বুধবার (৬ সেপ্টেম্বর) সুরের জগতে কিংবদন্তী সুরস¤্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র ৪৬ তম মৃত্যুবার্ষিকী। নীরবেই কেটে গেলো আরো একটি বছর। রাষ্ট্রীয়ভাবে তো দূরের কথা তাঁর নিজ জন্মভ’মি শিবপুরেও তাঁর স্মরণে নেই কোনো আয়োজন।
অথচ আমরা বাংলাদেশিরা দু’টি কারণে সুরস¤্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’কে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করার কথা ছিলো। এর প্রথম কারণটি হলো এই বাংলাদেশের এক অজপাড়া গ্রামে জন্ম নিয়ে নিজের অসামান্য ত্যাগ আর মেধা দিয়ে সুরের জগতে নিজেকে যেমন খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে গেছেন, তেমনি এদেশের নাম ও মান মর্যাদা বিশ্বের দরবারে উজ্জ¦ল করেছেন।
দ্বিতীয়ত কারণটি হলো এদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর শিষ্য ও সন্তান যে অসামান্য অবদান রেখেছেন।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এ পরিবারটির অসামান্য অবদান রয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য আলাউদ্দিন খাঁর মেয়ের জামাই প-িত রবি সংকর, আলী আকবর খাঁ তাদেও মার্কিন বন্ধু খ্যাতিমান শিল্পী জর্জ হ্যারিসনকে নিয়ে আমেরিকার নিউইয়র্ক ম্যাডিসন স্কয়ারে আয়োজন করেন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। কনসার্টে প্রাপ্ত সমগ্র অর্থ যুদ্ধ বিদ্ধস্ত বাংলাদেশের সাহায্যার্থে পাঠানো হয়েছিল। এজন্য বাংলাদেশের মানুষ পরিবারটিকে বিশেষ ভাবে মনে রাখার কথা ছিলো।
সুরের জগতে স্বর্ণাক্ষরে লিখা একটি নাম সুর স¤্রাট ‘ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’। সর্বপ্রথম যিনি উপমহাদেশের রাগ সংগীতকে বিশ্বের দরবারে পরিচিতি লাভ করিয়েছেন। ১৮৬২ সালে তৎকালীন কুমিল্লা (বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়ীয়া) জেলার তিতাস নদী বিধৌত নবীনগর উপজেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম শিবপুরে জন্মগ্রহণ করেন এই মহান সুর স্রষ্টা।
পিতা সবদর হোসেন খাঁ এবং মাতা সুন্দরী বেগমের পাঁচ সন্তানের মধ্যে আলাউদ্দিন তৃতীয়। পিতা আদর করে ডাকতেন আলম। বাল্যকাল থেকেই সঙ্গীতের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ জন্মে তাঁর। বড়ভাই সাধাক ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁর কাছেই সঙ্গীতের হাতে খড়ি তাঁর।
এই সুর পাগল একদিন পাড়ি জমালেন কোলকাতার উদ্দেশ্যে। সেখানে বিখ্যাত সঙ্গীত সাধক নুলো গোপালের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর কাছে ৭ বছর ধরে সংগীত তালিমের এক পর্যায়ে প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় এই সঙ্গীত গুরুর। তাই মনের দুঃখে কণ্ঠ সাধনা ছেড়ে যন্ত্র সঙ্গীতে তালিম নিতে শুরু করলেন তিনি।
হাবু দত্তের কাছে শিখলেন ক্ল্যারিওনেট, সেতার, সানাই, বেহালা; নন্দ বাবুর কাছে মৃদঙ্গ ও তবলা; বেহালা বাজানো শিখেন গোয়ানিজ ব্যান্ড মাস্টার ইংরেজ লোবো সাহেবের কাছে পাশ্চাত্য রীতিতে এবং অমর দাশের কাছে শিখলেন দেশীয় পদ্ধতিতে; হাজারী ওস্তাদের কাছে সানাই, নাকড়া ও টিকারা; লোবো সাহেবের শিষ্যের কাছে কর্ণেট শিখে সর্ববাদ্য বিশারদ হয়ে উঠলেন।
পরে তিনি উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সরোদ বাদক আহমেদ আলী খাঁ’র শিষ্যত্ব গ্রহণ করে রাগ সঙ্গীতে তালিম নেন। তারপর রামপুর নবাবের সঙ্গীতজ্ঞ তানসেন বংশীয় বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ ওয়াজির খাঁর কাছে সঙ্গীত শিক্ষার বাসনায় ওস্তাদের সেবা ব্রত হন। সেবা যতেœর মাধ্যমে ওস্তাদকে তুষ্ট করে সুদীর্ঘ ৩০ বছরের কঠোর সাধনায় তাঁর কাছ থেকে ধ্রুপদ শৈলীর কলাকৌশল শিখে সঙ্গীতের অপূর্ণ ভান্ডার পূর্ণ করেন। ওস্তাদ ওয়াজির খাঁ’কে সঙ্গীত সাধনায় তুষ্ট করে অতঃপর তাঁর কাছ থেকে কর্মজীবনের অনুমতি নিলেন আলাউদ্দিন।
রামপুর অবস্থান কালে ১৯১৮ সালে মাইহারের রাজা রামপুরের নবাবের কাছে আলাউদ্দিন খাঁ-কে চেয়ে অনুরোধ পাঠালেন। পরে ওস্তাদ ওয়াজির খাঁ’র অনুমতি নিয়ে আলাউদ্দিনকে মাইহারে পাঠালেন রামপুরের নবাব।
রাজা আলাউদ্দিনকে সভা সঙ্গীতজ্ঞ পদে অধিষ্ঠিত করলেন এবং তাঁর জন্যে একটি মনোরম ভবন নির্মান করে দিলেন। আলাউদ্দিন তাঁর সহধর্মিনী মদিনা বিবির নামে এর নামকরণ করেন ‘মদিনা ভবন’।
তারপর থেকে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ মাইহারের রাজার শিক্ষাগুরু হয়ে আমৃত্যু তিনি মাইহারেই কাটিয়েছেন। এক পর্যায়ে স্ত্রী মদিনা বিবিকেও বাংলাদেশের শিবপুর থেকে মাইহারে নিয়েযান।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ১৯৩৪-৩৫ সালে উপমহাদেশের প্রখ্যাত নৃত্য শিল্পী উদয় সংকরের নাচের দলের সাথে বিশ্ব ভ্রমণে বের হন। অগাধ পা-িত্য ও বাদন নৈপুন্য দ্বারা বিদেশী শ্রোতাদের মুগ্ধ ও বিস্মিত করেন তিনি। এভাবেই তিনি নিজেকে এবং ভারতীয় রাগ সঙ্গীতকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করে তোলেন।
ভিয়েনা, প্যারিস, প্রাগ, বোদাপেস্ট প্রভৃতি শহরে অনুষ্ঠান শেষে নামজাদা ইউরোপীয় শিল্পী ও সমঝদারগণ আলাউদ্দিন খাঁ’র বাদন ও কণ্ঠের শৈলীতে মুগ্ধ হন। তাঁর মুখে উপমহাদেশীয় রাগ সঙ্গীত কোন কম্পোজ ছাড়াই শুধু ইম্প্রুভাইজেশন আর আপ্রাণ সাধনার মাধ্যমেই রাগ-রাগিনী’র প্রকাশের কথা শুনে বিস্মিত হন।
গুরু ওয়াজির খাঁ’র আশীর্বাদপুষ্ট যোগ্য শিষ্য আলাউদ্দিন খাঁ’র ভূমিকা ক্রমেই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। শুধু দেশেই নয় তিঁনি তানসেনের ঘরানার সুরের বীণাকে সঙ্গীতের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। গানের আসরগুলোতে তাঁর উপস্থিতি শুধু আনন্দই দিতো না, বিশিষ্টের মর্যাদাও এনে দিতো।
কালজয়ী এই সঙ্গীত সাধকের স্পর্শে সারা বিশ্বে বিশেষ করে এ উপমহাদেশের অনেকেই আজ স্বনামধণ্য। তাঁর পুত্র আলী আকবর খাঁ (জন্ম: ১৯২২-মৃত্যু: ১৯ জুন ২০০৯) সরোদে কিংবদন্তী খ্যাতি লাভ করেন। আলাউদ্দিন খাঁর কণ্যা রওশন আরা অন্নপূর্ণা দেবী সুরবাহারের বিখ্যাত শিল্পী, মেয়ের জামাতা প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ বিখ্যাত সেতার শিল্পী প-িত রবি শংকর, সরোদ শিল্পী শ্যামল গাঙ্গুলী, পান্না লাল ঘোষ, ফুলঝুঁরি খাঁন, ইসরাফিল খাঁ, নিখিল বন্দোপাধ্যায় এবং সরোদ শিল্পী ভ্রাতুষপুত্র বাহাদুর হোসেন খাঁ, খাদেম হোসেন খাঁ ও আবেদ হোসেন খাঁ প্রমুখ আলাউদ্দিনের ¯েœহধন্য হয়ে সুরের ভুবনে দীপ্তিমান।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে ১৯৫২ সালে বিশ্বভারতীতে আসেন এবং দীনেন্দ্র অধ্যাপক হিসেবে ২ মাস শান্তি নিকেতনে ছিলেন। বৃটিশ সরকার প্রতিভার মূল্যায়ন স্বরূপ আলাউদ্দিনকে ‘খাঁ’ সাহেব উপাধিতে ভ’ষিত করেন। তিনি ১৯৫২ সালে ভারতের সঙ্গীত নাটক একাডেমীর শ্রেষ্ঠ পুরষ্কারে ভূষিত হন। ১৯৫৩ সালে কোলকাতা’র ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন হলে তাকে সংবর্ধ্বনা জ্ঞাপন করা হয়। ১৯৫৪ সালে দিল্লী নাটক একাডেমীর ফেলো নির্বাচিত হন তিনি। একই বছর ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় এবং বারতের দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মান সূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেন।
১৯৫৮ সালে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় খেতাব ‘পদ্মভূষণ’ এবং ১৯৭১ সাথে ‘পদ্মবিভূষণ’ সম্মাননা লাভ করেন। ১৯৬১ সালে বিশ্বভারতী তাকে ‘দেশীকোত্তম’ সম্মানে ভূষিত করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম সলিমুল্লাহ হল তাঁকে আজীবন সদস্যপদ প্রদান করে। যতদূর জানাযায়, ইউরোপ সফরের সময় আলাউদ্দিন খাঁ সুর স¤্রাট উপাধি লাভ করেন।
শুধু আলাউদ্দিন খাঁ নিজেই সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন তা‘নয়, তাঁর পিতা সবদর হোসেন খাঁ-ও ছিলেন একজন সেতার শিল্পী। তিনি ছিলেন আগরতলা রাজদরবারের সভা বাদক ওস্তাদ কাশেম আলী খাঁ’র শিষ্য। আলাউদ্দিনের কনিষ্ঠ ভাই বিশিষ্ট যন্ত্র সঙ্গীত শিল্পী ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ। তিঁনি ছেলেন সুরবাহার বিশেষজ্ঞ। তিঁনি ১৯৫৩ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে শান্তি নিকেতনে বিশ্বভারতীর যন্ত্র সঙ্গীত বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগদান করেন।
পরে কুমিল্লায় যন্ত্রসঙ্গীত কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাগ সঙ্গীতের প্রসার ঘটান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ফিরে বাদ্যযন্ত্রের উপর গবেষণার জন্য একটি কারখান চালু করেন। ‘সুর স¤্রাট দি আলাউদ্দিন মিউজিক্যাল কলেজ’ (বর্তমানে যা সুর স¤্রাট আলাউদ্দিন খাঁ সাঙ্গীতাঙ্গন) প্রতিষ্ঠা করেন আয়েত আলী খাঁ।
পরবর্তীতে (সম্ভবত: ১৯৭৬ সালের দিকে) শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন নতুন করে উদ্বোধন করেন। সুরবাহার, সরোদ যন্ত্রের আধুনিকায়ন এবং মনোহারা, মন্দ্রনাথ বাদ্যযন্ত্রের উদ্ভাবন তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান। আয়েত আলী খাঁ ১৯৬০ সালে ‘গভর্ণর পদকে’ ভূষিত হন।
১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার কতৃক ‘তম-ঘা-ই-ইমতিয়াজ’ উপাধি; ১৯৬৬ সালে রষ্ট্রীয় পুরষ্কার ‘প্রাইড-অব-পারফরমেন্স’ লাভ করেন। এছাড়া বাংলাদেশেও একুশে ও স্বাধীনতা পদক লাভ করেন তিনি।
বিশিষ্ট সরোদ শিল্পী আফজালুর রহমান তাঁরই কৃতি ছাত্র এবং তাঁর ছেলে বাহাদুর হোসেন খাঁ সরোদে খ্যাতি অর্জন করেন। অপর ছেলে মোবারক হোসেন খান, সেখসাদী খান, নাদি শাহাদাৎ হোসেন খান বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় খেতাব একুশে পদক লাভ করেন। মোবারক হোসেন খান স্বাধীণতা পদকও লাভ করেন।
বড় ভাই সাধক ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁ ছিলেন ‘মলয়া’ গানের স্রষ্টা বিশিষ্ট ব্রহ্ম সাধক কবি মহর্ষি মনমোহন দত্তের একমাত্র যোগ্য সমঝদার।
এই আফতাব উদ্দিনই সুর স¤্রাট এবং তাঁর ছোট ভাই আয়েত আলী খাঁ’র প্রথম সঙ্গীত গুরু। আফতাব উদ্দিন খাঁ হেন বাদ্যযন্ত্র নেই যা তিনি বাজাতে পারতেন না। তৎকালীন সময়ে অবিভক্ত বাংলায় তাঁর মতো বংঁশী বাদক আর কেউ ছিলনা বলে জানাযায়।
তিনি একসাথে তিনটি বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন। আগরতলার মহারাজ বীর বিক্রম মানিক্য রায়বাহাদুর ও ভবানীপুরের মহারাজা জগনীন্দ্র নাথকে বাদ্যযন্ত্রের সুরে বিস্মিত করেন। তিনি ছিলেন ধ্যানী পুরুষ। তাই তাঁকে ডাকা হতো ফকির আফতাব উদ্দিন।
তিনি মনমোহন দত্তের ‘মলয়া’ সঙ্গীতের সুরকার। স্বরগ্রহ, মেঘডম্বুর দু’টি বাদ্যযন্ত্র ছিল তাঁর অন্যতম আবিষ্কার।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’ও দ্বিতীয় পুত্র ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ’ও বিশ্ববিখ্যাত সরোদ শিল্পী এবং সঙ্গীতজ্ঞ। তিনি ১৯৫৫ সালে এক আমন্ত্রণে আমেরিকা সফরের পর থেকে সারা বিশ্ব চষে বেড়িয়েছেন।
তিনি শিল্পী, শিক্ষক এবং উপমহাদেশের সঙ্গীত ও সংস্কৃতির দূত হিসেবে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি মহাদেশ ভ্রমণ করে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকো শহরে ‘আলী আকবর কলেজ অব মিউজিক’ এর প্রতিষ্ঠাতা।
পৃথিবীর সঙ্গীজ্ঞদের মধ্যে তিনিই প্রথম আমেরিকার ‘ম্যাকার্বিগ্রান্ট’ লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে আমেরিকার সর্বোচ্চ খেতাব ‘হেরিটেজ এওয়ার্ড’ লাভ করেন। ১৯৬৩ এবং ১৯৬৬ সালে ভারতীয় শ্রেষ্ঠ সম্মাননা ‘রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার’ এবং ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি পান।
তিনি এবং তাঁর বোন রওশন আরা অন্নপূর্ণা দেবী ভারত সঙ্গীত নাটক একাডেমীর এওয়ার্ড এবং এর ফেলো হিসেবে সম্মানিত হন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভারতের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট অব লিটারেচার উপাধি প্রদান করেন।
তিনি ইউরোপ ও আমেরিকায় ‘দ্য গ্রেট মাইস্টো অব মিউজিক’ হিসেবে পরিচিত। তিনি অসংখ্য মৌলিক সুর সৃষ্টি করেছেন। আলী আকবর খাঁ’র দ্বিতীয় ছেলে হাল আমলে বিখ্যাত সরোদ শিল্পী ওস্তাদ আশীষ খাঁ একজন বিশ্ববিশ্রুত সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে আমেরিকা এবং ইউরোপে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত তালিম দিয়ে যাচ্ছেন। চন্দ্রসার যন্ত্র আবিষ্কার ও সরোদের আধুনিকায়ন তাঁর’ই অবদান।
আলাউদ্দিন খাঁ’র কণ্যা রওশন আরা বেগম অন্নপূর্ণা দেবী সেতার শিল্পী প-িত রবি শংকরের স্ত্রী।
ভারতের বোম্বেতে বসবাসরত এই গুণী শিল্পী নিজস্ব আশ্রমে যুগপৎ সুরবহার, সেতার, সরোদ, বেহালা, বাঁশী, ইত্যাদি তালিম দেন। নিখিল ব্যানার্জি, ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খাঁ, পান্না লাল, খুরশীদ খাঁ, চৌরাশিয়া প্রমুখ তাঁর উল্লেখযোগ্য শিষ্য। ভাগ্নে ইসরাইল খাঁও একজন বাদ্যযন্ত্র তৈরীর ওস্তাদ ও সাঙ্গীতজ্ঞ।
আলাউদ্দিন খাঁ ১৯৭২ সালের ০৬ সেপ্টেম্বর মাইহারে পরলোকগমন করেন, সেখানেই তাকে চীর নিদ্রায় সায়িত করা হয়। মাইহারে অবস্থিত বদিনা ভবন আজও এই কৃতী সাধকের স্মৃতি বহন করছে।
১৯৫৪ সালের এক ঘটনার উল্লেখ করে ১৯৮৬ সালে সাংবাদিক মোহাম্মদ মুসা ‘দৈনিক বাংলা’ লিখেছিলেন- “সুর স¤্রাটের সাধ পূরণ হলোনা” এত বড় বিরাট পুরুষকে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার মাটি ধারণ করতে পারলো না।
শুধু ভারতেই নয় জন্মভূমি বাংলাদেশের শিবপুরেও কিছু বিপন্নপ্রায় স্থাপত্য ও মা-বাবার সমাধি খাঁ পরিবারের স্মৃতি বহন করছে। যেগুলো অযতœ অবহেলায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আলী আকবর খাঁ ১৯৮৯ সালে তৎকালীন সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাবীবুল্লাহ খানের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসে ঢাকাসহ কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় সংবর্ধিত হন।
পরে তিনি জন্মভূমি নবীনগরের শিবপুরে পিতা আলাউদ্দিন খাঁর নিজ হাতে গড়া মসজিদটির জরাজীর্ণ অবস্থা দেখে প্রশাসনের হাতে তৎকালীন সময়ে ৮০ হাজার টাকা দিয়ে এর সংস্কারের জন্য অনুরোধ করে যান। দীর্ঘ এতো সময় পর ব্যাক্তি উদ্যোগে সামান্য সংস্কার করা হয়।
এদিকে ২০১৫ সালে একদল উশৃঙ্খল যুবকের রোষানলের শিকার হয়ে পুড়ে ছাই হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে অবস্থিত সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ সাঙ্গীতাঙ্গন ও আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতি বিজড়িত অনেক বাদ্যযন্ত্র।
এদিকে কুমিল্লা শহর জুড়েও জড়িয়ে আছে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও তার ভাই ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর অনেক স্মৃতি। কুমিল্লায় আলাউদ্দিন খাঁর শেষ ঐতিহাসিক কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিলো টাউন হল মিলনায়তনে।
সেখানে আলাউদ্দিন খাঁকে স্মরণ করার মতো কোন উদ্যোগ নেয়নি কেউ। এমনকি নজরুল ইন্সটিটিউট কেন্দ্রের সামনের রাস্তাটি সুর সম্রাটের নামে এবং কান্দির পাড় থেকে টমছম ব্রীজের রাস্তাটির নাম আয়েত আলী খাঁর নামে, টমছম ব্রীজ কবরস্থানে আয়েত আলী খাঁর সমাধী হলেও হালে এর কোন অস্তিত্ব খোঁজে পাওয়া কঠিন।
চলতি বছর (২০১৮) আলাউদ্দিন খাঁর নাতি আশিষ খাঁ শিবপুরে তাঁর পূর্বপুরুষের পরিত্যক্ত ভিটেমাটি দেখে মনে একবুক কষ্ট নিয়ে ফিরে যান।
আজ ০৬ সেপ্টেম্বর আলাউদ্দিন খাঁ’র ৪৬ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।
(তথ্যসূত্রঃ ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার ইতিবৃত্ত, বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং আলাউদ্দিন খাঁ’র উত্তরসূরীদের দেয়া তথ্য)।
লেখকঃ (সংবাদকর্মী)
জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল,
প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, ঐতিহ্য কুমিল্লা
ইমেইলঃ imrul60@gmail.com
মোবাইলঃ ০১৭১৬৯৬২৪৬০, ০১৯৩৭৯০২১৬০
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur