চাঁদপুরে আলোচিত ১১ নারী হত্যা মামলার ঘটনায় অভিযুক্ত ‘রসু খাঁর ষড়যন্ত্রের’ শিকার তার আপন বড় বোনের ছেলে ভাগিনা জহিরুল ইসলাম জহির ।
জহিরুলের মা হাফছা বেগমের দাবি, ‘জামিনের জন্য টাকা চেয়ে না পাওয়ার কারণে সে ক্ষিপ্ত হয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সাথে যোগসাজশ করে ভাগিনা জহিরুলকে, রসু খাঁর নিজের মামলায় জড়িয়ে দিয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছে।’
তিনি জানান, ‘হত্যা না করেও নিরপরাধ হয়ে তার ছেলে জহিরুল ৭ বছর জেলা কারাগারে কয়াদী হয়ে হাজতবাস করছেন।
পারভিন হত্যার ঘটনার মামলার ১৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১ জন সাক্ষী ভাগিনা জহিরুল জড়িত ছিলো না বলে আদালতে সাক্ষ্য দেন।
বাকী ৩ জন সাক্ষী আদালতে হাজির হয়ে সাক্ষ্য না দেয়ায় মামলাটি ৭ বছর ধরে ঝুলন্ত অবস্থায় আছে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ওইসময়ের ফরিদগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মীর কাশেম থানায় নিয়ে জহিরকে ভয়ভীতি দেখিয়ে হত্যার ঘটনায় সহযোগিতা করেছে স্বীকারুক্তি নিয়ে মামলায় ২য় আসামি করে অভিযুক্ত করে জড়িয়ে দিয়েছে এমন অভিয়োগ উঠেছে।
রসু খাঁ ও উপ-পরিদর্শক (এসআই) মীর কাশেমের রোশানলে পরে বিনাদোষে ৭ বছর যাবৎ জেল খাটছে বলে সাংবাদিকদের কাছে জহিরের মা হাফছা বেগম জানিয়েছেন।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০০৯ সালে ২০ জুলাই বিকেল আনুমানিক ৪টায় চান্দ্রা ইউনিয়নের মদনা গ্রামের আলোচিত তথাকথিত ১১ খুনের অভিযুক্ত রসু খাঁ ৩৫ বছর বয়সী পারভীন নামে এক মহিলাকে টাকার লোভ দেখিয়ে অনৈতিক কাজের প্রস্তাব দেয়।
সে রাজি হওয়ার পর রসু খা পারভীনকে ফরিদগঞ্জ হাসা গ্রামে খালের দিকে নিয়ে নির্জন স্থানে গাছ গাছালির ভেতরে একাধিকবার ধর্ষণ করে। পারভীন তার কাছে ৫ হাজার টাকা চাইলে সে না দেয়ায় পারভীন চিৎকার শুরু করে। এ সময় রসু খাঁ তার গলা ও মুখ চেপে ধরে জলন্ত সিগারেটের আগুন দিয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছেকা দেয়।
পরে তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যার করে ও পরে খালের পাড়ে ফেলে দিয়ে ঐ রাতই ১২টায় নয়ারহাট হয়ে ভাটিয়ালপুর চলে আসে । এরপর রসু খাঁর ব্যবহৃত ০১৮২৪-৬৫৪৫৭৬ নাম্বার থেকে সে ফরিদগঞ্জ থানার এসআই ফারুকে ফোন করে ওসির নাম্বার নেয়। ওই নাম্বার থেকে ওসিকে ফোন করে রসু খাঁ নিজেকে রিক্সা চালক লেবু মিয়া পরিচয় দেয় ও মদনা গ্রামের তরকারী ব্যবসায়ী মালেক মোল্লা ও চরভাগর গ্রামের শফিকুর নামে এ দু’জন একটি মেয়েকে হাসা মাদ্রাসা সংলগ্ন কাচাঁ রাস্তার দিয়ে দক্ষিণ দিকে নিয়ে নির্যাতন করে মেরে রেখেছে বলে সংবাদ দেয়।
এরপর থেকে রসু খাঁর ওই মোবাইল নাম্বারটি বন্ধ করে দেয় ও সে ঢাকা চলে যায়। ২০০৯ সালের ২ আগস্ট রাতে রসু খাঁ চাঁদপুর এসে ফরিদগঞ্জের গাজীপুর বাজার সংলগ্ন একটি মসজিদ থেকে ১৭টি ফ্যান চুরি করে এবং দু’টি বস্তায় করে যাওয়ার পথে আখ ব্যবসায়ী তাজু ও বাজারের নৈশ প্রহরী তাকে হাতে নাতে ধরে ফেলে। ওই সূত্র ধরেই পুলিশ রসু খাঁকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে ১১টি খুন করেছে বলে স্বীকারোক্তি প্রদান করে।
জহিরুলের মা হাফছা বেগম জানায়, ‘হত্যা মামলার আসামী করে রসু খাঁকে আদালতে প্রেরণ করার পর তাকে জামিনে বের করার জন্য তার স্ত্রী রিনার মাধ্যমে আমার কাছে টাকা চায়। কিন্তু টাকা দিতে পারবো না এবং এমন ভাইয়ের পরিচয় দিবো না বলে ওইসময় আমি জানিয়ে দেই। কিন্তু এ খবর রসু খাঁকে স্ত্রী রিনা জেলা কারাগারে দেখতে গিয়ে জানালে সে ক্ষীপ্ত হয়ে আপন ভাগিনা জহিরুল ইসলামকে হত্যার ঘটনায় জড়িয়ে দিবে বলে হুমকি দেয়। রসু খাঁকে রিমান্ডে এনে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলে পারভীন হত্যার ঘটনায় তার ভাগিনা জহির জড়িত রয়েছে বলে সে মিথ্যা জবানবন্দি দেয়।’
পরে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মীর কাশেম রসু খাঁকে বোরকা ও মুখে মুখোশ পরিয়ে রাতে টঙ্গী মিরাজপাড়া নিয়ে যায়, এবং বোনের বাসা থেকে ভাগিনা জহিরুল ইসলামকে আটক করে চাঁদপুর নিয়ে আসে।
জহিরুল মামলার সাথে জড়িত রয়েছে বলে উপ-পরিদর্শক (এসআই) মীর কাশেম আদালতকে জানায় এবং পারভীন হত্যার ঘটনায় জহিরুল ইসলামকে দু’নম্বর আসামী করে পুলিশ আদালতে প্রেরণ করে। ফরিদগঞ্জ থানার মামলা নম্বর ১৫, তারিখ- ২১-০৭-২০০৯, জিআর -১২২/০৯, নারী ও শিশু-২১/১০ ধারা, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ২০০০ এর সংশোধনী ২০০৩।
এদিকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রত্যাহারের জন্য রসু খাঁর ভাগিনা জহিরুল ইসলাম চাঁদপুর জেলা কারাগার জেল সুপার এর মাধ্যমে আদালতে দরখাস্ত প্রদান করেন। সেখানে জহিরুল উল্লেখ করেন, ‘পারভীন হত্যা মামলার ঘটনায় এসআই মীর কাশেম তাকে টঙ্গী থেকে ধরে এনে থানায় নিয়ে রাতে হ্যান্ডকাপ পড়িয়ে চোখ মুখ বেধে ব্যাপক নির্যাতন করে।
‘ইলেকট্রিক শর্ট দিয়ে ভয়ভীতি প্রর্দশন করে তাদের শিখিয়ে দেয়া হত্যার ঘটনার সাথে জড়িত রয়েছে ও ঘটনার সময় রসু খাঁ পারভীনকে হত্যা করেছে এ ঘটনা দেখেছে বলে আদালতে স্বীকারোক্তি প্রদান করার জন্য বলে।’
তাই নিজের ‘জীবন বাচাঁতে’ পুলিশের কথায় আদালতে ‘মিথ্যা স্বীকারোক্তি’ প্রদান করে।
মূলত: এ হত্যার ঘটনার সাথে রসু খাঁ ছাড়া অন্য কেউ জড়িত ছিল না বলে জহিরুল পরবর্তীতে আদালতকে জানায়।
জহিরুলের মামলার আইনজীবী চাঁদপুর জেলা আইনজীবি সমিতির সভাপতি এড. সেলিম আকবর জানায়, ‘ চাঁদপুর জেলা দায়ারা জজ কোর্টে ১৭ অক্টোবরে জহিরূলের মামলার তার জামিন প্রার্থনা করবো। এ হত্যা মামলায় সকল সাক্ষীরা জহিরুলের পক্ষে সাক্ষ দিয়েছেন। বাকি ক’জনের সাক্ষ বাকি রয়েছে। তারা সাক্ষ না দেয়ার কারণে মামলা এতো দিন ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। আশা করা যায়, খুব দ্রুত বিচার কাজ শেষ হবে।’
জহিরুলের পূর্বের অবস্থান প্রসঙ্গে তার জানায়, তারা ফরিদগঞ্জ উপজেলার পূর্ব গোবিন্দপুর ছৈয়াল বাড়িতে বসবাস করতো। ২০ বছর পূর্বে জহিরের বাবা মোস্তফা মিয়া ঢাকার টঙ্গী মিরাজপাড়ার আমতলীতে বেকারির রুটি বিস্কুট পাইকারি দোকানে বিক্রি করতো । সে সুবাদে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসে। জহির টঙ্গী ন্যাশনাল উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতো। এসএসসি টেস্ট পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ হওয়ার কারণে তার বাবা তাকে মীরাজপাড়ায় একটি মোবাইল ও সিডি দোকান নিয়ে দেয় ‘
অপরদিকে রসু খাঁ ও তার স্ত্রী ওই এলাকার বাবুলের বাসায় ভাড়া থাকতো। তারা দু’জনে গার্মেন্টসে চাকরি করতো। চুরির অপরাধে গ্রার্মেন্টস থেকে রসু খাঁকে বের করে দে। পরে সে ওই এলাকায় কাঁচামাল বিক্রি করতো। মাঝে মধ্যে টাকা নেয়ার জন্য এসে বোনের বাসায় এসে চাপ প্রয়োগ করতো। এর কিছু দিন পরেই রসু খাঁ চাঁদপুরে এসে মসজিদের ফ্যান চুরি করে পালানোর সময় মানুষের হাতে আটক হয়।
মামলার ১১ জন স্বাক্ষী জহিরের পক্ষে সাক্ষ্য দিলেও মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা মীর কাশেম আদালতে সাক্ষ্য না দেয়ায় বিচার কাজ শেষ না হয়ায় জহিরুল ইসলাম এখনো জামিনে মুক্তি পায়নি।
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ০৮:২০ পিএম, ১৩ অক্টোবর ২০১৬, শুক্রবার
ডিএইচ
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur