বিএনপিসহ সব দল নির্বাচনে আসবে ধরে নিয়ে এগোচ্ছে আওয়ামী লীগ, এ জন্য ভোটের আগে ঘরের বিরোধ মেটানোর পদক্ষেপ। আর পরিস্থিতি বুঝে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করা না করার প্রশ্নে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে বিএনপি, এর আগে ঘর গুছিয়ে নির্বাচন ও আন্দোলন উভয় প্রস্তুতিই এগিয়ে রাখতে চায় দলটি
একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দলের কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত, কোন্দল আর বিরোধ মেটানোর উদ্যোগ নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে ছোটখাটো বিরোধ মিটিয়ে দেশব্যাপী দলকে চাঙ্গা করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকারের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন- আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে—এমনটি ধরে নিয়েই প্রস্তুতি নিতে চায় দল। সব দলের অংশগ্রহণে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতির উদ্দেশে আগে নিজেদের গৃহবিবাদ মিটিয়ে সংগঠনকে গোছানো জরুরি। আর বিএনপি নেতারা জানালেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে দল অংশ নেবে কি নেবে না-সেটি চূড়ান্ত পর্যায়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব নির্ধারণ করবে। তবে এর আগে নির্বাচন ও আন্দোলনের জন্য দুই ধরনের পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকার লক্ষ্যে সারাদেশে দলকে জাগিয়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মাঠ পর্যায়ে বিরাজমান কোন্দল-দ্বন্দ্ব নিরসনের একগুচ্ছ পরিকল্পনা ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন শুরু করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। জেলায় জেলায় দলে বড় ধরনের শুদ্ধি অভিযান এবং তৃণমূলের ভেতরের দ্বন্দ্ব-বিরোধ মেটাতে রবিবার বিরোধপূর্ণ জেলার নেতা ও এমপিদের সঙ্গে ঢাকায় ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করেছে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ওই দিন চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়ার নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। সোমবার বৈঠক করেছেন যশোরের নেতাদের সঙ্গে। বৈঠকে জেলার নেতারা বিরোধ ভুলে এক হয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার বসেছেন সাতক্ষীরা জেলার নেতাদের নিয়ে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার নীলফামারী জেলার নেতাদের ঢাকায় ডাকা হয়েছে। এছাড়াও আওয়ামী লীগ সমর্থিত দুই পেশাজীবী সংগঠন আইনজীবী এবং সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসনে বৈঠকের সূচী চূড়ান্ত করেছে দলটি। আজ বুধবার বিকালে সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে এবং ৩০ এপ্রিল আইনজীবী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা।
গত ২২ এপ্রিল চট্টগ্রামে দলীয় এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, যেসব নেতা দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন-আগামী নির্বাচনে তাদের মনোনয়ন দেওয়া হবে না। তিনি এ-ও বলেছেন, দলের কিছু লোক আছে যারা আওয়ামী লীগ করে, আবার নৌকার বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ করে। যারা নৌকার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, দলের প্রতি তাদের আনুগত্য নেই। যারা দলে থেকেও দলের পিঠে ছুরি মারে তারা বিশ্বাসঘাতক। আর যারা বিদ্রোহে উস্কানি দেয় তারা আরও খারাপ।
দ্বন্দ্ব মেটাতে বিএনপির ৫১ টিম
এদিকে, ক্ষমতার বাইরে থাকায় বিএনপিতে স্বার্থ দ্বন্দ্ব-সংঘাত কম। তবে এত লম্বা সময় সরকারের বাইরে থাকার অভিজ্ঞতা না থাকায় দেশব্যাপী সাংগঠনিকভাবে অনেকটা অগোছালো হয়ে পড়েছে দলটি। ঝিমিয়ে থাকা দলকে জাগিয়ে তুলতে সম্প্রতি বেগম জিয়ার নির্দেশনায় ৫১ নেতার নেতৃত্বে পৃথক ৫১টি টিম গঠন করা হয়। এসব টিম সারাদেশে কর্মীসভা ও দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদারে নির্দেশনা দেবেন বলে জানিয়েছেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। পাশাপাশি সারাদেশে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে উঠান বৈঠকের কর্মসূচিও হাতে নিয়েছে বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, কেউ কেউ বলেন-অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নাকি বিএনপিকে আগামীতে শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচনে যেতে হবে। তাদেরকে বলতে চাই-বিএনপি এমন দল নয় যে, নিবন্ধন রক্ষার জন্য নির্বাচনে যেতে হবে। বিএনপি এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। তিনি বলেন, আমরা এখন নির্বাচন ও আন্দোলন-দুটোর জন্যই প্রস্তুতি নিচ্ছি। আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করে সরকারকে নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে বাধ্য করা হবে। সেজন্য আমরা দলকে গুছিয়ে আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছি।
জেলায়-জেলায় গৃহবিবাদ আওয়ামী লীগে
আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত থামছেই না। কিছুদিন পরপর কোথাও না কোথাও নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়াচ্ছেন নেতা-কর্মীরা। সর্বশেষ রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়িয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগ নেতারা। মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী ছায়েদুল হকের সঙ্গে জেলা সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর দ্বন্দ্ব রবিবার সংঘাতে রূপ নেয়। দলের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র বলছে, দলের ভেতরে আধিপত্য বিস্তারের কোন্দল এত গভীরে চলে গেছে যে, সংঘাত থামানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
গত এক সপ্তাহে কুমিল্লার মুরাদনগরে এবং নরসিংদীর রায়পুরায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে তিনজনের প্রাণ গেছে। এই সময়ে চট্টগ্রাম শহরে সুইমিংপুল নির্মাণ বন্ধের দাবিতে আন্দোলনে থাকা ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। যা ছিল চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছিরের মধ্যে চলে আসা দীর্ঘদিনের বিরোধের ফল।
কুমিল্লা উত্তর জেলা সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম সরকার ও ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুনের মধ্যে দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্য। কুমিল্লা মহানগরে দলের এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও প্রবীণ নেতা আফজল খান পরিবারের দ্বন্দ্ব বহু পুরনো। যার সর্বশেষ রূপ দেখা গেছে সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও। নরসিংদীতে জেলা সভাপতি নজরুল ইসলাম (হিরু) ও সাধারণ সম্পাদক মতিন ভূঁইয়ার সঙ্গে সাবেক মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদের (রাজু) সমর্থক অনেকদিন ধরে বিপরীতমুখী অবস্থানে। অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে পুনরায় আওয়ামী লীগের শিল্পবিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে আবদুস সাত্তার সম্প্রতি নিজ নির্বাচনী এলাকা ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যেতে পারেননি। টাঙ্গাইলে সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান খুনের মামলায় কারাগারে, পরিবারের সদস্যরা পলাতক। এরপরও তাদের সঙ্গে কোন্দলের কারণে ঘাটাইল উপজেলার সম্মেলন তিনবার পেছানো হয়েছে।
দলের বিরোধের বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, আওয়ামী লীগ একটি বড় রাজনৈতিক দল। সে হিসেবে এখানে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু স্থানে যে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত। একথাও সত্য কয়েকজন সংসদ সদস্যের কর্মকাণ্ডে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, বিরোধ নিরসনে দল কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে বিরোধপূর্ণ জেলাগুলোর নেতাদের ঢাকায় ডেকে কথা বলা হচ্ছে।
নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময়১০:০০ এ.এম, ২৬ এপ্রিল ২০১৭,বুধবার
ইব্রাহীম জুয়েল
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur