ফিচার

মায়ের মৃত্যুর প্রত্যক্ষ সাক্ষী সন্তানের আবেগঘন একটি লেখা

মা, তোমার পরকাল যাত্রা দে‌খে আমা‌দের হিংসা হয়। কেন যা‌নো? ‌তোমার বিদা‌য়ের পূ‌র্বের ২৪ ঘণ্টার কর্ম-কথা আমরা কেউ বুঝ‌তে পা‌রি‌নি।

২৪ ঘণ্টা পূ‌র্বে তু‌মি আমায় ব‌লেছ, বাবা কয় দিন ধ‌রে তোর নানা আমা‌রে ডা‌কে। কখ‌নো চুপ ক‌রে দা‌ড়ি‌য়ে থা‌কে। কখ‌নো ব‌লে তাড়াতা‌ড়ি আয়। আবার কখ‌নো ব‌লে দে‌রি করছ কেন।

‌তোমা‌কে কো‌নো জবাব দি‌তে পা‌রি‌নি। একই দিন আমার সন্তান  স্ত্রী‌কে ব‌লে‌ছি‌লে মা‌গো তোমার দুই বাচ্ছার সময় আ‌মি ছিলাম, যতটুকু পার‌ছি কর‌ছি, এবার আর থাক‌তেও পার‌বো না, কিছু কর‌তেও পার‌বো না আমা‌রে মাফ ক‌রে দিও।

‌সে রা‌তে তু‌মি তোমার প্রবাসী বড় ছে‌লের জ‌ন্যে আমা‌কে ব‌লে ছি‌লে বাবা তোর বড় ভাই‌য়ের জ‌ন্যে কিছু ঔষধ ব্যবস্থা ক‌রে কাল দুপুর বা‌রোটার ম‌ধ্যে যে যা‌বে ওর কা‌ছে পৌ‌ঁছে দিস।

আ‌মি স‌ত্যিই তোমার কথাম‌তো বৃ‌ষ্টিতে ভি‌জেও স‌ঠিক সম‌য়ে তোমার কথা রেখ‌ছি। তু‌মি তখ‌নো আমা‌কে ব‌লো‌নি যে, তোমর শরীরটা ভা‌লো না। একবা‌রের জ‌ন্যেও ব‌লো‌নি গত ক‌য়েকদিন তোমার ঔষধ নেই। কারণ আমার আ‌র্থিক ব্যায় বেড়ে যা‌বে ব‌লে।

দুপুর ১২টায় আ‌মি বাসায় ফি‌রে জানলাম তোমার  মামা অর্থাৎ আমার নানা ‌সৌ‌দি না যে‌য়ে ১ মা‌সের সময় বা‌ড়িয়ে ঢাকা থে‌কে আস‌তে‌ছে তোমার সা‌থে দেখা কর‌তে। সারা দিন তা‌দের খেদমত ক‌রেছো। তখ‌নো কাউ‌কে তোমার শরীর ভা‌লো নেই কথাটা ব‌লো‌নি।

 

বি‌কেলে তা‌দের বিদায় দি‌য়ে তোমার মা‌য়ের (নানু) সেবা ক‌রে সময় পার ক‌রেছ এশার নামায পর্যন্ত। সেখান থে‌কে তু‌মি বিদায় নি‌য়ে আমার বাবার সেবায় বা‌কিটা সময় পার ক‌রেছ। এশার নামায প‌ড়ে বাবা‌কে খাবার খাই‌য়েছ। অন্যান্য দি‌নের মত সকল সেবা শে‌ষে একই বিছানায় ঘু‌মি‌য়েছ। তখন তোমার শাষকস্ট হ‌চ্ছে ব‌লে বাবা‌কে ব‌লে অ‌নেক চেস্টায় ঘু‌মি‌য়েছ। হটাৎ বাবার কা‌ছে আশা এক‌টি ফো‌নের আওয়াজ শু‌নে তোমার ঘুম ভাং‌লো। তার পর শুরু হ‌লো তোমার চুড়ান্ত বিদায় নেয়ার পালা। কিচুক্ষণ প‌রে যখন আর সই‌তে পার‌ছি‌লে না তখন বাবার কা‌ছে আমার কথা ব‌লে‌ছি‌লে একটু হস‌পিটা‌লে নেয়ার জ‌ন্যে। তোমার কথায় বাবা আমা‌কে ফোন দি‌য়ে ব‌লে বাবা তু‌মি কই? জবা‌বে বললাম বাবা আ‌মি ডাঃ মোবারক স্যা‌রের কা‌ছে হস‌পিটা‌লে ব‌সে কথা বল‌ছি। এখান থে‌কে বে‌রি‌য়ে ডাঃ দে‌লোয়ার স্যা‌রের সা‌থে দেখা ক‌রবো।

তখন বাবা আমা‌কে ব‌লে‌ছি‌লো বাব, তোর মা‌র অবস্থা ভা‌লো না, একটু হস‌পিটা‌লে নি‌য়ে যা। আ‌মি তাৎক্ষ‌ণিক সা‌থে থাকা হাঃ তা‌মিম‌কে বাসায় গি‌য়ে মা‌কে নি‌য়ে আস‌তে বললাম এবং আ‌মি ডাক্তার‌দের সা‌থে কথা ব‌লে চি‌কিৎসার আ‌য়োজন কর‌তে লাগলাম। এর পর মা‌গো তু‌মি আমা‌কে ৩০মি‌নিটও সময় দি‌লে না। আমা‌কে ডে‌কে বল‌লে, বাবা আমার আর সময় নেই, আ‌মি চলে যা‌চ্ছ‌ি, আমা‌কে তোরা মাফ ক‌রে দিস, মুরশীদ‌কে (আমার ছেট ভাই) একটু দে‌খে রা‌খিস। এটাই ছিল প‌রিবা‌রের ব্যাপা‌রে কা‌রো সা‌থে তোমার শেষ কথা।

 

তার পর তোমার চুড়ান্ত বিদা‌য়ের প্রস্তু‌তি নেয়া শুরু কর‌লে। উচ্ছ আওয়া‌জে প্রথ‌মে আস‌তেগফার তার পর দুরুদ, এরপর কা‌লেমাগু‌লো পড়‌তে পড়‌তে ২/৩ মি‌নি‌টের ম‌ধ্যে চোখ বন্ধ ক‌রে নি‌লে। তখন আর আওয়াজ নেই, কিন্তু তোমার মু‌খে র‌বের কা‌লিমা জা‌রি রই‌লো। এমতাবস্থায় তোমার চেহারার দি‌কে তা‌কি‌য়ে বাবা‌কে বললাম, বাবা দেখেন মা‌য়ের চেহারায় কি‌সের এ‌তো আ‌লো। পর্যায়ক্র‌মে তোমার চেহারা উজ্জল হ‌তে থাক‌লো। এ সময়টুকু‌তে আ‌মি মাত্র ২বার সূরা ইয়‌সীন তেলাওয়াত কর‌তে পে‌রে‌ছি। শেষবার ২/৩ আয়াত বা‌কি থাক‌তে তু‌মি শেষ নিঃশাষ ত্যাগ কর‌লে। আ‌মি তেলাওয়াত শেষ ক‌রে বাবা‌কে বললাম আলহামদু‌লিল্লাহ, বাবা মা চ‌লে গে‌ছেন। (ইন্না…র‌জিউন)

এ ভাবেই আমা‌দের‌কে তু‌মি তোমার ঈমানদা‌রিতার  সাক্ষি ক‌রে প্রভূর ডা‌কে সাড়া দি‌য়ে ঈমা‌নি হাল‌তে পরকা‌লের প‌থে যাত্র কর‌লে।

এ ছাড়াও তু‌মি বিগত মাস জু‌ড়ে সক‌লের কা‌ছে মাফ চে‌য়েছ। সকল‌কে তোমার সাধ্যমত খু‌শি করার চেষ্টা ক‌রেছ। ‌যেসব এখন তোমার অবর্তমা‌নে আমা‌দের কা‌ছে সবাই বল‌ছে।

মা, তু‌মি আমা‌দের সাক্ষি ক‌রেছ। আ‌মি দু‌নিয়া বা‌সির কা‌ছে তা তু‌লে ধরলাম। কারণ, মৃত্যুর পূ‌র্বে তোমার এমন প্রস্তু‌তি দে‌খে মা‌গো এখন আমার হিংসা হয়। ‌তোমার মত ক‌রে পরকাল যাত্রা কর‌তে।

আমার মত এমন হিংসা দু‌নিয়ার প্র‌তি‌টি মুস‌লি‌মের যেন হয়।

মা, ‌তোমার মৃত্যু প্রস্তু‌তি দে‌খে বিশ্বাস রেখে‌ছি, মহান প্রভূ তোমায় জান্না‌তের মেহমান ক‌রে নি‌য়ে‌ছেন। মহান রব ন‌িশ্চই তোমায় ভা‌লো রাখ‌বেন।

মা আ‌মিও আস‌বো তোমার কা‌ছে, একটু প্রস্তু‌তি নি‌তে সময় চাই আমার র‌বের নিকট। ক‌ারণ এক‌টি জান্নাত হা‌রি‌য়ে‌ছি, যত্ন নি‌তে পা‌রি নাই। অব‌শিষ্ট যে জান্নাত রে‌খে গেছ তার একটু যত্ন নি‌য়েই নি‌জের জন্য প্রস্তু‌তি… আ‌মি‌তো তোমার মৃত্যুর পূর্বক্ষ‌ণে নি‌জের জীবনের বি‌নিম‌য়ে হ‌লেও তোমার হায়াত চে‌য়ে‌ছি। বাবার জন্য হয়‌তো আমা‌কে আ‌রো কিছু সময় দেয়া হ‌য়ে‌ছে। প্রভূর নির্ধা‌রিত সম‌য়েই তোমা‌কে নি‌য়ে গে‌ছেন। আর আমার করা দা‌বি হয়‌তো বাবার জন্য কবুল হ‌য়ে‌ছে।

মায়ের মৃত্যুর সংবাদ লেখকের ফেসবুক ওয়ালে।

মা তোমার শুন্যতা আমা‌কে তছনছ করে দি‌চ্ছে।  একটু শ‌ক্তি চাই প্রভুর নিকট। ‌যেন তোমার রে‌খে যাওয়া আমান‌তের স‌ঠিক যত্ন নি‌তে পা‌রি।
মা, জান্না‌তের পা‌খি হ‌য়ে উ‌ড়ে এসে আমার সা‌থে একটু দেখা ক‌রে যেও। ‌তোমার স্বাক্ষাৎ হয়‌তো আমা‌কে সাহস ও সামর্থ যোগা‌তে সহায়ক হ‌বে।
ভালো থে‌কো মা।

লেখক : মুসাদ্দেক আল আকিব,
সাবেক প্রধান বার্তা সম্পাদক চাঁদপুর টাইমস।

Share