কর্নেল (অব:) মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি ১৫ জুলাই ২০১৯, ১৭:৪৯
১. সামরিক বাহিনীতে যখন যোগদান করি, অর্থ উপার্জন করে ধনী হওয়ার কোনো চিন্তাই মাথায় ছিল না। শুধু দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সম্মান ও মর্যাদার কথা মাথায় রেখেই এ পেশায় নিয়োজিত হয়েছিলাম। আমাদের সময় মিলিটারি একাডেমিতে জেন্টলম্যান ক্যাডেটের ভাতা দেয়া হতো ১৫০ টাকা। সেনাবাহিনীতে কমিশন পাওয়ার পর ১৯৮৩-৮৪ সালে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে বেতন ছিল ৭৫০ টাকা মাত্র।
বিভিন্ন ভাতাসহ হাজারখানেক টাকা পেতাম মাসের শেষে। মেস বিল হতো ১২ থেকে ১৫ শ’ টাকা, যা পরিশোধের জন্য ব্যাংক থেকে ‘ওভার ড্র’(ওডি) অথবা বাড়ি হতে মনিঅর্ডার, আর তা না হলে বকেয়া রাখা ছাড়া উপায় ছিল না। তিন মাস অন্তর মেস মিটিংয়ে মেস বিলের বকেয়া তালিকায় প্রায়ই অর্ধেক অফিসারের নাম নথিভুক্ত হয়ে যেত, যা ঊর্ধ্বতন অফিসে প্রেরণ করার বিধান ছিল। আর ধূমপায়ী অফিসারদের তো ছিল নিতান্তই করুণ অবস্থা।
শুধু মেস বিলই নয়, পায়ের বুট থেকে শুরু করে মাথার ক্যাপ পর্যন্ত প্রতিটি সামরিক গ্যাজেটস অফিসারদের কিনে পরিধান করতে হতো। অধিনায়ক থেকে শুরু করে সবার যাতায়াতের জন্য পদযুগল ও বাইসাইকেলই ছিল ভরসা। তবে ওডির জন্য ব্যাংক ম্যানেজারদের সহৃদয় সহযোগিতার কারণেই আমরা সে যাত্রায় পার পেয়ে যাই। আর্থিক কষ্ট কিছুটা লাঘব হয় ১৯৮৬ সালে জেনারেল এরশাদ কর্তৃক নতুন পে স্কেলে বেতন বাড়ানোর মধ্য দিয়ে। এ স্কেলে সামরিক-বেসামরিক সবাই লাভবান হয়েছিলেন।
২. রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ২৪ মার্চ ১৯৮২ সালে সেনাপ্রধান লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। আমরা তখন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে জেন্টলম্যান ক্যাডেট। ১৯৮৩ সালের ২২ ডিসেম্বর আমাদের নবম বিএমএ লং কোর্সের পাসিং আউট প্যারেডের প্রধান অতিথি হিসেবে আগমন করেন এরশাদ। আমরা তাকে কাছে থেকে দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়ি। আমাদের সেনাপ্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক কত সুন্দর দীর্ঘদেহী, ফর্সা, স্মার্ট, হ্যান্ডসাম জেনারেল। আমরা অতশত রাজনীতি বুঝি না। কমিশন্ড অফিসার হয়েই মার্শাল ল ডিউটি করতে যাবো। তাই টানটান উত্তেজনা ও আনন্দবিগলিত শিহরণ সবার মধ্যে।
৩. কমিশন পাওয়ার পর মোমেনশাহী সেনানিবাসে আমাকে পোস্টিং দেয়া হয়। ইউনিট ছিল ৪২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং আমাদের অধিনায়ক লে. কর্নেল খালেকুজ্জামান (মরহুম) ছিলেন নেত্রকোনা জেলার সামরিক আইন প্রশাসক। ১৯৮৪ সালের শেষ দিকে তার স্টাফ অফিসার হিসেবে নেত্রকোনা সার্কিট হাউজে অবস্থান করি। একদিন আমাকে অধিনায়ক নির্দেশ দিলেন, পরের দিন ভোরে দুর্গাপুর উপজেলার বিরিশিরিতে নবনির্মিত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র উদ্বোধন করার জন্য জেনারেল এরশাদ আগমন করবেন। আমি যেন ভোরে সেখানে হাজির হই। জেলা প্রশাসনই সব কিছু আয়োজন করবে। আমি সকাল সকাল সেখানে হাজির হলাম। হেলিকপ্টারে করে প্রেসিডেন্ট এরশাদ আগমন করলেন। ডিসি সাহেবের পাশে আমিও দাঁড়িয়েছিলাম। তিনি যখন কাছে এলেন অবাক হয়ে, তার দিকে তাকিয়ে বিগলিত হয়ে স্যালুট দিয়ে নিজের পরিচয় দিলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন- How are you? আমি উত্তর দিলাম- Fine, thank you Sir. একজন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে দেশের প্রেসিডেন্টকে এত কাছে পেয়ে যে আনন্দ পেয়েছিলাম, তা কখনো ভুলে যাওয়ার নয়।
৪. একটি মাত্র সিদ্ধান্ত, বদলে যায় দেশ ও মানুষের ভাগ্য : ১৯৮৮ সালের আগে স্বপ্নেও ভাবিনি যে, সেনাবাহিনী থেকে বিদেশ-বিভুঁইয়ে কখনো যাওয়া যাবে এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা ডলারের মাধ্যমে সৈনিকদেরও বেতন দেয়া হবে। সে অদেখা ও অভাবনীয় স্বপ্নেরই বীজ বপন করা হয় ১৯৮৮ সালে তৎকালীন মহামান্য রাষ্ট্রপতি জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। অনেকের নেতিবাচক মতামতকে অগ্রাহ্য করে তিনি প্রথম উপসাগরীয় (ইরাক-ইরান) যুদ্ধের ক্রান্তিকালে জাতিসঙ্ঘের সামরিক পর্যবেক্ষক গ্রুপে (United Nations Iran-Iraq Military Observer Group (UNIIMOG) বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণের জন্য অনুমতি দেন, যা তার গভীর দেশপ্রেম ও দূরদর্শিতারই পরিচয় বহন করে। ফলে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লেফটেন্যান্ট কর্নেল (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল) ফজলে এলাহি আকবরের নেতৃত্বে ১৫ জন চৌকস অফিসারকে UNIIMOG-এ প্রেরণ করার মাধ্যমে জাতিসঙ্ঘ শান্তি মিশনে সামরিক বাহিনী প্রেরণের শুভ সূচনা হয়েছিল। এর পরের ইতিহাস সবার জানা।
৫. এ ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেয়া খুব সহজ কাজ ছিল না। আমরা তখন জুনিয়র অফিসার।
শুনেছি স্বয়ং তদানীন্তন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এম আতিকুর রহমান থেকে শুরু করে অনেক নীতিনির্ধারকই জাতিসঙ্ঘ বাহিনীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণের বিরোধিতা করেছিলেন। তবে তখনকার প্রেক্ষাপটে তাদের বিরোধিতারও যৌক্তিক কারণ ছিল। যেমন- স্বল্পসংখ্যক অফিসার ধনিক শ্রেণীতে পরিণত হবে, বৈষম্য বাড়বে, পেশাগত দক্ষতার ব্যাপারে কম্প্রমাইজ করা হবে, বেশি অর্থ হলে অফিসারদের সেনাবাহিনী ছাড়ার প্রবণতা দেখা দেবে, ইত্যাদি।
সময়ের ব্যবধানে নেতিবাচক চিন্তাগুলো ইতিবাচক প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৮৮ সালে জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, আজ তা সশস্ত্রবাহিনী ও পুলিশের জন্য মহীরুহে পরিণত হয়েছে। অফিসার ও সব পদবির সামরিক বাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের জাতিসঙ্ঘ মিশনে অংশগ্রহণের দ্বারা বিশ্বদরবারে দেশের সুনাম-সুখ্যাতি বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি সবার আর্থিক সচ্ছলতাও অনেক গুণে বেড়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে বিশাল অঙ্কের রেমিট্যান্স। তা ছাড়া, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বহু দেশের সামরিক বাহিনীর সাথে কাজ করে সামরিক বাহিনীর দক্ষতা ও পেশাগত মানও অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং কালজয়ী সে সিদ্ধান্তের জন্য সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে দেশের সশস্ত্রবাহিনী ও বাংলাদেশ পুলিশ চিরদিন কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।
৬. সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়ে সশস্ত্রবাহিনীকে আধুনিকায়ন ও শক্তিশালী করার সাথে সাথে এর শৃঙ্খলাকে অটুট রাখার প্রতি মনোযোগী হন। তার সময় অফিসারদের বৈদেশিক প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি পায়। তিনি সশস্ত্রবাহিনীর সুযোগ সুবিধাও বৃদ্ধি এবং বাস্তব সমস্যাগুলো দূরীভূত করার চেষ্টা করেন। একই সাথে বহুবিধ সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করে বেসামরিক প্রশাসনকেও তিনি ঢেলে সাজানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। তার সময়ে মেধা ও যোগ্যতার মাপকাঠিতেই পদোন্নতি ও পদায়ন করা হতো। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ‘উৎসব ভাতা’ ও ‘টাইম স্কেল’ চালুকরণ ছিল তার আরেকটি যুগান্তকারী ও সাহসী পদক্ষেপ।
৭. এ দেশে অসংখ্য ভালো কাজের সাথে জেনারেল এরশাদের নাম জড়িত। যেমন- উপজেলা প্রথা, বিচারকে জনসাধারণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া, শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো, সেতু, কালভার্ট ও সড়ক নির্মাণ, রেল ও আকাশ পথে যোগাযোগব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ইত্যাদি যুগোপযোগী পদক্ষেপ তিনি নিয়েছিলেন। তার সময়ে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বজায় ছিল। দেশের জনগণের মধ্যে কোনো বিভক্তি ছিল না। ছিল না তেমন হিংসাবিদ্বেষ, গুম-খুন, হানাহানি, চাঁদাবাজি। প্রশাসন ছিল রাজনীতির ঊর্ধ্বে। সরকারি চাকরিতে নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনা ছিল না।
৮. পররাষ্ট্র নীতি ও বহির্বিশ্বের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে এরশাদ ছিলেন অত্যন্ত সফল। মুসলিম বিশ্বের সাথে তো বটেই, প্রাচ্য, পশ্চিমা বিশ্ব, পাকিস্তান ও ভারতের সাথেও যুগপৎ অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ সুসম্পর্ক বজায় রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের যেকোনো বিপদ-আপদে সবাই পাশে এসে দাঁড়াত। ১৯৮৮ সালের শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যার সময় ব্যাপক বৈদেশিক সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে দেশের অগণিত দুর্যোগকবলিত মানুষ প্রাণে রক্ষা পায়। ১৯৮৮ সালের সেই মহাপ্লাবনের সময় ‘তোমাদের কাছে এসে বিপদের সাথী হতে আজকের চেষ্টা আমার’ প্রেসিডেন্ট এরশাদের লেখা এই গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তিনি কোমরপানিতে নেমে দুর্দশাকবলিত জনগণের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করতেন। তার আরেকটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল, দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর প্রাণের আকুতি অনুযায়ী, পবিত্র ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া।
৯. এরশাদের সময়ে দেশের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম ব্যাপক পরিসর লাভ করে। এখনকার মতো সে সময়ে বাজেট প্রণয়ন এত সহজ ছিল না। এখন তো শুধু মোবাইল কোম্পানি এবং এর ১৩ কোটি গ্রাহকের মাধ্যমেই সরকারের দৈনিক আয় হয় শত কোটি টাকা। তা ছাড়া হাজার হাজার কোটি টাকার ভ্যাট, ট্যাক্সের পাশাপাশি সরকারি আয়ে আরো লক্ষ কোটি টাকার ছড়াছড়ি। অথচ সে আর্থিক দৈন্যের মধ্যেও বিশাল যমুনা নদীর ওপর সর্ববৃহৎ সেতু নির্মাণের মাধ্যমে তিনি নদী বিভক্ত বাংলাদেশকে সংযুক্ত করে জাতীয় অর্থনীতির চাকা সচল করেছেন। দেশের উন্নয়নে তার আরেকটি যুগান্তকারী কাজ ছিল উত্তরবঙ্গের সব জীর্ণ-শীর্ণ সরু রাস্তাকে সংস্কারপূর্বক উন্নত সড়ক ও জনপথে পরিণত করে রাজধানীর সাথে সহজ যোগাযোগ স্থাপন করা
। রাজধানী ঢাকা শহরকে তিনি নতুন রূপে সজ্জিত করেন। জরাজীর্ণ ঐতিহাসিক আহসান মঞ্জিলকে সংস্কার করে এটাকে অত্যন্ত শৈল্পিক ও আকর্ষণীয় করে তোলেন। তার সবচেয়ে সাহসী উদ্যোগ ছিল অসংখ্য বাড়িঘর ও স্থাপনা ভেঙে গুলিস্তান থেকে নয়াবাজার ‘নর্থ-সাউথ রোড’, বিশাল পান্থপথ, বিজয় সরণি, প্রগতি সরণি ইত্যাদি সড়ক তৈরি করা। বর্তমান ‘বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র’, যার আগের নাম ছিল ‘বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র’ নির্মাণও জেনারেল এরশাদের অবদান। তিনি বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর ‘চীন-মৈত্রী সেতু’ এবং ঢাকার চার পাশে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেন। এসব সাহসী পদক্ষেপ না নিলে ঢাকা শহরে বসবাস ও চলাচল করা সম্ভব হতো না।
১০. পৃথিবীর কোনো মানুষই দোষত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। ভালো-মন্দ নিয়েই মানুষ। সাবেক সেনাপ্রধান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদেরও অসংখ্য ভালো গুণের পাশাপাশি অনেক দোষত্রুটি ছিল। কিন্তু তিনি বাংলাদেশ ও দেশের মানুষকে যে খুব ভালোবাসতেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। তার ৯ বছরের শাসনামলে তিনি দেশের মানুষকে বিভক্ত করে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেননি। রাজনৈতিক বিবেচনায় কারো চাকরি বা পদোন্নতিও হয়নি। দেশের আনাচে-কানাচে তিনি ঘুরে বেড়াতেন, দুঃখ-দুর্দশায় দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। তিনি ছিলেন মানবদরদী রাষ্ট্রনায়ক। তার ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসেবেই বৃহত্তর রংপুরের জনসাধারণ বারবার বিপুল ভোটে তাকে ও তার দলকে বিজয়ী করেছেন। ছলচাতুরী করে অনেকেই ক্ষমতা হরণ করেছেন। অনেকের মতে, তুলনামূলক বিচার-বিবেচনায় এযাবৎকালে তার শাসনামলই ছিল শান্তিপূর্ণ।