বগুড়ার একসময়ের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মরহুম আকবর আলী আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল ১৯১১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকেই তিনি নিয়ম করে প্রতি রাতে ১১ টা থেকে ১২টায় গরিব মিসকিনদের বিনামূল্যে খাবার দিতেন।
তার মৃত্যুর পর তার ছেলেরা এ নিয়ম মেনে চলছেন। প্রতিদিন রাত ১১টা থেকে ১২টায় বিতরণ করা হয় টাটকা খাবার। শহরের গরিব দুঃখীরা এখানে আসেন একবেলা পেটপুরে ভালো খাবারের আশায়।
বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বগুড়ার আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল। মুসাফির (অতিথি) ভিক্ষুক, ছিন্নমূল মানুষের মধ্যে বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করে আসছে শত বছর ধরে। এখানে প্রত্যেক রাত ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে শহরে অবস্থানরত নাম-পরিচয়হীন এই মানুষদের একবেলা ভালোমানের খাবারের ব্যবস্থা করে থাকে হোটেল কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আলহাজ আকবর আলী মিঞা তৎকালীন ভারতের মুর্শিবাদ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ভাগ্য অন্বেষণে পরিবারসহ বগুড়া জেলার পাশের পাবনা জেলার পাকশি, বগুড়ার সান্তাহার এবং পরে বগুড়া শহরে আসেন। এরপর আকবর আলী তার ভাইয়ের সাথে মেকানিক্যাল কাজ শুরু করেন। ওই সময় বগুড়া শহরে মুসলমানদের খাবারের কোনো হোটেল ছিল না। হিন্দু সম্প্রদায়ের হোটেলে আবার মুসলমানরা যেত না। আবার হিন্দুরা তাদের হোটেলের আসবাবপত্র মুসলমানদের ছুঁতেও দিত না। এখান থেকেই তিনি হোটেল ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু হোটেল করার প্রয়োজনীয় অর্থ তার কাছে ছিল না। হোটেলের পুঁজির জন্য নিজে মিষ্টি তৈরি করে ফেরি করে বিক্রি শুরু করেন। মিষ্টি বিক্রির কিছু পুঁজি নিয়ে ১৯১১ সালে বগুড়া শহরের চকজাদু রোডের মুখে মাসিক আট টাকা ভাড়ায় হোটেল ব্যবসা শুরু করেন। বগুড়া শহরে তৎকালীন আকবর আলীর ছোট্ট হোটেলই ছিল মুসলমানদের একমাত্র খাবার হোটেল। তাই খুব দ্রুত হোটেলের নাম ডাক ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় মুসলমানদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সেখানে গ্রাহকদের স্থানসঙ্কুলান হতো না। তাই তিনি শহরের থানা রোডে হোটেলটি স্থানান্তর করেন। যা বর্তমানে আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল হিসেবে পরিচিত।
তিনি চল্লিশ থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত তার হোটেলে মাসিক ১৫ থেকে ২০ টাকার মধ্যে তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করতেন। সে সময় ঘি দিয়ে রান্না করা বিরিয়ানির দাম ছিল এক টাকা প্লেট। ব্রিটিশ আমলে শহরে বিদ্যুৎ না থাকলেও তিনি নিজস্ব জেনারেটরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছিলেন।
বগুড়ার সাদা সেমাইয়ের দেশব্যাপী যে কদর তার মূলেও ছিলেন আকবর আলী। সে সময় কলকাতা থেকে সেমাই আসত বাংলাদেশে। সেমাই তৈরির গল্প কারো জানা ছিল না। এই অঞ্চলের মুসলমান বা সাধারণ মানুষকে অল্প দামে সেমাই খাওয়ানোর তাগিদ থেকে তিনি সেমাই তৈরি করেন এবং সফল হন। হোটেল ব্যবসায় দিন দিন ব্যাপক প্রসার ঘটতে থাকে। ধর্মভীরু আকবর আলী ব্যবসায় উন্নতি এবং প্রসারে খুশি হয়ে আয়ের একটা অংশ দিয়ে প্রতিদিন রাতে গরিব, মুসাফির, ভিক্ষুক ও মিসকিনদের খাওয়াতেন। তিনি সেটা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত করে গেছেন।
১৯৭৫ সালে তিনি মৃত্যুর আগে তার ছেলেদের হোটেলের আয় থেকে মুসাফির, ফকির, মিসকিন ও গরিবদের খাওয়ানোর কথা বলে গেছেন। তাই সে কথার এতটুকু নড়চড় হয়নি আজো। বাবার শুরু করা নিয়ম মেনে তার ছেলেরা আজো তা পালন করে যাচ্ছেন। আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেলের এখন শহরেই চারটি শাখা। কবি নজরুল ইসলাম সড়কে আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল, ইয়াকুবিয়ার মোড়ে মিষ্টি মেলা, ডিসি অফিস চত্বরে অ্যাডমিন হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ও শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ও চারমাথা বাসটার্মিনালে রেস্টুরেন্ট সংযোজন করা হয়েছে। রয়েছে চাইনিজ, থাই ও ফাস্ট ফুড, লাচ্ছা-সেমাই, দই, মিষ্টি ও বিস্কুট। কর্মচারী রয়েছে দুই সহস্রাধিক। আকবর আলীর সেই লাচ্ছাসেমাই এখন বিদেশের বাজারেও বিক্রি হয়।
জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনা নদী ভাঙনের শিকার হোসেন আলী জানান, একসময় সারিয়াকান্দিতে সে বাবার জমিজমা চাষ করে তার সংসার চলত। যমুনার গ্রাসে জমি হারিয়ে গেছে নদীবক্ষে। সব হারিয়ে এখন তিনি শহরে দিনমজুরের কাজ করেন। বগুড়া শহরের সাতমাথা এলাকায় ভাসমান থাকেন। দিনে যা আয় করেন তা দিয়ে দিন চলে। আর রাত হলে আকবরিয়া হোটেলের খাবার গ্রহণ করেন। এতে সে রাতের খরচটা বাঁচাতে পারেন। তিনি জানান, তার মতো অনেক মানুষই সেখান থেকে খাবার সংগ্রহ করে।
বগুড়া স্টেশন রোডের ফুটপাথের ভিক্ষুক মো: আছলাম হোসেন জানান, সারা দিন ভিক্ষা করে যা পান তা দিয়ে তার দিন চলে আর রাতে আকবরিয়া হোটেলের ফ্রি খাবার খেয়ে ঘুমান। তিনি জানান, আকবরিয়া হোটেলে ভালোমানের খাবার দেয়া হয়। মাছ, গোশত, সবজি, ডাল, আলু ঘাঁটি, শাক ইত্যাদি দিয়ে ভাত খেতে দেয়া হয়। একেক দিন একেক ধরনের খাবার দিয়ে থাকে। হোটেলের সামনের রাস্তায় যত লোকই বসবে প্রত্যেককে খাবার দিয়ে থাকে। সে খাবার কম পড়ে না।
৬৫ বছরের বৃদ্ধ রমজান আলী ব্যাপারী জানান, বয়সকালে বগুড়া শহরে দিনমজুরের কাজ করতেন। ওই সময়ে সে আকবরিয়া হোটেল থেকে বিনামূল্যে খাবার দিতে দেখে আসছেন। এখন সে আয়-রোজগার করতে পারে না বলে রাতেরবেলা হোটেলের খাবার খেয়ে থাকে।
মরহুম আকবর আলী মিঞার ছোট ছেলে ও আকবরিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান মো: হাসান আলী আলাল জানান, ১৯১১ সালে হোটেল চালু হয়েছে।
এই হোটেলের আয় দিয়ে বাবা প্রথম দ্বীনহীন মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত বাবার সেই নিয়ম পালন করা হচ্ছে। এই খাবার বিতরণের জন্য প্রতিদিন এক মণেরও বেশি চাল রান্না করা হয়। আলাদাভাবে রান্না করে খাবার বিতরণ করা হয়। রাত ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে হোটেলের সামনের রাস্তায় সে খাবার বিতরণ করা হয়।
তিনি জানান, প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন শ’ অভাবী মানুষ একবেলা পেটভরে খাবার খান। মূলত খাবারটি বিতরণ শুরু হয়েছিল মুসাফিরদের জন্য। (উৎস- নয়া দিগন্ত)