চাঁদপুর

চাঁদপুরের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নারীর অর্ধকোটি টাকা লোপাটের অনুসন্ধান -ভিডিওসহ

অভাবনীয় সঙ্গবদ্ধ অপরাধের শিকার বেশ কয়েকজন ব্যাংক হিসেবধারী ও ব্যাংকার, যাদের কেউই জানতো না এ ঘটনার বিন্দুবিসর্গ। প্রতারণার জাল বিছিয়ে নারী চরিত্রে চক্রটি চাঁদপুরের একাধিক ব্যাংকের শাখা থেকে ৫৭ লাখ টাকা তুলে নেয়। এ নিয়ে বেশ কয়েকজন ব্যাংকারের চাকরিও তখন কচু পাতার পানির টালমাটাল হয়ে পড়ছিলো।

জেলা পুলিশের বিচক্ষণ তদন্তে ও রূদ্ধশ্বাস অভিযানে আইনের কাছে সোপর্দ হন অপরাধীরা আর বেঁচে যান ব্যাংক কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার (২৪ জানুয়ারি) জেলা পুলিশের ফেসবুক ওয়ালে বিস্তারিত তুলে ধরেন সহকারী পুলিশ সুপার শাকিলা ইয়াসমিন সূচনা।

তাঁর লেখা সূত্রে জানা যায়, ফলিক মিয়া চৌধুরী নামের এক ব্যাক্তি এবি ব্যাংকের সিলেটে দরগাঘাট শাখায় ২৫ লাখ টাকার গড়মিল দেখতে পান। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন তাঁর স্বাক্ষরিত কথিত চেকেই ২৪ মে, ২০১৮ তারিখে ২৫ লাখ টাকা ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চাঁদপুর শাখা রুমানা আক্তার নামের এক নারীর একাউন্টে ট্রান্সফার হয়।

রুমানা এ শাখায় মাত্র মাসখানেক আগেই একাউন্টটি খুলেছিলেন। ট্রান্সফারের কয়েকদিন পর ২৮ এবং ২৯ মে দুইদিনে রুমানা চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরের চারটি শাখা থেকে পুরো টাকাটিই তুলে নেন। কিন্তু তার একাউন্ট ফরমে দেয়া মোবাইল নাম্বার এবং জন্মনিবন্ধন সনদে উল্লেখিত ঠিকানা ছিলো ভুয়া যার বাস্তব অস্তিত্ব অনুসন্ধানে পাওয়া যায়নি।

এরইমধ্যে ফলিক মিয়া বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করেন আর ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক চাঁদপুর শাখার ম্যানেজার নিতান্ত বাধ্য হয়েই চাঁদপুর সদর থানায় মামলা করেন।

এ নিয়ে চাঁদপুর পুলিশ বিভাগের শুরু হয় ধৈর্যের পরীক্ষার প্রযুক্তির অসাধারণ ব্যাবহার। চাঁদপুর জেলা গোয়েন্দা শাখার পুলিশ পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) মোঃ মহিউদ্দিনকে তদন্তের ভার দেন চাঁদপুর পুলিশ সুপার জিহাদুল কবির পিপিএম।

তদন্তের স্বার্থে যুক্ত হন জেলা গোয়েন্দা শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নূর হোসেন মামুন। শুরুতে নথি হিসেবে একটি ভূয়া চেক, ভূয়া নাম-ঠিকানায় করা জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়ে খোলা ভূয়া একাউন্ট এবং সম্ভবত ছদ্মনামের এক নারী-এর বাইরে কিছুই ছিল না যা থেকে তদন্ত শুরু করা যায়।

একাউন্ট ফর্মটিই প্রথম পথের দিশা দেয়, সাথে পাওয়া যায় ব্যাংকের সিসিটিভি ফুটেজে শিশু কোলে বোরকা পরা নারীর ছবি। প্রযুক্তির ব্যাবহারে, সতর্ক পদক্ষেপে ছোট্ট একটা তথ্যের সূত্র ধরে পাওয়া যায় আরেকজন নারী প্রতারকের সন্ধান। পাশের জেলা কুমিল্লা চৌদ্দগ্রামের এক ব্যাংকে ভুয়া চেক দিয়ে টাকা তুলতে গিয়ে গ্রেফতার হন ওই নারী।

এই সাকিমা বেগমের খোঁজ আলোর দিশা পায় তদন্ত দল। সাকিমাকে গ্রেফতার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয় চাঁদপুরে। তার দেয়া তথ্যে তার দুই সহযোগীর মধ্যে একজন রাসেল মিজি ওরফে সুমনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। তার দেয়া তথ্যে উঠে এই চক্রের চাঁদপুরের মূলহোতা রাশেদের নাম। আটককৃতদের সবাইকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের তথ্যসূত্রে বেরিয়ে আসে এ গল্পের মূল নায়িকা সেই ছদ্মনামধারী রুমানা আক্তার ওরফে হালিমা খাতুন (রূপা)।

এ নিয়ে মঙ্গলববার (২২ জানুয়ারি) আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবনন্দী দেয় রুমানা ওরফে হালিমা এবং রাসেল ওরফে সুমন। এদের বক্তব্যে ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টতা পেয়ে গ্রেফতার হন রুমানার মা পারুল এবং রাশেদের ভাই সাদিওর রহমান।

এই চক্রটি শুধু চাঁদপুর এর কয়েকটি ব্যাংক থেকেই সর্বমোট ৫৭ লাখ টাকা তুলেছে প্রতারণার জাল বিছিয়ে। রুমানা আক্তার নামে কয়েকটি ভুয়া একাউন্ট রয়েছে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতারণা চক্রটি প্রবাসী বাঙ্গালীদের পাঠানো চেকের ছবি বিভিন্ন উপায়ে সংগ্রহ করে ঠিক তার পরবর্তি নাম্বারের জাল চেক তৈরি করে। এরপরে স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া তথ্য দিয়ে খোলা ভুয়া একাউন্টে টাকা জমা দেয় সেই চেকের মাধ্যমে।

টাকা জমা হবার পরেই দ্রুততার সাথে ব্যাংক থেকে সেই টাকা তুলে নেয় চক্রের অন্য কোন সদস্য। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় অভিনব এক সঙ্গবদ্ধ উপায়ে

চাঁদপুর পুলিশ সুপারের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধায়নে এবং পরামর্শে এই সঙ্গবদ্ধ অপরাধ চক্রকে সনাক্ত করতে পারায় পুলিশ পরিদর্শক মহিউদ্দিনকে তাৎক্ষনিকভাবে দশ হাজার টাকা পুরষ্কার প্রদান করেন এসপি নিজেই।

আর ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, চাঁদপুর শাখার ম্যানেজার ও তার সহকর্মীদের চাকরি এবং সম্মান দুটোই বেঁচে যায় পুলিশের কর্মতৎপরতায়। আর ব্যাংকাররাও পুলিশ বাহিনীর কাছে সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন ফুলেল শুভেচ্ছায়।

‘প্রতারকের জাল যতই কঠিন হোক, অপরাধী কোন না কোন সূত্র রেখেই যায়। আর মহিউদ্দিনের মত কর্মকর্তারা বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তির ব্যাবহারে খুঁজে নিয়ে আসে সেইসব অপরাধীদের৷ অসংখ্য ফলিক মিয়াদের বাঁচিয়ে দেয় রুমানাদের প্রতারণার শিকার হওয়া থেকে।’ লেখায় বাক্যগুলো যোগ করেন সহকারী পুলিশ সুপার শাকিলা ইয়াসমিন সূচনা।

সম্পাদনা : দেলোয়ার হোসাইন
২৪ জানুয়ারি, ২০১৯

Share