দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণ করে‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি’গঠন সংক্রান্ত নতুন নীতিমালা জারি করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

নীতিমালাটি চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়ে সোমাবার ১১ নভেম্বর বিকেলে মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করা হয়। ইতিপূর্বে এসএমসি নিয়ে জারিকৃত সকল প্রজ্ঞাপন ও আদেশ বাতিল বলে গণ্য হবে বলে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে।

নতুন নীতিমালায় সভাপতির শিক্ষাগত যোগ্যতা সর্বনিম্ন স্নাতক পাস নির্ধারণ করা হয়েছে। আর রাজনৈতিক বিবেচনায় মনোনিত বিদ্যোৎসাহী সদস্যদেরও এসএসসি পাস হতে হবে। তবে অভিভাবক প্রতিনিধিসহ অন্য ক্যাটাগরির সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়নি।

জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ১১ সদস্য বিশিষ্ট এসএমসি গঠিত হবে। তাতে স্কুলের প্রধান শিক্ষক বা ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন। সংশ্লিষ্ট এলাকার এমপির সুপারিশে স্কুলে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের মধ্য হতে একজন বিদ্যোৎসাহী মহিলা ও একজন পুরুষ সদস্য মনোনয়ন দিবেন প্রধানশিক্ষক। তাদের অবশ্যই এসএসসি পাস হতে হবে।

বিদ্যালয়ের জমিদাতা বা তাদের উত্তরাধিকারীদের মধ্য থেকে একজন সদস্য মনোনিত হবেন। জমিদাতারা নিজেরা প্রতিনিধি মনোনিত করতে না পারলে উপজেলা শিক্ষা কমিটি নির্ধারণ করে দিবেন। এসএমসি’র সভাপতি হতে শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক পাস পাওয়া নিয়ে আশঙ্কা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। সারা দেশে এমন অনেক এলাকা রয়েছে যেখানে স্নাতক পাস পাওয়া দুরুহ হবে। পক্ষান্তরে স্কুলে সভাপতি নির্বাচন করা কঠিন হবে।

নীতিমালায় বলা হয়, সংশ্লিষ্ট স্কুলের নিকটবর্তী সরকারি-বেসরকারি হাই স্কুলের একজন শিক্ষক কমিটির সদস্য মনোনিত হবেন। ওই হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষক তা নির্ধারণ করে দিবেন। স্কুলের শিক্ষকদের মধ্য হতে একজন শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের ভোটে দু’জন মহিলা ও দু’জন পুরুষ সদস্য নির্বাচিত হবেন। স্কুলটি ইউনিয়ন বা পৌরসভার যে ওয়ার্ডে অবস্থিত সেখানকার ইউপি সদস্য বা কাউন্সিলর পদাধিকার বলে সদস্য মনোনিত হবেন। এ ১১ জনের ভোটে সভাপতি ও সহসভাপতি নির্বাচিত হবেন। সভাপতিকে অবশ্যই স্নাতক পাস হতে হবে।

নীতিমালা অনুযায়ী,একই স্কুলে টানা দুই বারের বেশি কোন ব্যাক্তি সভাপতি হতে পারবেন না। কমিটির সদস্যরা সভাপতিকে লিখিতভাবে না জানিয়ে টানা তিনটি সভায় অনুপস্থিত থাকলে সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে। কমিটির মেয়াদ হবে তিন বছর। কোন কারণে নির্ধারিত সময়ে কমিটি গঠনে ব্যর্থ হলে ছয় মাসের জন্য এডহক কমিটি গঠন করতে হবে। এডহক কমিটির সভাপতি হবেন সংশ্লিষ্ট ক্লাস্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা। এডহক কমিটির সভাপতির অনুপস্থিতিতে সহসভাপতি সভায় সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন।

কমিটির দায়িত্ব ও কর্তব্য বিষয়ে জারিকৃত নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রতিবছর মে,আগস্ট ও ডিসেম্বর মাসের ৩০ তারিখের মধ্যে স্কুল ব্যবস্থাপনা,শিক্ষার্থী উপস্থিতি ও শিক্ষকদের দায়িত্ব পালনের ওপর প্রতিবেদন উপজেলা বা থানা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে দিতে হবে এসএমসিকে।

শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি বন্ধ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের সততা, নৈতিক শিক্ষা প্রদানে ভূমিকা রাখতে হবে। কমিটির সকল সদস্যদের প্রতি মাসের শেষ কর্ম দিবসে ক্লাস শেষে অন্তত এক ঘন্টা শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ও সুপারিশ শুনতে হবে।

এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে উপজেলা শিক্ষা কমিটির কাছে প্রতিবেদন দিতে হবে। কমিটি স্কুলের সার্বিক উন্নয়নে জনগণের কাছ থেকে জমি,ভবন আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, শিখন ও শেখানো সামগ্রী, শিক্ষা উপকরণ, নগদ অর্থ নিতে পারবে। দানকারীদের নাম প্রধান শিক্ষকের রুমে বোর্ডে প্রদর্শন করতে হবে। ভবন নির্মাণে স্কুলের খেলার মাঠ ও অন্যান্য স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে বিষয়ে উপজেলা বা থানা প্রকৌশলীর প্রত্যায়ন নিতে হবে।

বিদ্যালয়ভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বিষয়ে নীতিমালায় বলা হয়,কমিটির সদস্যদের স্কুলের শিখন-শেখানো পরিবেশ সম্পর্কিত অবস্থা বিশ্লেষণ এবং সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে। স্থানীয় জনগনের কাছ থেকে স্কুলের উন্নয়নে তহবিল সংগ্রহ করতে হবে। স্কুলের ক্যাচমেন্ট এলাকার সকল শিশুকে স্কুলে ভর্তি ও গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে এসএমসিকে শিশু জরিপে সহায়তা করতে হবে।

বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু চিহ্নিতকরণ ও ভর্তিসহ তাদের সহযোগিতা করতে হবে। তাদের চাহিদা কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। একিভূত শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নে প্রাপ্ত অর্থ সঠিকভাবে খরচ নিশ্চিত করতে হবে।

এসএমসি সদস্যদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা সামগ্রী ক্রয়সহ সার্বিক তদারকি করতে হবে। স্কুলের অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কারে এসএমসি ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে পারবেন। উপজেলা শিক্ষা কমিটির অনুমোদন নিতে হবে। স্থানীয়দের অনুদানের মাধ্যমে নির্মাণ কাজে এ শর্ত কার্যকর হবে না। স্কুলের ক্যাচমেন্ট এলাকার প্রাথমিক স্তরে ঝরে পড়া শিশুদের সনাক্ত করতে হবে।

তাদের দ্বিতীয় দফায় শিক্ষাকার্যক্রমে সুযোগ দিতে হবে। ঝরে পড়া শিশুর অভিভাবকদের দ্বিতীয়বার শিক্ষা চালিয়ে নিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এ সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনায় শিক্ষক নির্বাচনে সহায়তা দিতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে শিক্ষক যাচাই করবে এসএসসি। এ ছাড়া স্কুলে সকল প্রশিক্ষণ ও সাব ক্লাস্টারের কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা করতে হবে। দুর্যোগকালীন সময়ে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা, শিক্ষার্থী,অভিভাবক,শিক্ষকদের সতর্ক। দুর্যোগকালীন প্রস্তুতি ও পরবর্তিতে করণীয় নির্ধারণ করবে এসএমসি।

এসএমসির ১১ সদস্যের মধ্যে সদস্য সচিব ও শিক্ষক প্রতিনিধি ছাড়া অন্যদের পর্যায়ক্রমে ৪ জনকে প্রতিমাসে অন্তত ৬ দিন স্কুলের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন এসএমসির মাসিক সভায় উপস্থাপন করতে হবে।

নীতিমালায় আরও বলা হয়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির শিশুদের স্কুলে ভর্তি ও নিয়মিত উপস্থিত নিশ্চিত করতে ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করে তদারকি করতে হবে। এসএমসি অনুমোদনের পরবর্তী তিন বছর দায়িত্ব পালন করবে। মেয়াদ শেষ হওয়ার ছয় মাস আগে প্রধান শিক্ষক পরবর্তী কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিবেন।

এতে বলা হয়, সরকারি আদেশ অমান্য,দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ,আর্থিক অনিয়ম এবং যেকোন শৃঙ্খলাপরিপন্থি কারণে এসএমসি বাতিল করে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবে সংশ্লিষ্ট এলাকার শিক্ষা কর্মকর্তা।

এ প্রজ্ঞাপন জারির আগে গঠিত এসএমসি পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারবে। প্রজ্ঞাপনটি পার্বত্য তিন জেলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। তবে পার্বত্য জেলা পরিষদ এ নীতিমালার আলোকে সংশ্লিষ্ট জেলার জন্য নিজস্ব নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারবে এবং প্রণীত নীতিমালা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করতে হবে।

সার্বিক বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো.জাকির হোসেন বলেন,‘ গুণগত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে এটি একটি যুগান্তকারী সিন্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কারণ টেকসই উন্নয়নের শর্তগুলো পূরণ করতে হলে আমাদের শিক্ষিত ও যোগ্য লোকের প্রয়োজন। এজন্য নতুন নীতিমালায় সভাপতির শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক নির্ধারণ করা হয়েছে। ’

বিদ্যোৎসাহী সদস্য হতে হলেও এসএসসি পাস হতে হবে। অবশ্যই তাদের সন্তানকে স্কুলে পড়তে হবে। কারণ নিজের সন্তান স্কুলে না পড়লে প্রতিষ্ঠানের প্রতি তার দরদ থাকে না। স্কুলের প্রতি যাতে তার দরদ থাকে,স্কুলের উন্নয়নের কথা ভাবে,কেউ যেন স্কুল নিয়ে বাণিজ্য করতে না পারে সেজন্য এ নীতি করা হয়েছে।

বার্তা কক্ষ , ১২ নভেম্বর ২০১৯

Share