চাঁদপুরে বেসরকারি স্কুল,কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি আদায়ে ড.আলমগীরের অবদান ছিল অতুলনীয়। কখনো আবেগজড়িত,কখনো বা জ্বালাময়ী বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদেরকে দাবি আদায়ের রাজপথের আন্দোলনে নিয়ে আসার মত দক্ষতা অধ্যক্ষ ড.আলমগীর কবিরের ছিল।
তিনি কেবলমাত্র বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি (বাকশিস) চাঁদপুর জেলার ৪৭ টি কলেজ শিক্ষক-কর্মচারীদের সংগঠনের সভাপতি নন; তিনি চাঁদপুরের সকল বেসরকারি স্কুল,কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি আদায়ের শীর্ষ শিক্ষক নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
১৯৯৪ সালে চাঁদপুরের বেসরকারি স্কুল,কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি আদায়ের কঠিন আন্দোলন-সংগ্রামে বাকশিসসহ কেন্দ্রিয় ৩৭ টি শিক্ষক সংগঠনের নেতৃত্বদানকারী ‘ জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্টে’র ব্যানারে শিক্ষকদের রুটি-রুজি ও আত্মমর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে সরাসরি যোগদান করেন অধ্যক্ষ ড.মো.আলমগীর কবির পাটওয়ারী।
অধ্যক্ষ ড. মো. আলমগীর কবির পাটওয়ারী ১৯৫৭ সালের ৭ জানুয়ারি হাজীগঞ্জের মকিমাবাদ গ্রামে একসম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম মনিরুজ্জামান পাটওয়ারী (র.) এবং মাতার নাম হোছনে আরা বেগম। ছোটবেলা থেকেই তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি হাজীগঞ্জ পাইলট থেকে ১৯৭৩ সালে এসএসসি,১৯৭৫ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি, ১৯৮০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.কম অর্নাস, ১৯৮১ সালে ঔ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এম কম ব্যবস্থাপনায় মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে এল এল বি ও ডক্টেরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়েই ১৯৮৪ সালে সর্বপ্রথম রহিমানগর কলেজের এমপিওভূক্তি শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতার এ মহান পেশায় প্রবেশ করেন। তখন তিনি উপজেলা বাকশিস সংগঠনে যোগ দেন। পরে তিনি ঔ কলেজ ছেড়ে তিনি ১৯৮৭ সালে হাজীগঞ্জের শিক্ষাবিস্তারে এলাকার সকল সমাজহিতৈষীদের সার্বিক সহায়তায় হাজীগঞ্জ মডেল কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৯৩ সালে কলেজটি এমপিওভূক্ত করার দায়িত পালনে সফল ভূমিকা পালন করেন।
১৯৮৭ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সরকারি বেতন ছাড়াই অধ্যক্ষ হিসেবে কলেজটিকে পরিচালনা করেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই তিনি অধ্যক্ষের দায়িত্বভার গ্রহণ করে পর্যায়ক্রমে জেলার শ্রেষ্ঠ কলেজের স্বীকৃতি, কুমিল্লা বোর্ডের ফলাফলে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন ও মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক পুরস্কার প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে চাঁদপুর জেলায় এর সুনাম অর্জনে কৃত্বিত্বের দাবিদার করে গড়ে তোলেন।
১৯৯৪ সালের থেকেই তৎকালীন বেসরকারি শিক্ষকদের মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির অন্যতম নেতা প্রধানশিক্ষক সাখাওয়াত হোসেন ও অপর শিক্ষকদের দাবি আদায়ের দিকপাল অধ্যক্ষ সাফায়াৎ আহমদ ভূঁইয়ার আহবানে চাঁদপুরের ‘শিক্ষক-কর্মচারীদেরকে দাবি আদায়ের আন্দোলনের ভ্যানু ’ নামে খ্যাত ‘ডিএন উচ্চ বিদ্যালয়ে ’এসে চাঁদপুর জেলা বাকশিসের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
সে থেকেই তিনি বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি বাকশিসের সভাপতির দায়িত্বগ্রহণ করে জেলার কলেজ শিক্ষকদের এক ও অভিন্ন ধারায় আনতে সক্ষম হন। যাঁরা সংগঠনের জন্যে সময়,অর্থ, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন, উপদেশ দিয়ে এর গতি সঞ্চার করে আজ পর্যন্ত রেখেছেন তিনিও তাদের একজন।
চাঁদপুরে স্বাধীনতাত্তোর স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রাপ্তি আদায়ে যাঁদের ভূমিকায় আজ শতভাগ বেতনভাতা, বাড়ি ভাড়া ভাতা, আংশিক হলেও উৎসব ভাতা , মেডিক্যাল ভাতা, কল্যাণ তহবিল গঠন ও অবসরসুবিধা,অষ্টম জাতীয় স্কেলভ’ক্ত হতে পেরেছে ১৯৯৪ সাল থেকে এসব আন্দোলনে তাঁর অবদান অতুলনীয়। তাঁর নেতৃত্বের প্রতি চাঁদপুর জেলার সকল শিক্ষক-কর্মচারীদের রয়েছে অবিচল আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ ।
১৯৯৪ সালের সেরা শিক্ষক আন্দোলনে নেতৃত্বে তাঁর সাথে শিক্ষক নেতৃবৃন্দ ছিলেন অধ্যক্ষ সাফায়াৎ আহমেদ ভূঁইয়া,অধ্যক্ষ রুহুল আমিন,অধ্যক্ষ হারুন অর রশিদ,অধ্যাপক মোশারফ হোসেন,অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, অধ্যক্ষ ছালামত উল্লাহ,অধ্যাপক সফিউল আযম শাহাজাহান,মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রধানশিক্ষক সাফাওয়াত হোসেন,প্রধানশিক্ষক মরহুম আলী মোহাম্মদ, প্রধান শিক্ষক নুর হোসেন,শহিদুল্লাহ প্রধান, প্রধানশিক্ষক আব্বাস উদ্দিন, প্রধানশিক্ষক সূর্যকুমার নাথ,মরহুম সিরাজুল ইসলাম, অধ্যাপক হাসান আলী, অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ,অধ্যাপক আলাউদ্দিন, অধ্যাপক খোরশেদ আলম,মো.বিলাল হোসেন,মাও.সালাউদ্দিন,কানিজ বতুল চৌধূরী প্রমুখ ।
শিক্ষকদের চাকুরি জাতীয়করণ করার সময় মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাকেও পর্যায়ক্রমে সরকারি করার কথা থাকলেও এর পরবর্তী সরকারগুলো নানাবিধকারণে কিংবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হাসিলের লক্ষ্যে তারাও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ফলে ওই সরকারগুলোর আমলে শিক্ষকরা ধর্মঘট, হরতাল, কর্মবিরতি, সমাবেশ, মহাসমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল,মানববন্ধন কর্মসূচি স্মারকলিপি পেশ,আলোচনা,পর্যালোচনা,মিটিং,মিছিল,কালো ব্যাচ ধারণ,কালো পতাকা উড্ডয়ন,এমপি-মন্ত্রীদের সাথে সাক্ষাৎ ও ১শ’ টাকায় ঘর বানিয়ে রাত্রি যাপন ইত্যাদি কর্মসূচিগুলো দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন করতে বাকশিসসহ চাঁদপুর জেলার স্কুল,মাদ্রাসা ও কারিগরিদেরকে এক প্লাটফরম থেকে নেতৃত্ব দিতেন। ঢাকার প্রতিনিধি সভায় অত্যন্ত গঠনমূলক বক্তৃতা দিয়ে বা দিকনির্দেশনায় আন্দোলন বেগবান করেন।
শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কিত সাফল্যকে সমুন্নত রাখাসহ আরো সম্প্রসারিত করার প্রয়োজন অপরিহার্য। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি দু’টি শব্দ শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যবধানে বেসরকারি স্কুল ও কলেজ শিক্ষকরা বৈষম্যের শিকার । একই যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তি,একই বিভাগে একই সিলেবাসে ও পাঠ্যপুস্তকের পাঠ্যক্রমে পাঠদান,এক ইনিয়ম কানুনে একই মন্ত্রণালয়ের অধীনে এবং একই সমাজে বসবাস করেও বেসরকারি শিক্ষকদের জীবন নানাভাবে পিছিয়ে রয়েছে। এ বিষয়গুলোর ওপর তিনি তাঁর বক্তৃতায় প্রাঞ্জলভাষায় উপস্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষকদেরকে আরো দায়িত্ববান হতে পরামর্শ দিতেন ।
শিক্ষকদের প্রাপ্তিতে রয়েছে-পৌনে ৫ লাখ এমপিওভূক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি ‘শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করে সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য দূর করা।’ শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ না হলে বৈষম্য থেকেই যাবে।
দেশের সকল শিক্ষক সংগঠনগুলো এক হয়ে‘ শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করে সরকারি-বেসরকারি বৈষম্যদূর করুন’সর্বশেষ শিক্ষক আন্দোলনকে বেগবান করতেও ঢাকার প্রেসক্লাবে চাঁদপুরের শিক্ষকদের নেতৃত্বে ছিলেন অধ্যক্ষ ড.আলমগীর কবির পাটওয়ারী। তিনি জানতেন এর সুফলভোগী তিনি হবেন না। তবুও বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রাপ্তি আদায়ে তিনি যে ত্যাগ শিকার করেছেন তা চাঁদপুরের শিক্ষক সমাজের কাছে চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে।
তিনি মোতাওয়াল্লী সমিতি বাংলাদেশ এর মহাসচিব ও এডভোকেট ঢাকা জেলা বার,মোতাওয়াল্লী,হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ কমপ্লেক্স, ওয়াক্ফ এস্টেট সদস্য জাতীয় ওয়াক্ফ কমিটির সদস্য ।
সামাজিক সংগঠনের মধ্যে তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি চার্টার প্রেসিডেন্ট হাজীগঞ্জ রোটারী ক্লাব,সভাপতি, দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির হাজীগঞ্জ, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জামিয়া আহমাদিয়া কাওমী মাদরাসা,সহ-সভাপতি, আহমাদিয়া আলীয়া মাদধাসা,প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সাপ্তাহিক হাজীগঞ্জ, প্রতিষ্ঠাতা ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, হাজীগঞ্জ প্রেস ক্লাব , শিক্ষা বিষয়ক কলাম লেখক । তাঁর প্রকাশিত একটি বই রয়েছে এরটির নাম ‘ প্রেক্ষাপটের আলোকে’।
২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি হাজীগঞ্জ মডেল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সফল মহান এ শিক্ষক অত্যন্ত সুনামের সাথে অধ্যক্ষের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর সহধর্মিণীর নাম আয়েশা সিদ্দিকা বি.এ (অনার্স), এম.এ যিনি একজন প্রভাষক। তিনি দু’পুত্র ও এক কন্যার সৌভাগ্যশীল পিতা। তারা সবাই উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনকারী ।
অধ্যক্ষ ড.মো.আলমগীর কবির পাটওয়ারী হাজীগঞ্জ মডেল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ও এ কলেজের সকল শিক্ষকদের অভিভাবক, আধুনিক হাজীগঞ্জের রূপকার, একজন সফল শিক্ষাবিদ ও খ্যাতনামা সংগঠক,শিক্ষক নেতা ও চাঁদপুর জেলার বেসরকারি স্কুল , কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের পরমবন্ধু,কলামিস্ট ও সমাজহিতেষী আদর্শবান ব্যাক্তি।
শিক্ষামূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তিনি যুক্তরাষ্ট, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইটালী, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, জার্মানী,অস্ট্রেলিয়া, সিংগাপুর, ভারত প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন ।
লেখক: আবদুল গনি ,সহ-সভাপতি, মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতি, চাঁদপুর । ২০ অক্টোবর ২০১৯