বাংলাদেশ তৈরি পোশাক শিল্প প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) ভবন ‘বিজিএমইএ কমপ্লেক্স’ ভাঙাসংক্রান্ত আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে অবিলম্বে ওই ভবন নিজ খরচে ভাঙতে বিজিএমইএকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারসংলগ্ন হাতিরঝিলে (বেগুনবাড়ী খালের ওপর) অবস্থিত বিজিএমইএর বহুতল ভবন অবিলম্বে ভাঙতে বিজিএমইএ ব্যর্থ হলে রায়ের কপি পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ভবনটি অপসারণ করবে।
এ জন্য বিজিএমইএর কাছ থেকে খরচ নেবে রাজউক। রায় দ্রুত কার্যকর করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে রাজউককে রায়ের কপি সরবরাহ করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া ওই ভবনের বিষয়ে হাইকোর্ট আর যেসব নির্দেশনা দিয়েছিলেন তাও বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চের দেওয়া ৩৬ পৃষ্ঠার এ রায় গতকাল মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। ওই ভবন রক্ষার জন্য হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার অনুমতি চেয়ে বিজিএমইএর করা আবেদন গত ২ জুন খারিজ করে দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী বিজিএমইএ আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার জন্য রায়ের কপি পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন করতে পারবে। বিজিএমইএ রিভিউ আবেদন না করলে তাদের ভবনটি দ্রুত অপসারণ করতে হবে। বিজিএমইএ রিভিউ আবেদন করবে কি না সে বিষয়ে তাদের আইনজীবীদের কোনো প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের সংবাদ পাওয়ার পর বিজিএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ নাসির সাংবাদিকদের বলেন, ‘রিভিউ আবেদন করা হবে। আইনে রিভিউ আবেদন করার জন্য ৩০ দিনের সুযোগ আছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এটা করা হবে। আদালত যে সিদ্ধান্ত দেবেন সেটা আমাদের মেনে নিতেই হবে।’
তবে এ মামলায় অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে শুনানিতে অংশ নেওয়া অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি পরিবেশবিদ হিসেবে বিজিএমইএকে বলব, অনেক হয়েছে। এখন রায় মেনে নিন। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে নিজেরাই ভবনটি সরিয়ে ফেলুন।
এতে আপনাদের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হবে।’ আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে, দুটি প্রাকৃতিক জলাধার বেগুনবাড়ী খাল ও হাতিরঝিল লেকের ওপর ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। এই জলাধার দুটি থেকে পানি ক্যানেলের মাধ্যমে বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়ে পড়ে। রাজধানীকে জলাবদ্ধতা ও বন্যা থেকে রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এ দুটি জলাধারের।
এ ছাড়া এই দুটি জলাধার ঘিরে সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য সরকার এক হাজার ৪৮০ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে। এ অবস্থায় হাইকোর্টের রায় বাতিল করার বা হস্তক্ষেপ করার যুক্তিসংগত কোনো কারণ দেখাতে পারেনি আবেদনকারীপক্ষ (বিজিএমইএ)।
রায়ে বলা হয়, ভবনটি রক্ষার জন্য আবেদনকারীর আইনজীবীরা বলেছেন যে এ সংগঠনের সঙ্গে ৪৫ লাখ শ্রমিকের স্বার্থ জড়িত। বিজিএমইএর কারণে সারা দেশে চার-পাঁচ কোটি মানুষ উপকৃত হচ্ছে। জিডিপির হার বাড়ানোর জন্য এ সংগঠনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের এ বক্তব্য যুক্তিসংগত হলেও আইন অনুযায়ী জমির মালিকানার যথাযথ কাগজপত্র দেখাতে হবে।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেটা অনুপস্থিত। রায়ে বলা হয়, ভবন নির্মাণ আইন-১৯৯৬ অনুযায়ী রাজউক থেকে নকশা অনুমোদনের জন্য জমির মালিকানার প্রমাণপত্র দাখিল করতে হয়। জমির মালিকানা সঠিক হলে আইন অনুযায়ী রাজউক নকশা অনুমোদন করতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আলোচিত জমিটি রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) কাছ থেকে নিয়েছে বিজিএমইএ। অথচ ইপিবি এই জমির মালিকই নয়।
রায়ে জমির মালিকানাসংক্রান্ত তথ্য বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘ভবনটি দেশের সব আইন লঙ্ঘন করে নির্মাণ করা হয়েছে’ : আদালত রায়ে বলেন, ‘ভবন নির্মাণের জন্য জলাধার আইন-২০০০ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ অনুযায়ী পরিবেশগত ছাড়পত্র নিতে হয়। এখানে সেটা অনুপস্থিত। অবৈধভাবে জমি হস্তান্তরের পর অবৈধভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এ ভবনটি দেশের সব আইন লঙ্ঘন করে নির্মাণ করা হয়েছে—এটা বলতে আমাদের কোনো দ্বিধা নেই।’
হাইকোর্ট ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল ভবনটিকে ‘হাতিরঝিল প্রকল্পে একটি ক্যান্সারের মতো’ উল্লেখ করে রায় প্রকাশের ৯০ দিনের মধ্যে তা ভেঙে ফেলতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছিল।
ওই রায়ের কপি পাওয়ার পর আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল আবেদন করেন বিজিএমইএর সভাপতি। শুনানি শেষে গত ২ জুন আবেদনটি খারিজ করা হয়। রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই বিজিএমইএ ভবন নির্মাণ করা নিয়ে ২০১০ সালের ২ অক্টোবর ইংরেজি দৈনিক ‘নিউ এজ’-এ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।
ওই প্রতিবেদনটি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ডি এইচ এম মনির উদ্দিন আদালতে উপস্থাপন করেন। পরদিন ৩ অক্টোবর বিজিএমইএ ভবন কেন ভাঙার নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে (সুয়োমোটো) রুল জারি করেছিলেন।
ওই রুলের ওপর শুনানি শেষে রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। ১৯৯৮ সালের ২৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিজিএমইএ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।
ভবন নির্মাণ শেষ হলে ২০০৬ সালের ৮ অক্টোবর বিজিএমইএ ভবন উদ্বোধন করেন সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। এরপর থেকে বিজিএমইএ তাদের প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করছে ভবনটি। (কালেরকণ্ঠ)
নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৭:০০ এএম, ৯ নভেম্বর ২০১৬, বুধবার
ডিএইচ