দেশে শুধু কোরবানির সময়েই প্রায় সারা বছরের চাহিদার অর্ধেকের বেশি গরু জবাই হয়। এসময়ে ভালো মানের গরু জবাই হওয়ায় চামড়াও ভালো মানের হয়। ভারতে গরু জবাই নিষিদ্ধ হওয়ায় এ চমড়ার দিকেই তাকিয়ে থাকেন ওপারের ব্যবসায়ীরা। ফলে ঈদের সময়ে বেশি দাম পাওয়ায় চমড়া পাচার হয় দেশ থেকে।
ভারত সরকার কয়েক বছর ধরেই তাদের দেশে গরু জবাই নিষিদ্ধ করেছে। অপরদিকে সীমান্ত নজরদারির কারণে ভারতীয় গরু স্বাভাবিক সময়ের মতো আর বাংলাদেশে আসছে না। কিন্তু ঈদের সময়ে ঠিকই বাংলাদেশের গরুর চামড়া চোরাই পথে ওপারে নিয়ে যাওয়ার জন্য অগ্রিম টাকা বিনিয়োগ করেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা।
সরকারি হিসাব বলছে, দেশে আমিষের চাহিদা মেটাতে বছরে প্রায় দুই কোটি ৩১ লাখ ১৩ হাজার গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া জবাই হয়। এর প্রায় ৫০ ভাগ জবাই হয় কোরবানির ঈদের সময়। যার ৯০ শতাংশই এখন দেশিয়ভাবে মেটানো সম্ভব হয়েছে।
গত বছর কোরবানি উপলক্ষে সারা দেশে এক কোটি পাঁচ লাখ গবাদিপশু বিক্রি হয়। এবার এক কোটি ১৫ লাখের মতো গবাদিপশু দরকার হবে কোরবানির সময়। সেই জায়গায় কোরবানিযোগ্য পশু তৈরি হয়েছে এক কোটি ১৫ লাখ ৫৭ হাজার। ফলে এবার ভারত থেকে গরু আসা ছাড়াই কোরবানি সম্ভব আমাদের।
প্রতিবছরই কোরবানির পশুর চামড়া ভারতে পাচার হয়ে যায়। পুলিশ কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, নগদ ও অতিরিক্ত মূল্য পাওয়ার কারণেই ভারতে পাচার হয় কোরবানির পশুর চামড়া। তাদের ধারণা চোরাকারবারিদের সারা বছরের অন্যান্য চোরাই ব্যবসা ঠিক রাখতেও চামড়া পাচার হয়। তবে এবার চামড়া পাচার বন্ধে দেশের সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়িয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদ মৌসুমে নগদ টাকায় চামড়া কিনতে হয় তাদের। কিন্তু সেগুলো বড় ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করে মাসের পর মাস ও টাকার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। হয়রানি হতে হয় নানা ক্ষেত্রে। অন্যদিকে ভারতের ব্যবসায়ীদের কাছে চামড়া বিক্রি করলে বেশি লাভ এবং নগদে টাকা পাওয়া যায়।
যে কারণে সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকে সীমান্তে চামড়া পাচার হয়ে যায়। এছাড়া বাংলাদেশে কোরবানির একদিনে যত গরু জবাই হয়, ভারতের সীমান্ত এলাকায় কয়েক বছরেও এত গরু জবাই হয় না। সে কারণেও সেখানকার চামড়া ব্যবসায়ীরা অপেক্ষায় থাকে বাংলাদেশের ভালো মানের চামড়া সংগ্রহ করতে।
সাতক্ষীরা জেলার কয়েকজন বাসিনদা বলেন, ‘ভারতে গরু জবাই করা নিষিদ্ধ। জবাই হলেও খুবই সামান্য। ঈদের সময়ে সবচেয়ে ভালো মানের গরু জবাই হয়। ফলে বাংলাদেশের গরুর চামড়ার মান ভালো থাকে। বাংলাদেশের চেয়ে ভারতে চামড়ার মূল্য বেশি হওয়ায় চোরকারারিরা দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে চামড়া পাচার করেন।
সিলেটের চামড়া ব্যবসায়ীরাও জানালেন একই কথা। তাদের মতেও ভারতে চামড়া পাচার হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, নগদ মূল্য ও মুনাফা বেশি। এছাড়া নগদে চামড়া কিনে বাংলাদেশের ট্যানারি মালিকদের কাছে বাকিতে চামড়া বিক্রি করতে হয়। মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও ঠিকমতো টাকা আদায় করা যায় না।
ভারতে গরু জবাই কম হওয়ায় ভারতের চামড়া ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের চামড়ার অপেক্ষায় থাকে। তারা এই সময়ে অগ্রিম টাকাও দিয়ে দেন মৌসুমি ব্যবসায়ীদের। নগদ মূল্যে চামড়া কিনে থাকেন। এ কারণেই ঈদ মৌসুমে ভারতে চামড়া পাচার বেশি হয়।
ভারতে কোরবানির চামড়া পাচার হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, মূলত আর্থিক সংকটের কারণে ভারতে চামড়া পাচার হয়। এই মৌসুমে দেড় দুই হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়। সেক্ষেত্রে ট্যানারি মালিকদের তো এত টাকা নেই। আর এতটাকা ঋণও পাওয়া যায় না। ব্যাংক সাধারণত দুই তিন শ কোটি টাকা আমাদের ঋণ দেয়। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তখন দেখা যায় যে, মৌসুমি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সঠিক সময়ে ট্যানারি মালিকরা চামড়াটা কিনতে পারেন না। এ কারণে সীমান্ত দিয়ে চামড়াগুলো ভারতে পাচার হয়ে যায়। এছাড়া মৌসুমি চামড়াটা ভালো হওয়ায় ভারতের বড় ব্যবসায়ীরা এ সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন।
তবে, চামড়া যেন পাচার না হয়, সে জন্য জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। চামড়া পাচার রোধে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি, পুলিশ ও গোয়েন্দাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
এছাড়া ঈদের পরে চামড়া পাচার রোধে কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেটও মাঠে থাকবেন। চামড়া পাচারের তথ্য পাওয়া মাত্র প্রশাসনকে জানানোর জন্য সীমান্তবর্তী এলাকার চেয়ারম্যানদের বলা হয়েছে।
চামড়া পাচার হওয়ার কারণ হিসেবে সবাই বলছেন, প্রধানত আর্থিক কারণে তা হয় বেশি। যেখানে লাভ বেশি, ব্যবসায়ীরা সেখানেই ব্যবসা করেন। সীমান্ত এলাকায় এপার-ওপারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নানা কারণে সম্পর্ক সারা বছরই ভালো থাকে। বিভিন্ন পণ্য কেনা-বেচায় সারা বছরই লেনদেন চলে। সুদীর্ঘ সম্পর্কের কারণে আস্থাটাও স্থায়ীত্ব নিয়েছে। তাই অগ্রিম টাকা দিতে তাদের সমস্যা হয় না। এজন্য চামড়ার বড় একটি অংশ চলে যায় ওপার তথা ভারতে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে কোরবানির ঈদ উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা বৈঠক হয় গত ২০ আগস্ট।
বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের বলেছেন, চামড়া পাচাররোধ ও এ নিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
ঢাকা মহানগরীর প্রবেশ ও বাইর হওয়ার পয়েন্টগুলোয় নিরাপত্তা ও তল্লাশি চৌকি বসানো হবে। সীমান্ত এলাকা দিয়ে যেন চামড়া পাচার না হতে পারে, সে জন্য অতিরিক্ত নজরদারি করা হবে।
নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ ০৭ : ৩০ পিএম, ৩ সেপ্টম্বর ২০১৭, রোববার
এইউ