আত্মসচেতনতা মুমিনের একটি গুণ। আত্মসচেতন না হলে প্রকৃত মুমিন হওয়া যায় না। কিছু নারীকে দেখা যায়, তারা আল্লাহর পথে চলতে আগ্রহী, দ্বীন মেনে চলতে চায়, মনটা আল্লাহর দিকে ধাবিত, কিন্তু শুধু অসচেতনতার কারণে অনেক ফরয তরক করছে কিংবা গুনাহে জড়িয়ে পড়ছে।
আমার এক বান্ধবী, যাকে আমি আমার বান্ধবীদের মধ্যে সবচেয়ে পরহেযগার মনে করি। প্রতিকূল পরিবেশেও গায়রে মাহরাম আত্মীয়ের সামনে বেপর্দা হয় না। কখনোই ইচ্ছা করে কোনো বেগানা পুরুষের দিকে তাকায় না। সাদাসিধে জীবন-যাপন করে। এক ওয়াক্ত নামাযও কাযা করে না।
ক’দিন আগে তার বিবাহ হল। হায় আফসোস! বিবাহের সময় আমি তাকে নামায কাযা করতে দেখলাম। বড় কষ্ট পেলাম। যে নাকি এক ওয়াক্ত নামায কাযা করে না, বিবাহের অনুষ্ঠানের ছুতোয় নামায কাযা করে দিল!
অথচ একটু সচেতন হলেই নামায কাযা হওয়া থেকে সে বাঁচতে পারতো। তবে এক্ষেত্রে অভিভাবকদের সহায়তাও একটি বড় বিষয়। কখনো কখনো অন্যদের অসহায়তার কারণে ইচ্ছা থাকা সত্বেও এমন হয়ে যায়। কিন্তু আসল বিষয় হল নিজের অদম্য আগ্রহ।
আমি চাইলে যে কোনো প্রতিকূল পরিবেশকে অনুকূল করতে পারি। বিশেষ করে নামাযের মত গুরুত্বপূর্ণ ফরয আমলের জন্য তো আমাকে তা করতেই হবে।
তেমনি আমরা কোনো কোনো নারীকে দেখি, তিনি পর্দা করেন। কিন্তু বিবাহের সময় পর্দার খেলাফ অনেক কিছুতে জড়িয়ে পড়েন। কণে সেজেগুজে বসে আছে, আর যেই আসছে মোবাইলে তার ছবি তুলে নিয়ে যাচ্ছে। যদিও ছবি তুলছে মহিলা, কিন্তু এ ছবি তো একটু পরেই কোনো পুরুষ দেখবে। ডিজিটাল ক্যামেরার ছবি জায়েয-নাজায়েয- সে ভিন্ন কথা; ছবির ব্যাপারেই বা কেন আমাদের এত অবহেলা!
পর্দানশীন নারীর জন্য এটা বড়ই ক্ষতির কারণ। এক্ষেত্রে আত্মসচেতনতার বিকল্প নেই। আগে আমাকে দ্বীন মানার ক্ষেত্রে মজবুত হতে হবে। নিজে পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে মুরব্বীদের জানাতে হবে, তাদের সহায়তা নিতে হবে। এ সবকিছুর জন্য চাই নিজের প্রবল ইচ্ছা।
আমার এক স্নেহভাজন ভাতিজি। মহিলা মাদরাসায় পড়ে। ছাত্রী অত্যন্ত ভাল।
পরিবারে পূর্ণ পর্দা রক্ষা করা হয়। মেয়েটি একদিন আমাকে ফোনে বলল, আমরা অমুক সময় গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা করছি। আমি বললাম, রাস্তায় নামাযের কী হবে? সে বলল, নামায তো পড়া হবে না; বাড়িতে পৌঁছে ক্বাযা পড়তে হবে। বললাম, সেটা কেমন কথা! কোনোভাবে ব্যবস্থা করতে হবে। তবুও কি নামায কাযা করার কোনো সুযোগ আছে?
এভাবে আমাদের কত নামায কাযা হয়ে যায়। প্রথমত এমন সময় সফর করা উচিত, যাতে নামায কাযা না হয়। একান্ত এমন সময় সফর হলে যথাসাধ্য চেষ্টা করা, নামায যেন কাযা না হয়। পথে নামায পড়া নারীদের জন্য অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে অভিভাবকের সহায়তা থাকলে বিষয়টি অনেক সহজ হয়ে যায়।
দেখা যায় যাদের পিতা বা স্বামী নামাযের ব্যবস্থা করে দেন তারা সফরেও নামায আদায় করে। কিন্তু স্বামী বা পিতা যদি দায়িত্বশীল বা সচেতন না হন তাহলে নারীকে কি নিজে সচেতন হতে হবে না?
ঈমানের পরেই নামাযের স্থান, অথচ কারণে অকারণে আমরা এ বিষয়ে কত অবহেলা করছি! অন্যের কথা আর কী বলব! আমি নিজেই তো এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট অলস। উঠছি উঠছি করে ফজরে দেরি হয়ে যায়। কাজের ছুতোয় যোহর পড়ছি অনেক দেরি করে। আসরের নামায কখনো পড়ছি মাকরূহ ওয়াক্তে। আল্লাহ আমাকে নামাযে অলসতা থেকে রক্ষা করুন।
কুরআনের ঐ আয়াত মনে পড়লে বড় ভয় হয়! আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-فَوَیْلٌ لِّلْمُصَلِّیْن الَّذِیْنَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُوْنَ.
সুতরাং বড় দুঃখ আছে সেই নামাযীদের, যারা তাদের নামাযে গাফলতি করে। (সূরা মাউন ৪-৫)
আর দ্বীনদারির ক্ষেত্রে নারীর আত্মসচেতনতার জন্য সবচেয়ে বড় সহায়ক হল- দ্বীনী ইল্ম। নারী হোক পুরুষ হোক দ্বীনদারির উন্নতির জন্য দ্বীনী ইলমের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্যই তো জ্ঞান অন্বেষণ করা ফরয। কিন্তু আফসোস! আমরা নারীরা এই ফরয জ্ঞান অন্বেষণের ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছি। এ বিষয়ে আমরা খুবই উদাসীন, খুবই গাফেল; সামান্য রিয়াযুস সালেহীন কিতাবটাও আমাদের অনেক নারীর পড়া নেই।
নববী রা. এই কিতাবে মানুষের জীবনের সাথে সম্পৃক্ত আয়াত-হাদীস সংকলন করেছেন। অন্তত এটা সকলেরই পড়া থাকা দরকার।
তবে দোষ শুধু নারীর নয়; পুরুষও এখানে সমানভাবে দায়ী। কারণ আল্লাহ তাআলা নারীকে পুরুষের অধীন করেছেন। নারীর সকল দায়িত্ব পুরুষের উপর ন্যস্ত করেছেন।
তাই নারীকে প্রয়োজন পরিমাণ ইল্ম শেখানো পুরুষের দায়িত্ব। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا قُوْۤا اَنْفُسَكُمْ وَ اَهْلِیْكُمْ نَارً.
হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং নিজেদের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা কর (জাহান্নামের) আগুন হতে…। সূরা তাহরীম (৬৬) : ৬
হাদীস শরীফে এসেছে-
أَلاَ كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ،… وَالرَّجُلُ رَاعٍ عَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ، وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى أَهْلِ بَيْتِ زَوْجِهَا، وَوَلَدِهِ وَهِيَ مَسْئُولَةٌ عَنْهُمْ،… أَلاَ فَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ.
জেনে রেখ, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।… পুরুষ তার পরিবারবর্গের বিষয়ে দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। নারী তার পরিবার, সন্তান-সন্তুতির বিষয়ে দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।…জেনে রেখ, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৭১৩৮)
কিন্তু পুরুষ যদি নারীকে যথাযথ শিক্ষা না দেয় কিংবা শিক্ষার ব্যবস্থা না করে, তবে কি নারী দায়মুক্ত হয়ে যাবে? সে কি নিজে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করবে না? হাঁ, চেষ্টা আমাদেরকে করতেই হবে; কারণ অন্যের দোহায় দিয়ে আমরা পার পাব না। যার যার হিসাব নিজেকেই দিতে হবে। আমি সহীহ পন্থায় চেষ্টা করলে আল্লাহ পথ খুলে দিবেন।
নবীজীর জামানায় নারীরা ইল্ম (জ্ঞান) অর্জন করেছেন। এমন কি তাদের আগ্রহ দেখে নবীজী তাদের জন্য আলাদা একটি দিন ধার্য করেছিলেন; যেদিন নবীজী তাদেরকে সময় দিতেন।
মোটকথা, দ্বীনী ইল্ম (ধর্মীয় জ্ঞান) ছাড়া যেহেতু সচেতন দ্বীনদার হওয়া কঠিন, তাই দ্বীনী ইলম আমাদেরকে অর্জন করতেই হবে। এটি ফরয দায়িত্ব। একে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। আল্লাহ আমাদের দ্বীনী ইলম দান করুন; এজন্য সহীহ পন্থায় চেষ্টা-মেহনত করার তাওফীক দিন।
ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে আল্লাহ আমাদের সবাইকে চলার তাওফিক দান করুক। (মাসিক- আল কাউসার)
ইসলামিক ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ০২:০০ পিএম, ১৬ অক্টোবর ২০১৬, রোববার
ডিএইচ