একে একে কেটে গেছে ১৫ বছর। এর মধ্যে পদ্মার পানি গড়িয়েছে অনেক দূর। কিন্তু তিনি হতাশ হননি। অপেক্ষায় থেকেছেন বছরের পর বছর। আশায় বুক বেঁধেছেন। বিশ্বাস করেছেন- একদিন তিনি সুবিচার পাবেন। বিসিএস ক্যাডার হবেন। দেশের সেবা করবেন।
এই দীর্ঘ সময়ে ঘুরেছেন আদালতের বারান্দায়। নিজের পক্ষে রায় নিয়ে বার বার ছুটে গেছেন পিএসসিতে। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয়েছে, রিভিউ হয়েছে।
অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে তার। সেই রায়ও তার পক্ষেই গেছে। সর্বশেষ রিভিউ পিটিশনের রায়ের নির্দেশনা মোতাবেক আগামী ২রা জানুয়ারি পিএসসি তাকে ডেকেছে মৌখিক পরীক্ষার জন্য।
আশাবাদী এই মানুষটির নাম আশরাফুল ইসলাম। তার বয়স এখন ৪৩ এর কোঠায়। তিনি ১৯৯৪-৯৫ সালে ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে। ১৯৯৯ সালে কৃতিত্বে সঙ্গে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
আশরাফুল ইসলাম (দিপু) ২০০২ সালে অনুষ্ঠিত ২৪তম বিসিএসে প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। যার রেজিস্ট্রেশন নং- ৪৭৯১৯। প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০০৩ সালে অংশ নেন লিখিত পরীক্ষায়। এ পরীক্ষায়ও তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। পরে চূড়ান্ত বাছাইয়ের জন্য ওই বছরের ৮ই আগস্ট মৌখিক পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ হয়।
আশরাফুল ইসলাম একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে নির্ধারিত কোটার বিপরীতে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। তিনি জানান, ২০০১ সালে নেয়া তার পিতার মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটে তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সিল-স্বাক্ষর ছিল।
তখনো মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন হয়নি। পরে এ সংক্রান্ত মন্ত্রণালয় গঠন করা হলে সেখান থেকে সার্টিফিকেট নিতে হতো। কিন্তু সময়ের স্বল্পতার কারণে ওই সময় মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে সার্টিফিকেট নেয়া সম্ভব হয়নি। তার কাছে থাকা পূর্বের সার্টিফিকেট নিয়েই তিনি মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে যান।
ওই সময় বোর্ডে থাকা সদস্যরা তার সার্টিফিকেটটি নাকচ করে দেয়া। হতাশ হয়ে ফিরে আসেন তিনি। বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। হতাশায় ডুবে যান। পরে একপর্যায়ে ২০১১ সালে তিনি আইনজীবীর পরামর্শে মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ না করায় হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করেন।
যার নং- ৩২৭৭/২০১১। এর প্রেক্ষিতে ওই বছরের ২রা জুন হাইকোর্ট তার পক্ষে রায় দেন। আদালত রায় প্রকাশের দিন থেকে ৩০ দিনের মধ্যে মৌখিক পরীক্ষা নেয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা না নিলে তিনি ২৮শে জুন মৌখিক পরীক্ষা দেয়ার জন্য আদলতের আদেশের অনুলিপিসহ পিএসসিতে আবেদন পত্র জমা দেন। নিয়মিত পিএসসি’তে যোগাযোগ রাখেন। পরে জানতে পারেন তার মৌখিক পরীক্ষা নেয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
৩০ দিন অতিক্রান্ত হলেও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে না পেরে তিনি সংশয়ে পড়ে যান। পিএসসিতে কর্মরত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জানান, তার মৌখিক পরীক্ষা নেয়ার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়ে একটি পত্র দেয়া হয়েছে।
তারা ওই মতামতের অপেক্ষায় রয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের মতামত পেলেই তারা আদালতের নির্দেশ মোতাবেক পরীক্ষা নেবেন। আশরাফুল ইসলাম জানান, অপেক্ষার এ অবস্থায় ২০১২ সালের ১লা মার্চ তার কাছে হাইকোর্ট থেকে একটি নোটিশ আসে।
তিনি জানতে পারেন হাইকোর্টের পূর্বের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে একটি রিভিউ পিটিশন দায়ের করেছে পিএসসি। যার রিভিউ পিটশন নং-২১/২০১১। এ রিভিউ পিটিশন শুনানি শেষে গত বছরের নভেম্বরে হাইকোর্ট আবারো তার পক্ষে রায় দেন। তাতে ৩০ দিনের মধ্যে মৌখিক পরীক্ষা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। একই সঙ্গে আদালত মৌখিক পরীক্ষায় ক্যাডারের জন্য বিবেচিত না হলে নন-ক্যাডারে যোগ্য বিবেচনা করতে আদেশ দেন। কিন্তু এরপরও পিএসসি পরীক্ষা নেয়ার কোন ব্যবস্থা করেনি। পরে আশরাফুল ইসলাম পিএসসিতে আদালতের রায়ের কপিসহ চলতি বছরের ২৩শে ফেব্রুয়ারী আবেদন করেন। পরে এই মাসে মৌখিক পরীক্ষার কার্ড ইস্যু করার জন্য পিএসসি থেকে তার ডাক পড়ে। তিনি উপস্থিত হয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেন।
গতকাল তার আবারো ডাক পড়ে। এদিন তার কাঙ্ক্ষিত মৌখিক পরীক্ষার কার্ড হাতে দেয়া হয়। আসছে বছরের ২রা জানুয়ারি মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে তার।
এদিকে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন সচিবালয় থেকে গত ১৮ তারিখে দেয়া এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘মহামান্য আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে ২৪তম বিসিএস পরীক্ষা-২০০২ এর লিখিত পরীক্ষায় বিসিএস-এর সাধারণ ও কারিগরি/পেশাগত ক্যাডারে উত্তীর্ণ ৪৭৯১৯ রেজিস্ট্রেশন নম্বরধারী আশরাফুল ইসলাম এর মৌখিক পরীক্ষা আগামী ২রা জানুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টায় আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ কর্ম কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে।
গতকাল মৌখিক পরীক্ষার কার্ড হাতে পাওয়ার পর আশরাফুল ইসলাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে (আশরাফ দিপু) লেখেন, ‘এ এক অন্যরকম অনুভূতি, আমার জীবনে এক বিশেষ দিন। দীর্ঘ ১৫ বছর পর আজ বিসিএস ভাইভা পরীক্ষার কার্ড পেলাম। ২৪তম বিসিএস পরীক্ষায় আবেদন করেছিলাম ২০০১ সালে।
প্রিলিমিনারি এবং লিখিত পরীক্ষায় পাস করেও তখন ভাইভা পরীক্ষা দিতে পারিনি। এরপর আইনি লড়াইয়ে কেটে গেছে ১৫ টা বছর। ফিরে এসেছে সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। আগামী ২রা জানুয়ারি, ২০১৭ তারিখে আমার ভাইভা পরীক্ষা নেবে পিএসসি।
এত দীর্ঘ সময় পর দেশে কিংবা বিদেশে আর কারো ভাইভা পরীক্ষা দেয়ার এমন নজির আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে এটা ঠিক যে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় বর্তমান না থাকলে এ লড়াইয়ে জেতা সম্ভব ছিল না। ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ধন্যবাদ মহামান্য হাইকোর্ট এবং সর্বোপরি পিএসসিকে এতদিন পরে হলেও আমাকে ভাইভা পরীক্ষায় আমন্ত্রণ জানানোর জন্য।
আমি গর্ব করে বলি, আমার পিতা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।’ তার এ এই পোস্টটি ইতিমধ্যে বেশবার শেয়ার হয়েছে। অনেকে আগাম অভিনন্দন জানিয়েছেন। বিস্ময় প্রকাশ করলেও এই উদ্যোগের জন্য পিএসসিকে ধন্যবাদও জানিয়েছেন কেউ কেউ।
এই প্রতিবেদককে আশরাফুল ইসলাম দিপু আবেগ-আপ্লুত হয়ে বলেন, ১৫ বছর ধরে অপেক্ষায় ছিলাম। দেশের জন্য ভালো কিছু করার স্বপ্ন ছিলো। বিলম্বে হলেও কিছু করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। জীবনের বাকি সময়টুকু দেশের কাজে নিয়োজিত থাকতে চাই। বলেন, হতাশার মধ্যে দিন যাচ্ছিলো।
এই হতাশা থেকে অনেকে বিপথে চলে যান। কিন্তু শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে নিজেকে স্বাভাবিকভাবে ধরে রাখতে পেরেছি। আশরাফুল ইসলামের বাড়ি ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের পাশে হামদহ এলাকায়। তিনি বর্তমান টিভি নাটক লেখেন এবং তা পরিচালনা করেন।
বিশেষ সংবাদ ।। আপডটে, বাংলাদশে সময় ০৭ : ৩৫ পিএম, ২২ ডিসেম্বর ২০১৬ বৃহস্পতিবার
এইউ