মার্চ ৭, ২০১৫
Dr. Dipu Moni
সম্প্রতি কোলকাতার ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় একজন সাংবাদিক তিস্তা চুক্তি নিয়ে মমতা ব্যানার্জীর মত প্রসঙ্গে লিখেছেন যাতে ডা. দীপু মনি নিয়ে কিছু কথা আছে। এ বিষয়ে ডা. দীপু মনি তাঁর বক্তব্য আমাদের পাঠিয়েছেন। পাঠকের আগ্রহ বিবেচনা করে লেখাটি প্রকাশ করা হল :
বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে চমকে দিয়েছিলেন অনেককেই। সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মাঝে মাঝেই এমন ধরনের সমালোচনা শুনতে হয়েছে যার যৌক্তিকতা খুব নির্মোহ আত্মসমালোচনা, আত্মবিশ্লেষণে অভ্যস্ত আমি খুঁজে পাইনি। এমনকি যাঁরা বস্তুনিষ্ঠভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারেন এবং খোঁজ-খবর রাখেন বিভিন্ন বিষয়ে, তাঁরাও এসব সমালোচনার যৌক্তিকতা খুঁজে পাননি। সে সময়ে একজন বর্ষীয়ান শিক্ষাবিদ-গবেষক আমাকে বলেছিলেন “এত কম বয়সে এত বড় দায়িত্ব পাবেন এবং শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে সে গুরুদায়িত্ব মুন্সীয়ানার সঙ্গে পালন করবেন– অথচ কেউ ঈর্ষান্বিত হবে না তা কি হয়?”
যখনই কোনো নিন্দা শুনেছি, তা ঈর্ষাপ্রসূত হোক কী যথার্থ– আমি তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে যেখানে যতটুকু নিজের কাজ শুধরে নেবার প্রয়োজন মনে করেছি, তা করে নিয়েছি। যখনই সুযোগ পেয়েছি, নিন্দুককেও ধন্যবাদ জানিয়েছি আমাকে ভুল সংশোধনের সুযোগ করে দিবার জন্য। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখেছি, ভদ্রতা, বিনয় লোকে দুর্বলতা ভেবেছে।
কয়েকটি ‘চিহ্নিত মহল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সকল সাফল্য ছোট করতে চেয়েছে। বারবার আমাকে ছোট করতে চেয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যার স্নেহভাজন, ঘনিষ্ঠজন হিসেবে যারা পরিচিত, তাদেরকে দূরে সরাবার প্রক্রিয়াও চালিয়েছে ২০০৭-০৮-এর কুশীলবরা, মাইনাস-টু-ওয়ালারা। তাদেরও আক্রোশের শিকার হতে হয়েছে আমাকে। সে উদ্দেশ্যে বারবার তথ্য বিকৃত করেছে বা অসত্যকথন করেছে। মাঝে মধ্যে যখন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছি, প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি, তখন উত্তর দিয়েছি; ভ্রান্ত, বিকৃত, অসত্য তথ্য সম্পর্কে আমার বক্তব্য তুলে ধরেছি।
তবে প্রায়শই তথ্য বিকৃতকারীরা, অসত্য বক্তব্য দেওয়া ব্যক্তিরা আমার সামনে আসেননি। সামনাসামনি প্রশ্ন তোলেননি। আমাকে সরাসরি উত্তর দিয়ে ভ্রান্তি, বিকৃতি, অসত্য দূর করবার সুযোগ দেননি। আমিও সময় দিয়ে, কষ্ট করে এ কাজ সর্বক্ষেত্রে করিনি। সে সব বিকৃত, ভ্রান্ত বা অসত্য তথ্য সম্পর্কে আমি লিখতে পারতাম। সত্য তুলে ধরতে পারতাম। করিনি। কারণ এ কাজ করতে হলে আমাকে যতটা সময় দিতে হত লেখালেখি করবার জন্য সে সময়টুকুতে আমার দায়িত্ব পালনে ব্যাপৃত থাকাই আমি দেশের স্বার্র্থের জন্য জরুরি বলে জ্ঞান করেছি।
আমি আমার দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থেকেছি— কারা কোন উদ্দেশ্যে অসত্য তথ্য ছড়িয়ে আমাকে ছোট করার অপচেষ্টা করছে তা নিয়ে মাথা ঘামাইনি বা তা রোধ করতে ব্যস্ত হয়ে যাইনি।
ভেবেছিলাম ভবিষ্যতে যখন আমার প্রায় পাঁচ বছরের পররাষ্ট্রন্ত্রিত্বের অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু লিখব, তখন এ বিষয়গুলোকেও তাতে ছোট করে হলেও একটু জায়গা দেব। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, বোধহয় এখনই একটু লেখা প্রয়োজন।
ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ২০১১ সালের ৫-৬ সেপ্টেম্বরে ঢাকা এলেন। সবাই আশা করেছিলেন তাঁর এই ঐতিহাসিক সফরের সময় অন্য বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের পাশাপাশি তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তিটিও স্বাক্ষরিত হবে। স্থল সীমান্ত চুক্তির প্রটোকল, সহযোগিতার কাঠামো চুক্তিসহ বেশ কয়েকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল স্বাক্ষরিত হলেও তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি এ সফরের সময়। আমরা সবাই জানি কেন তা হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর আসবার কথা ছিল প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে। তিনি আমার আমন্ত্রণ গ্রহণ করে জবাবও দিয়েছিলেন। আসবার আগ্রহের কথাও জানিয়েছিলেন। কেন আসেননি তাও সবাই জানেন।
হঠাৎ করেই সে ঘটনার কয়েক মাস পর থেকে লেখালেখি শুরু হল আমার সঙ্গে তাঁর বৈঠকের সময় নাকি ‘ঝগড়া-ঝাঁটি’ হওয়াতেই তিনি ঢাকা আসেননি। সুতরাং তিস্তা চুক্তি না হবার কারণ আমি। এই ‘তত্ত্বে’র শুরু শুনেছি কোলকাতার কোনো একটি পত্রিকা। আমাদের কিছু পত্রিকা এবং কিছু টকশোর অতিথির কল্যাণে এটি একসময় বেশ চাউর হয়েছিল। আমাকে দুয়েকজন সরাসরি জিজ্ঞেসও করেছিলেন। আমি তাদেরকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি, এ প্রচারণা কতটা ভিত্তিহীন, মনগড়া এবং অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
আজ আবার দেখলাম জয়ন্ত ঘোষাল কোলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় মমতা ব্যানার্জীর তিস্তা চুক্তি নিয়ে সাম্প্রতিক মত পরিবর্তন সম্পর্কে লিখতে গিয়ে পুরনো কাঁসুন্দির মতো আবারও সেই পুরনো ভিত্তিহীন বিষয়টি লিখেছেন। মমতা ব্যানার্জীর সঙ্গে আমার কথিত ‘কথা কাটাকাটির’ কারণেই নাকি তিস্তা চুক্তি ‘বিশবাও জলে পড়ে গিয়েছিল’! এবার অবশ্য লেখা হয়েছে আমি যখন মমতা ব্যানার্জীকে ‘বোঝাতে গিয়েছি’, তখন এ ঘটনা ঘটে। আমি তাঁকে বোঝাতে যাইনি। অন্য অনুষ্ঠানে গিয়ে ফিরতি পথে একটি সৌজন্যমূলক বৈঠক হয়েছিল।
আমি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে কয়েকটি তথ্য জানাতে চাই জয়ন্ত ঘোষালকে, তাঁর পাঠককে এবং অন্য আরও যারা এ গল্প এর আগে গিলেছেন বা গিলতে বাধ্য হয়েছেন (এ গল্পের পরিবেশকদের পটুতায় এবং আমার প্রতিবাদের অনুপস্থিতিতে)। ড. মনমোহন সিং ঢাকা সফর করেছিলেন ২০১১এর সেপ্টেম্বরের ৫-৬ তারিখে। মমতা ব্যানার্জী আসেননি, তিস্তা চুক্তি হয়নি সে সময়ে। আর মমতার সঙ্গে আমার আলোচিত বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১১এর নভেম্বরের ১৬ তারিখে। অর্থাৎ ২ মাস ১০ দিন পর! সে বৈঠকে যদি তাঁর সঙ্গে আমার সত্যি সত্যি কথিত ‘কথা কাটাকাটি’ হয়েও থাকে তাহলেও তার ফলে নিশ্চয়ই ২ মাস ১০ দিন আগে তিস্তা চুক্তি ‘বিশবাও’ জলে পড়তে পাড়ে না!
আর সে বৈঠকে কথা কাটাকাটি কেন, কোনো অসৌজন্যমূলক কথা কোনো দিক থেকেই হয়নি। হবেই বা কেন? একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে পার্শ্ববর্তী বিরাট দেশটির একেবারে লাগোয়া রাজ্যের নবনির্বাচিত প্রথম নারী মূখ্যমন্ত্রীর এটি ছিল প্রথম বৈঠক। রাষ্ট্রের কাঠামোর ব্যাকরণ অনুসারে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান সমান্তরাল না হলেও, অভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির গভীর বন্ধনের কারণে শুধু কবিতা ও গানেই ‘দুই বাংলার’ নৈকট্য প্রকাশ পায় না, মনস্তাত্ত্বিকভাবেও আমাদের নিকট সম্পর্ক রয়েছে। এ সম্পর্কের বন্ধন আরও সুদৃঢ় হয়েছে ’৭১-এ যে বন্ধুত্ব, সহযোগিতা আর সহমর্মিতা পেয়েছে বাংলাদেশের মানুষ পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছ থেকে, তার মাধ্যমে।
দু’জনের এর আগেও দেখা হয়েছে। কথা হয়েছে। দু’জনেই বাঙালি। দু’জনেই সংস্কৃতমনা। দু’জনেরই রয়েছে পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। বৈঠকটি বেশ আন্তরিক ছিল। আমরা সব বিষয়েই কথা বলেছি। মাননীয় মূখ্যমন্ত্রী যথযথভাবে ও আন্তরিকতায় আপ্যায়নও করেছেন। সেখানে উপস্থিত ছিলাম আমরা সর্বসাকুল্যে ছ’জন। আমি, আমাদের হাইকমিশনার ও ডেপু্টি হাইকমিশনার এবং মমতা ব্যানার্জী, মুকুল রায় ও পশ্চিমবঙ্গের চিফ সেক্রেটারি। পরে শুনেছি, কোনো একজন সাংবাদিক নাকি দাবি করেছেন, তিনি ঐ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন!
তিস্তা চুক্তি ২০১১এর সেপ্টেম্বরে হয়নি কেন সবাই জানেন। সে দোষ আমার ঘাড়ে চাপাবার ব্যর্থ চেষ্টা করেন যারা তারা একই সঙ্গে এবং একই কারণে ভুলে যান উল্লেখ করতে যে, তিস্তা চুক্তির বিষয়টি দ্বিপাক্ষিক আলোচ্যসূচির অনেক নিচে থেকে একেবারে উপরে টেনে এনে চুক্তিটি স্বাক্ষরের জায়গায় নিয়ে আসবার কাজটি কিন্তু হয়েছিল এই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সময়েই। আর সেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে দেশ ও জনগণের স্বার্থে নিরলস কাজ করে গেছেন ৪৫ দিন কম ৫ বছরের প্রতিটি দিন। কোনো প্রশংসা পাবার আশায় নয়।
বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে সততা, নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব যথাযথ পালন ও দেশের স্বার্থ সুরক্ষাই ছিল তার পরম পাওয়া।
ডা. দীপু মণি এমপি: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী; পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি।
সূত্র: বিডিনিউজ২৪
——————————————-
সমকালীন রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ডা. দীপু মনি’ লেখাটি পড়তে ক্লিক করুন